যৌনতা কখনই অপরাধ নয়, বিজ্ঞান

India Rapeরওশন আরা বেগম: আমার জন্ম খুলনায়। স্বাধীন দেশে জন্মেও জন্মের পর থেকে আমি মুক্তভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাইনি। এর একটাই কারণ, আমি মেয়ে। বাইরের জগত মানেই পশুর বিচরণ ক্ষেত্র। এই সব পশুর আঁচড় যাতে গায়ে পড়তে না পারে এই ভয় কানের ভিতর গেঁথে গিয়েছিল সেই ছোটকাল থেকেই। যার ফলে মুক্ত বাতাস খাওয়ার সুযোগ আর হয়নি।

আমার মত আরো অনেকেই আছে যারা কিছু বুনো জন্তুর ভয়ে মুক্ত বাতাস থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশ থেকে বের হয়েই আমি যথার্থ মুক্তি পেয়েছিলাম। তাই দূরে থেকে দ্বিধাহীন কণ্ঠে আমি বাংলা সমাজের সংস্কারের দাবী জানাই, দাবী জানাই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিরাপদ অবস্থান ও মুক্ত বাতাস খাওয়ার অধিকার।

দীর্ঘ তেঁতাল্লিশ বছর আমরা পার করেছি স্বাধীনতার খেতাব নিয়ে, আজ আমি একে খেতাবই বলবো, কারণ স্বাধীন দেশ আসলে কী? যখন মানুষ নিজেই স্বাধীন না? আমার জন্মস্থানেই ছিল সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মজজিদ, যা আজও দেখা হয়নি। বাসা আর স্কুল এই পর্যন্ত ছিল আমার যাতায়াত। এর বাইরে যাওয়া আমার মত মেয়ে মানুষের জন্য নিরাপদ নয়। এইভাবে খুব নিরাপদে চলাফেরা করেই বিদ্যালয়ের শেষ পাসটি দিয়েছিলাম। এরপর বিবাহ সূত্রে কানাডায় পাড়ি জমাই। কিন্তু আমার সেই জন্মভূমি প্রিয় দেশটিকে আজও দেখা হয়নি। দূরে থেকে ভাবি দেশে গিয়ে সব জায়গায় বেড়াব। কিন্তু সেই বাংলার পথঘাট আজও নাকি নিরাপদ নয়। তাহলে এই দেশটি কিসের জন্য স্বাধীন হয়েছিল? কেন আজও দেশ শত্রু মুক্ত হতে পারেনি? এই শত্রুগুলো তো আজ বাইরের কেউ না, দেশীয় সমাজ কাঠামোর দ্বারাই দূষণযুক্ত শত্রু।

মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেললে যেমন সমস্যার সমাধান হয় না, ঠিক তেমনি সমাজের যে জায়গায় ক্ষত হয়েছে, সেই জায়গাটুকুর চিকিৎসা না করে ঢেকে রাখার চেষ্টা চলছে। যার ফলে সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়েছে। মেয়ে মানুষকে আড়াল করে যদি কোন পুরুষ জিতেন্দ্রীয় ঘোষণা করে, তাহলে সে জয়ী হতে পারে না। সে তো পরীক্ষিত সত্যের মুখোমুখি হয়নি। বৈপরিত্ম্যের মধ্যে পরীক্ষিত সত্য রয়েছে। যে সমাজে বৈচিত্র বা বৈপরিত্ম্যের কোন স্থান নেই, সেই সমাজতো মানুষের জন্য নিরাপদ নয়।

একটি খেলার মাঠে শুধুই পুরুষের উপস্থিতি হবে কোন নারীর অবস্থান থাকবে না, এটি তো অসভ্য সমাজের অপ্রকৃতিস্থ আচরণ বলে প্রকাশ পায়। নারী ও পুরুষের সমান অবস্থান আমাদের সমাজে কোথাও তেমন দেখা যায় না।

বাংলাদেশী একটা ছেলে বা মেয়ে যখন উন্নত দেশে পড়াশোনা করতে আসছে তখন তারা বিপরীত লিঙ্গের সাথে একসঙ্গে কাজ করতে বেশ অস্বস্তি অনুভব করে। এর কারণ হলো দেশীয় সমাজ কাঠামোর মধ্যে নারী ও পুরুষ পৃথক ব্যবস্থায় অভ্যস্ত।  ছেলেদের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশী প্রকটতা পায়। কানাডায় আমেরিকায় স্কুল-কলেজ ছেলেমেয়েদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা নেই। তাই এখানকার ছেলেমেয়েরা ছোট কাল থেকে এক ধরনের পরীক্ষিত সত্যের মুখোমুখি হয়। সেই সত্যটি হলো নারী ও পুরুষের সহাবস্থান।

যৌনতা নারী ও পুরুষের উভয়ের আছে। আমাদের সমাজে যৌনতাকে অচ্ছুত, নোংরা দৃষ্টিতে দেখা হয়। যার ফলে গোপনে যৌন নির্যাতন এক ভয়াবহ রুপ নিয়েছে। যে যৌনতার মাধ্যমে মানুষের জন্ম হয়, সেই যৌনতাকে কেন ঘৃণা করতে হবে? এর মধ্যেই সৃষ্টি লুকায়িত আছে। এটি যে একটি বিজ্ঞান, ও পাঠ্যপুস্তকের বিষয় হতে পারে, তা আমাদের দেশের লোকে মানতে নারাজ। কারণ এতে জাতপাত নষ্ট হয়ে যাবে এই ভয় দেখিয়ে গোপনে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। যৌন তাড়না মিটানোর জন্য উন্নত দেশগুলোয় নানা রকমের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। যেমন পিপ শো, ট্যাভার্ন,  ল্যান্ডকাস্টার, এডাল্ট ক্লাব ইত্যাদি। কারো দরকার হলে এইসব প্রতিষ্ঠানে যাবে। এতে কারো কোন ক্ষতি হচ্ছে না। যদি যৌনতার বাণিজ্যিক ব্যবহার অনৈতিক হয়, তবে কেন সেই নৈতিকতার দায়টা সেবাগ্রহিতার ওপর ছেড়ে দেয়া হবে না!

আসলে তাই হচ্ছে পশ্চিমের দেশগুলোতে। নিজের সাথে জেহাদটা মানুষকেই করতে দাও। পশ্চিম থেকে কিছু নেয়া যাবে না, এগুলো না করে ওহাবী মনোভাব যত শীঘ্র ত্যাগ করা যায় ততই মঙ্গল। তাহলে পরীক্ষিত সততা প্রতিষ্ঠা পায়। তাতে যেমন সরকার আয়কর পাচ্ছে, সমাজও সুন্দর থাকছে।

যৌনতা কোন অপরাধ না, যখনই এটি জোর করে মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়, ঠিক তখনই এটি অপরাধ। ঢাকা শহরে যে যৌনপল্লীগুলো ছিল সেইগুলো উচ্ছেদ করে পুরো ঢাকা শহরে  তা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কমে গিয়েছে। ঢাকা শহর পুরাটাই যৌনপল্লীতে রুপান্তর হচ্ছে এটি মানতে অনেকেই নারাজ হলেও এর কিছু প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে।

বিশেষ করে ঢাকাতে যাদের বাড়ি রয়েছে, ভাড়া দিতে হয় শুধুই তারাই এই সমস্যার ভুক্তভোগী। বেশ কয়েক বছর আগে আমাদের ঢাকার বাসায় এক দম্পতি একটি ফ্লাট ভাড়া নেয়। কিন্তু পরে জানা যায়, তারা আসলে স্বামী-স্ত্রী নন, ভাড়া নিয়ে তারা সেই ফ্লাটেই পতিতাবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দু মাসের মাথায় এটি ধরা পড়ে। বাড়ি ছাড়ার নোটিস দিয়েও কোন কাজ না হলে, পুলিশ এনে তাদের উচ্ছেদ করতে হয়েছিল। এই ঘটনা একবার নয় বহুবার হয়েছে। যেহেতু তাদের পল্লীগুলো উচ্ছেদ করা হচ্ছে তাই তারা যে কোন জায়গায় নতুন ঘাঁটি বাঁধছে।

ধর্মীয় ছত্রছায়ায় যৌন পীড়ন বেড়েছে বহুগুণ। মাদ্রাসার যে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ছেলেরা বেড়ে উঠছে, তাদের মধ্যে যৌন পীড়নের মাত্রা বেশী। তাদের শারীরিক, জৈবিক চাহিদাকে অস্বীকার করে একটি ধর্মীয় কড়া শাসনের মধ্যে বড় হতে হচ্ছে। তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক-বিনোদন নেই। নাচ-গানকে হারাম আখ্যায়িত করে বন্ধ করা হয়েছে। এরকম পরিবেশের মধ্যেই যৌন বিকৃতির বিকাশ ঘটে। আর এজন্য আমরা  শফি সাহেবের মুখ থেকে তেঁতুল তত্ত্বের কথা শুনতে চাই। এই কথা নিয়ে মিডিয়ায় বেশ হৈচৈ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেউ অনুসন্ধান করেননি যে শফী সাহেবের মত লোক দ্বারাই সমাজে গোপনে তীব্র যৌন পীড়ন চলছে। সমাজকে সুন্দর ও বসবাস যোগ্য করতে হলে এই সব বিষয় নিয়ে গবেষণা অতি জরুরি।

সভ্যতার স্থায়িত্ব রক্ষার জন্য সমাজে বৈচিত্র্যের স্থিতি অতি প্রয়োজন। এটা শুধু নারী-পুরুষের সহাবস্থানই নয়, সব ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের ছাপ থাকতে হবে। তখন সততা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পরীক্ষিত হয়ে স্থায়িত্ব লাভ করবে। কবির ভাষায়-

অন্ধকারের উৎস হতে উৎসরিত আলো

সে তোমারই আলো

সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভাল

সে তোমারই ভাল।

………………….এটাই শেষ কথা।

শেয়ার করুন: