নাদিরা কিরণ: গণমাধ্যমে আমাদেরই সহকর্মী জয়শ্রী জামান এর জীবনে অপ্রত্যাশিত,অনাকাঙ্খিত ,মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর এনিয়ে গনমাধ্যমে নানা রং চড়িয়ে সংবাদ পরিবেশন এবং এনিয়ে সুস্থ্য মানসিকতার সহকর্মী , সহযোদ্ধা ও সংবেদনশীল বহু মানুষ নানা ভাবে প্রতিবাদ ও তীব্র নিন্দা জানানোর পর অনেকটা দিন পার হয়ে গেছে। আজ অনেকদিন পর আবার কেনো এ প্রসঙ্গ টেনে আনা এমন প্রশ্ন হয়ত অনেকের মনেই উঁকি দিবে। কিন্তু ঐ ঘটনার পর আর সবার মত আমারও মনটা শোকাহত হয়েছিলো এটা যেমন ঠিক। আর জয়শ্রীর সন্তানদুটির এভাবে চলে যাওয়ার জন্য যখন কিছু গনমাধ্যমের লেখনীতে জয়শ্রীর দিকে অঙ্গুলী উঠেছিলো তখন অনেকের মত আমার প্রতিবাদের তীব্রতাটাও জয়শ্রীর প্রতি সমব্যাথী আমার বন্ধুসম ও সিনিয়র সাংবাদিকেরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন অনেকেই। এনিয়ে বেশ কয়েকজন এমনকি সুদুর অষ্ট্রেলিয়া থেকে আমার প্রিয় সাংবাদিক বড়ভাই ফজলুল বারী ভাইও আমায় ফোন করেছিলেন। আর বরাবরের প্রতিবাদী সুপ্রীতিদি বলেছিলেন এ নিয়ে একটা লেখা লেখো নাদিরা।
আমি কথা দিয়েও রাখতে পারিনি। মৌসুমী আবহাওয়ার পরিবর্তনের খেসারত হিসেবে বেশ কিছুদিন আমার চোখ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় প্রবল ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও একটু দেখে আসতে পারিনি জয়শ্রী আপাকেও। তবু এতদিন পর লেখা কেবল প্রতিশ্রুতি রাখতেই নয়।
নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সন্তানের বাবাকে ত্যাগ করেই মা হিসেবে একা সংগ্রাম করে সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা একজন হিসেবে আমার মনের মধ্যে এই প্রতিবাদের তীব্রটা যে আরও কতটা প্রকট ছিলো এবং তা প্রতিক্রিয়াশীল আজও তা আমিই জানি।
এ পেশায় থাকলেও বয়োজ্যেষ্ঠ ও ডেস্কে কাজ করার কারণেই হয়ত মাঠে ময়দানে জয়শ্রী আপার সঙ্গে আমার সাক্ষাত ঘটেনি কখনও। তবু একজন মা হিসেবে আরেক মায়ের একাকী সংগ্রামটাকে আমি বা আমার মতো যাদের এ যুদ্ধে নামার অভিজ্ঞতা আছে তারা বোধ করি উপলব্ধি করতে পারবেন স্বাভাবিকভাবেই। তাই এতোদিন পর আজও মন থেকে সরে যেতে পারছে না জয়শ্রী আপা ও তার হারিয়ে যাওয়া দুই সন্তান।
তবে নিজস্ব মনোবেদনা জানাতেই লেখার অবতারণা নয়। যে সুস্থ্ মানসিকতা নিয়ে আমরা যারা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলাম নতুন ঘটনা ও কালের আবর্তে সে শক্তি যেন হারিয়ে না যায়। অথবা আরেকটি ঘটনার অবতারণা ও যুক্তিহীনভাবে তাতে নারীর প্রতি অঙ্গুলীর প্রতিবাদের জন্য তা যেন তুলে না রাখি। সুস্থ্ভাবে ভাবনার মানুষগুলো যেন ভাবি, এখনও সময় আসেনি জয়শ্রী থেকে ভাবনাটা সরে যাবার।
এখনও যেমন ভাববার বিষয় রয়েছে, কেমন আছেন হতবিহবল, বিমর্ষ জয়শ্রী ? ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন কতটা ? যে সন্তানদের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা ছিলো তাঁর, সেই সন্তানহীন জীবনটা এগিয়ে নেয়ার মত গতি নিয়ে আবারও এগিয়ে যেতে পারবেন কি তিনি? ট্রমা কাটিয়ে উঠলেও তাঁর বেঁচে থাকার রসদ হিসেবে চাকরিটা ফিরে পাবেন কি জয়শ্রী ? এসব বিষয় ভাববার অবকাশ আছে বৈকি! এসব ভাবনা ভাবতেও তো আমরা এক হয়েছিলাম।
একইসঙ্গে আমরা জয়শ্রীর মতো আর কোনো নারীকে যেন এসব অযাচিত প্রশ্নবাণে পড়তে না হয়, আঙ্গুলটা অযথা পুরুষের দিকে উঠুক তাও চাইনা আমরা। তবে ঘটনার কারণ ও কৌতুহলের সমাধান ঘটাতে নারীকে দোষারোপে গিয়েই তার ইতি ঘটবে আর সাংবাদিকতার নৈতিকতা ভুলে কেবল খবরের কাটতি বাড়বে সেটা হতে দিতে চাইনা। আমরা চাইনা মরে গিয়েও আমাদের হারিয়ে যাওয়া রুনীর মতো আর কোনো মেয়ের গায়ে নোংরা কাদা লাগানোর চেষ্টা করা হোক আর।
সাংবাদিকতার জগতে নারীর প্রতি সম্মান, ভাষায় রুচিবোধ ও পেশার নৈতিকতা মানা হোক এটাই প্রত্যাশা।
এজন্যে যারা আমাদের শিক্ষা দেন, যারা আমাদের নেতা তারা যখন মাঝে মাঝে ভুলে যান এসব বিষয় তখন আমাদের সমব্যথী ও সুস্থ্ মানসিকতার মানুষগুলোকে এক সারিতে দাঁড়ানো জরুরি বোধকরি। একতাবদ্ধ হয়ে এমন একটা প্লাটফর্ম তৈরি করা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে কেবল অযথা নারী বা পুরুষকে সমালোচনার ঘটনা ঘটলেই তার প্রতিবাদ করার দায় মেটাবে না। বরং খবরের কাটতি ভাবতে গিয়ে কলম ধরতেও পিছপা হবে সেসব গণমাধ্যম। এজন্য নতুন করে কিছু ভাবতে হবে। গণমাধ্যমের পর্যালোচনা ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রক সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করা উচিত বলেও মনে করি।

অতি পুরোনো ও প্রচলিত বাক্য আবারও বলতে বাধ্য হচ্ছি- কাক কাকের মাংস খায় না- এই তুচ্ছ প্রাণীটিরও অধম এ পেশার মানুষ, এ উদাহরণ তো আমাদের গায়েও লাগে বৈকি! আমরা এতো তুচ্ছ হতেও চাই না। একই সঙ্গে ভাবনার ক্ষেত্রটাও একটু বদলে ভাবার তাগিদ দিতে চাই।
সন্তান দুটি চলে যাবার পেছনে কোনো প্রমাণ ছাড়াই জয়শ্রীর নতুন কাউকে ভাবাকেও কেউ কেউ কারণ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। অথচ বাবা আলিমুল হকের সন্তানদের ফেলে নতুন সংসার করার কথাটা তাদের মাথায় আসে না। আদৌ জয়শ্রীর জীবনে কেউ আছে কিনা আমরা কেউ জানি না। কিন্তু আরেকটু স্বাভাবিকভাবে যদি ভাবতে পারতেন যে জয়শ্রীর মত মায়েরা একজন মানুষও বটে। যদি নতুন করে কারো কথা ভাবেনও বাবার মত সন্তানদের বাদ দিয়ে ভাবছেন, এমন তথ্য তারা পেলেন কোথায় ? আর মা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মানুষ হিসেবে জীবনে কাউকে গ্রহণ করার অধিকার যেকোন নারীরই রয়েছে।
নিজের পক্ষে সাফাই নয়, আমার আশেপাশে আরো অনেক নারী রয়েছেন যারা জীবনে দ্বিতীয় কাউকে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু সন্তানকে তো ফেলে যাননি। তাদের জীবনের নতুন মানুষটি তাদের সন্তানের বাবা কতোটা হয়েছেন নিরিখ করে বলতে না পারলেও, বন্ধু হয়েছেন এটা অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। আবার সন্তানদের সাথে বনেনি তাই দ্বিতীয় ঘরটিকেও ছেড়ে এসেছেন অবলীলায়, এমন মা’এর উদাহরণও রয়েছে।
তাই কেবল সন্তানদের কথা ভেবে সারা জীবন একা থেকেই নারী ‘প্রকৃত/আদর্শ মা’ থাকেন- এই একতরফা ভাবনাটা বাদ দিয়ে তাদের বলবো চোখের ও মনের দৃষ্টি প্রসারিত করুন। নিজেকে সুশীল হিসেবে ভাবতে চাইলে শুধু সহযাত্রী কর্মী হিসেবে এ পেশার নারীকে নয়, যে কোনো মেয়েকে আগে মানুষ ভাবার চেষ্টা করুন। আর আমরা যারা এভাবনা গুলিতে একটু এগিয়ে আছি বলে নিজেদের দাবি করি, তাদের আবারও বলবো চলুন ভাই ও বোনেরা একত্র হই। একটা শক্ত প্রতিবাদের প্লাটফর্ম গড়ে তুলি।
নাদিরা কিরণ, অ্যাসিসটেন্ট চিফ রিপোর্টার, এটিএন বাংলা