সুমিত রায়:
নরসিংদীর এক সরকারি কলেজের বাংলার সহকারী অধ্যাপক নাদিরা ইয়াসমিন নাকি ‘ইসলামবিরোধী’ আর ‘সামাজিক মূল্যবোধ বিধ্বংসী’ কাজ করেছেন। তাই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাকে কলেজ থেকে তাড়াতে হবে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কারা বলছে এসব? হেফাজতে ইসলাম, তানযীমুল মাদারিসিল কাওমিয়া, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস—নরসিংদীর সব বড় বড় নাম। তাদের একটাই দাবি, নাদিরা ইয়াসমিন মেয়েদের অধিকারের কথা বলছেন, বিশেষ করে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ম্যাগাজিন বের করেছেন। ব্যস, আর যায় কোথায়! ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের নাকি ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে, যেকোনো মুহূর্তে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ!
যখন কোনো নারী প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে নিজের কথা বলতে চায়, সমাজের বহুদিনের পুরোনো দেয়ালে আলতো করে টোকা দেয়, তখন কিছু মানুষের খুব গায়ে লাগে। তাদের মনে হয়, এই বুঝি সব গেল, সব রসাতলে গেল! ফরাসি দেশের এক বিদূষী নারী ছিলেন, সিমোন দ্য বোভোয়ার। তিনি ভারী চমৎকার একটা কথা বলেছিলেন—সমাজ সব সময় মেয়েদের পুরুষের সাপেক্ষে ‘অপর’ বা দ্বিতীয় লিঙ্গ করে রাখতে চায়। মানে হলো, মেয়েরা নিজেরা কিছু নয়, পুরুষের তুলনায় সে কেমন, সেটাই তার পরিচয়। নাদিরা ইয়াসমিনের ক্ষেত্রেও কি তাই ঘটছে না? তিনি যখন বলছেন, মেয়েরাও মানুষ, তাদেরও সমান অধিকার দরকার, তখন কিছু মানুষের মনে হচ্ছে, তিনি বুঝি ইসলামকেই অস্বীকার করছেন, সমাজটাকেই ভেঙে ফেলতে চাইছেন। কারণ, তাদের চোখে মেয়েরা তো সেই ‘অপর’, যাদের কাজ হলো পুরুষের দেখানো পথে চলা, তাদের তৈরি করা বিধান মেনে নেওয়া। এর বাইরে গেলেই সে ‘বিপজ্জনক’।
আবার দেখুন, আমরা যে বলি ‘ছেলে’ বা ‘মেয়ে’, এই পরিচয়টা কি শুধুই জন্মসূত্রে পাওয়া? নাকি সমাজ আমাদের দিনের পর দিন নানা নিয়মকানুন, আচার-ব্যবহার শিখিয়ে এটা তৈরি করে? জুডিথ বাটলার নামে আরেকজন চিন্তাবিদ আছেন, তিনি বলেন, এই যে লিঙ্গ পরিচয়, এটা অনেকটা মঞ্চে অভিনয় করার মতো। সমাজ আমাদের একটা চরিত্র ধরিয়ে দেয়, আর আমরা সেই অনুযায়ী হাত-পা নেড়ে, কথা বলে চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলি। হেফাজত বা অন্য সংগঠনগুলো যখন উত্তরাধিকারের মতো বিষয়ে ধর্মগ্রন্থের নির্দিষ্ট ব্যাখ্যাকে একমাত্র সত্য বলে ধরে নেয় এবং নারীর জন্য একটা বাঁধা-ধরা ভূমিকা ঠিক করে দেয়, তখন তারা আসলে এই সামাজিক ‘অভিনয়কেই’ টিকিয়ে রাখতে চায়। নাদিরা ইয়াসমিন যখন সেই চিত্রনাট্যের বাইরে গিয়ে প্রশ্ন তোলেন, নতুন করে ভাবতে বলেন, তখন তাদের সাজানো মঞ্চ কেঁপে ওঠে। তাদের ভয়, মেয়েরা যদি এই ‘অভিনয়’ ছেড়ে দেয়, নিজেদের মতো করে বাঁচতে শেখে, তাহলে তো তাদের এতদিনের কর্তৃত্বটাই প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে!
আচ্ছা, ভাবুন তো, যে মেয়েটা গ্রামে থাকে, যার হয়তো নিজের জমিটুকু নেই, বাবার সম্পত্তিতেও ভাইয়ের অর্ধেক পায়, তার কষ্টটা কেমন? তার ওপর যদি ধর্মের দোহাই দিয়ে এই বৈষম্যকেই ‘ইনসাফ’ বা ন্যায়বিচার বলা হয়, তখন তার কেমন লাগে? বেল হুকস নামে একজন অসাধারণ লেখক আছেন, যিনি শিখিয়েছেন যে শুধু মেয়ে হলেই হয় না, সে কোন শ্রেণি থেকে আসছে, তার গায়ের রং কী, তার ধর্ম কী—এসবকিছু মিলিয়ে তার ওপর নির্যাতনের রকমফের হয়। তিনি বলতেন, একেবারে প্রান্তিক, সবচেয়ে অসহায় যে নারী, তার মুখ থেকে যখন কথা বেরোয়, তখন সেটা সমাজের অনেক বড় বড় সত্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। নাদিরা ইয়াসমিন যখন ‘হিস্যা’ নামে ম্যাগাজিন বের করে উত্তরাধিকারের সমানাধিকার নিয়ে কথা বলেন, তখন তিনি তো সেইসব অসংখ্য মেয়ের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন, যাদের কথা কেউ শুনতে চায় না। এই যে ‘নারী অঙ্গন’ নামে সংগঠন তৈরি করা, এটা তো সেই প্রান্তিক মানুষগুলোকে কেন্দ্রে নিয়ে আসার চেষ্টা। অথচ একদল লোক এই চেষ্টাকেই ‘সরলমনা মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস বিনষ্ট করার অপচেষ্টা’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছে! তাদের ভাষায়, নাদিরা ইয়াসমিন নাকি ঈমানহারা করছেন! আশ্চর্য! অধিকারের কথা বললে ঈমান চলে যায়?
যুগে যুগে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ধর্মের বাণীকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করেছে। আমিনা ওয়াদুদের মতো ইসলামি নারীবাদী গবেষকরা দেখিয়েছেন, কুরআনকে যদি তার সঠিক প্রেক্ষাপট, ভাষা এবং নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে আবার পড়া যায়, তাহলে অনেক সংকীর্ণ ধারণা থেকে মুক্তি মেলে। তারা বলেন, কুরআন নারীকে সম্মান দিয়েছে, অধিকার দিয়েছে, কিন্তু সেই কথাগুলো পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যার আড়ালে চাপা পড়ে গেছে। তাই যখন ধর্মের বৈষম্যসৃষ্টিকারী বিষয়গুলোকে সামনে আনার অর্থ ধর্মগ্রন্থের পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করাও হতে পারে, যেগুলো ন্যায়বিচারের পরিপন্থী? আর ধর্ম যেখানে মানুষের জীবনের সাথে এত ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেটা বা ধর্মগ্রন্থের প্রচলিত ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে কোন ক্রিটিকাল আলোচনা করতে দেয়া হবেনা – এমনটা জাস্ট হতে পারেনা। এগুলো স্বাভাবিকভাবেই আসবে, আর এগুলো নিয়ে বিতর্কও স্বাভাবিকীকৃত করতে হবে। কিন্তু সমাজের মৌলবাদী-আক্ষরিকতাবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীরা এরকম আলোচনায় প্রবেশ করতে নারাজ, হয়তো ধর্ম ও তার বয়ান নিয়ে তাদের ক্ষমতার জায়গাটা ধ্বসে পড়তে পারে তাই। আর তাই তারা এত সহজে ‘সুরা নিসার ১১ নম্বর আয়াতের বিরুদ্ধাচরণ’ আর ‘স্পষ্ট নাস্তিকতা’র অভিযোগ তুলে ফেলতে পারে! তাদের যুক্তিতে, কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না, কোনো নতুন চিন্তা করা যাবে না, যা আছে তাই মানতে হবে।
মানুষের জীবনে শুধু পেটের ভাত হলেই চলে না, তার আত্মসম্মানও লাগে। ন্যান্সি ফ্রেজার নামে একজন সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন, সত্যিকারের সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য দুটো জিনিস দরকার—সম্পদের ঠিকঠাক বণ্টন আর সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি। মানে হলো, একদিকে যেমন সবার জন্য রুটি-রুজির ব্যবস্থা থাকতে হবে, তেমনি অন্যদিকে প্রত্যেক মানুষের পরিচয়, তার বিশ্বাস, তার সংস্কৃতি যেন মর্যাদা পায়, সেটাও দেখতে হবে। নাদিরা ইয়াসমিন যখন উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে সমানাধিকারের কথা বলছেন, তখন তিনি একদিকে সম্পদের সুষম বণ্টনের দাবি তুলছেন। আবার, এই দাবি তোলার কারণে তাকে যে ‘ইসলামবিরোধী’, ‘সমাজবিধ্বংসী’ ইত্যাদি বলে আক্রমণ করা হচ্ছে, এটা তো তার সাংস্কৃতিক স্বীকৃতিকেই অস্বীকার করা। তাকে এবং তার মতো আরও অসংখ্য নারীকে এই বলে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, তাদের এই ধরনের চিন্তা করার বা বলার অধিকার নেই। তাদের কথা শুনলে নাকি ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি’ ঘটবে! কী ভয়ানক হুমকি!
সত্যি বলতে, নাদিরা ইয়াসমিনের মতো মানুষেরা যখন কথা বলেন, তখন সমাজের অনেক পুরোনো ঘা শুকোতে শুরু করে। তারা প্রশ্ন তোলেন, কারণ তারা চান একটা আরও সুন্দর, আরও মানবিক পৃথিবী। তাদের কণ্ঠরোধ করার জন্য যারা ‘৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম’ দেয়, যারা ‘কঠোর কর্মসূচি’র ভয় দেখায়, তারা আসলে অন্ধকারকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। একজন সরকারি চাকরিজীবী, যিনি জনগণের টাকায় বেতন পান, তিনি যদি সেই জনগণেরই একটা অংশের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, তবে সেটা অন্যায় হয় কীভাবে? বরং অন্যায় তো সেটাই, যখন যুক্তির বদলে হুমকি আসে, আলোচনার বদলে আসে চাপাতি উঁচিয়ে তেড়ে আসার আস্ফালন।
নাদিরা ইয়াসমিন একা নন। তার মতো আরও অনেকেই আছেন, যারা নীরবে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন একটা আলোকিত সমাজের জন্য। তাদের ভয় দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে হয়তো কিছুদিনের জন্য চুপ করিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু সত্যের যে নিজস্ব একটা শক্তি আছে, তাকে পুরোপুরি মুছে ফেলা যায় না। আজ যারা নাদিরা ইয়াসমিনের অপসারণ চেয়ে হুঙ্কার ছাড়ছেন, ইতিহাস হয়তো একদিন তাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসবে। কারণ, পৃথিবীটা তো সামনের দিকেই এগোয়, পেছনের দিকে নয়। আর সেই এগিয়ে চলার পথে নাদিরা ইয়াসমিনদের মতো মানুষেরাই তো আলো জ্বেলে পথ দেখান। তাদের জন্য ভালোবাসা। আর যারা এই আলোর শিখা নিভিয়ে দিতে চায়, তাদের জন্য একরাশ করুণা।
নাদিরা ইয়াসমিন, আপনার এই অসম সাহসের যাত্রায়, আমরা আপনার নিঃশঙ্ক সহযাত্রী।
#IfYouAskUs
#BdFeministThoughts
#WhatAreBdFeministsThinking
#WomanUnite