সুমিত রায়:
আচ্ছা, বিষয়টা একটু ধাক্কা লাগার মতোই, তাই না? যখন সমাজের একদল নারী তাদের অধিকার চাইতে গিয়ে শুনতে পায় “বেশ্যা”র মতো একটা ভয়ংকর গালি, আর তার জবাবে তারা প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে বলে, “হ্যাঁ, আমরা সবাই বেশ্যা, বুঝে নেব হিস্যা” বা “চেয়েছিলাম হিস্যা, হয়ে গেলাম বেশ্যা” – তখন অনেকেরই চোখ কপালে ওঠে। কেউ বলেন, ছিঃ ছিঃ, এ কেমন ভাষা! কেউ বলেন, মেয়েরা সব উচ্ছন্নে গেল! কিন্তু কখনো কি আমরা ভেবে দেখেছি, এই তথাকথিত ‘অশ্লীল’ কথাগুলোর পেছনে কতখানি অপমান, কতখানি যন্ত্রণা আর কতখানি প্রতিবাদের আগুন জমা হয়ে আছে?
আসলে এই যে আমরা কিছু শব্দকে ‘ভালো’ আর কিছু শব্দকে ‘খারাপ’ বলে দাগিয়ে দিই, এর পেছনেও কিন্তু সমাজের ক্ষমতাধরদের একটা বিরাট কারসাজি থাকে। নারীদের দাবিয়ে রাখার জন্য, তাদের কণ্ঠ রোধ করার জন্য যত রকমের অপমানজনক শব্দ অভিধানে খুঁজে পাওয়া যায়, তার মধ্যে ‘বেশ্যা’ সম্ভবত সবচেয়ে কার্যকরী। এই একটা শব্দ দিয়েই যেন একটা মেয়ের চরিত্র, তার সম্মান, তার অস্তিত্ব – সবকিছুকে মুহূর্তে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া যায়। আর যখন হেফাজতে ইসলামের মতো কোনো সংগঠন, যারা নিজেদের সমাজের নৈতিকতার স্বঘোষিত ঠিকাদার মনে করে, তারাই এই শব্দটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তখন নারীদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। এই যে একটা অপমানজনক শব্দকে ঘুরিয়ে প্রতিবাদের হাতিয়ার বানানো, এর পেছনে গভীর সমাজতাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে।
শাসক শ্রেণি শুধু জোর করে শাসন করে না, তারা এমন একটা সংস্কৃতি তৈরি করে যেখানে তাদের তৈরি করা নিয়মকানুন, তাদের চাপিয়ে দেওয়া মূল্যবোধগুলোকেই আমাদের ‘স্বাভাবিক’ বা ‘সঠিক’ বলে মনে হয়। ইতালির চিন্তাবিদ আন্তোনিও গ্রামসি এই ব্যাপারটাকে বলেছেন আধিপত্যবাদ বা হেজিমনি। এই যে নারীকে দেখলেই তার চরিত্র নিয়ে টানাটানি করা, তার পোশাক নিয়ে কথা বলা, তার স্বাধীনভাবে চলাফেরাকে বাঁকা চোখে দেখা—এই সবকিছুই আসলে ওই আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির অংশ। যখন নারীরা অধিকার চাইতে নামে, তখন তাদের “বেশ্যা” বলে চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও এই আধিপত্য কায়েম রাখার একটা কৌশল। “আমরা সবাই বেশ্যা, বুঝে নেব হিস্যা” – এই স্লোগানটা গ্রামসির চোখে সেই আধিপত্যের মূলে একটা বড় রকমের ধাক্কা। এটা বুঝিয়ে দেয় যে, তোমরা যেটাকে গালি ভেবে আমাদের দিকে ছুঁড়ে মারছ, আমরা সেটাকেই আমাদের শক্তির উৎস বানিয়ে নিতে পারি। তোমাদের চাপিয়ে দেওয়া ‘সম্মতি’র সংস্কৃতি আমরা আর মানছি না।
ক্ষমতা অনেক সময় সরাসরি শারীরিক আঘাত না করেও, কেবল ভাষা, প্রতীক বা সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং তাদের মনে হীনমন্যতা ঢুকিয়ে দেয়। ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়ের বুর্দ্যু আমাদের এই “প্রতীকী সহিংসতার” সাথে পরিচয় করিয়েছেন। ‘বেশ্যা’ শব্দটি ঠিক এই কাজটাই করে। এই শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে নারীকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া হয়, তার আত্মমর্যাদাকে এমনভাবে আহত করা হয় যে সে যেন নিজের অধিকারের কথা বলতেই লজ্জা পায়। এই লজ্জা, এই অপমান – এগুলোই সাংকেতিক সহিংসতার উদাহরণ। নারীরা যখন বলে “আমরা সবাই বেশ্যা”, তখন তারা আসলে বুরদিয়ু বর্ণিত এই সাংকেতিক সহিংসতার কাঠামোটাকেই ভেঙে ফেলতে চায়। তারা যেন বলতে চায়, “তোমাদের দেওয়া এই অপমানজনক পরিচয় আমরা গ্রহণ করছি, কিন্তু একে আমরা দুর্বলতা নয়, শক্তিতে রূপান্তর করব। তোমাদের শব্দ আর আমাদের আহত করতে পারবে না।”
ভাষা শুধু কোনো কিছু বর্ণনা করে না, ভাষা অনেক সময় কাজও করে, পরিচয়ও নির্মাণ করে। মার্কিন দার্শনিক জুডিথ বাটলার এই বিষয়টিকে বলেছেন পারফরমেটিভিটি। যেমন, বিয়ের সময় যখন কাজী বলেন, “কবুল”, তখন শুধু একটা শব্দ উচ্চারিত হয় না, একটা সামাজিক সম্পর্ক তৈরি হয়। তেমনি, কাউকে “বেশ্যা” বলার মাধ্যমে তাকে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়, এক ধরনের কলঙ্ক লেপে দেওয়া হয়। এটা একটা পারফরম্যান্স, একটা কাজ। কিন্তু বাটলার আরও দেখান যে, এই ধরনের অপমানজনক শব্দকে উল্টো ব্যবহার করেও প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়। নারীরা যখন নিজেদের “বেশ্যা” বলে ঘোষণা দেয়, তখন তারা শব্দটার অপমান করার ক্ষমতাকেই নষ্ট করে দেয়। তারা শব্দটাকে একটা নতুন অর্থ দেয়, একটা বিদ্রোহী পরিচয় তৈরি করে। এটা হলো অপমানজনক শব্দের পুনঃঅর্থায়ন (re-signification) এবং এক ধরনের পাল্টা পারফরম্যান্স। এই পাল্টা পারফরম্যান্সের মাধ্যমে তারা দেখিয়ে দেয়, তোমরা আমাদের যে নামে ডাকবে, আমরা সেই নামেই যুদ্ধ করব।
মানুষের জন্য শুধু অর্থনৈতিক সমতা বা অধিকারই যথেষ্ট নয়, সামাজিক স্বীকৃতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ন্যান্সি ফ্রেজার বা অ্যাক্সেল হনেথের মতো তাত্ত্বিকরা আমাদের শিখিয়েছেন, যখন নারীদের অধিকারের দাবিকে সমাজ বা রাষ্ট্র গুরুত্ব দেয় না, যখন তাদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তখন আসলে তাদের মানুষ হিসেবে যে স্বীকৃতি প্রাপ্য, সেটাকেই অস্বীকার করা হয়। এটা এক ধরনের “অস্বীকৃতিজনিত অবিচার”। হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠন যখন নারীদের “বেশ্যা” বলে, তখন তারা কেবল গালি দেয় না, তারা নারীর আত্মপরিচয় এবং সামাজিক মর্যাদাকেই অস্বীকার করে। “আমরা সবাই বেশ্যা, বুঝে নেব হিস্যা” স্লোগানটি এই অস্বীকৃতির বিরুদ্ধেই এক জোরালো প্রতিবাদ। এর মাধ্যমে নারীরা বলতে চায়, তোমরা আমাদের সম্মান না দিতে পারো, আমাদের চরিত্র নিয়ে যা খুশি তাই বলতে পারো, কিন্তু আমাদের অধিকার, আমাদের প্রাপ্য হিস্যা আমরা আদায় করে ছাড়ব। এটা একইসাথে অর্থনৈতিক বন্টন এবং সামাজিক স্বীকৃতির লড়াই।
ক্ষমতা শুধু আইন বা জেলখানার মাধ্যমে কাজ করে না, ক্ষমতা আমাদের শরীর, আমাদের যৌনতা, আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাস—এসবের ওপরও প্রভাব ফেলে। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো আমাদের এই দিকটা দেখিয়েছেন, যাকে বলা যায় ক্ষমতার শরীরী প্রকাশ বা বায়োপলিটিকস। বিশেষ করে নারীর শরীর এবং তার যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা প্রবণতা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সবসময়ই দেখা যায়। ‘বেশ্যা’ শব্দটি নারীর শরীর এবং তার যৌনতাকে কলঙ্কিত করার একটা প্রধান হাতিয়ার। নারীরা যখন এই শব্দটিকেই প্ল্যাকার্ডে লিখে সামনে আনে, তখন তারা আসলে ফুকোর ভাষায় নিজেদের শরীরকে রাজনৈতিক প্রতিরোধের একটা জায়গায় পরিণত করে। তারা যেন বলতে চায়, “এই শরীর আমাদের, এই যৌনতা আমাদের, এবং এর ওপর তোমাদের চাপিয়ে দেওয়া কোনো লজ্জা বা কলঙ্ক আমরা আর বইব না। আমাদের শরীর ব্যবহার করেই আমরা আমাদের অধিকারের কথা বলব।”
“তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার” – এই স্লোগানটাকে আমরা অনেকেই পজিটিভলি নিয়েছিলাম কারণ এর মাধ্যমে বিরোধীদের দমন করার জন্য আওয়ামী লীগের শব্দটাকে উইপন হিসেবে ব্যবহার করাটা বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু নারীরা যখন তাদের অপমানকারীকে জবাব দিতে গিয়ে একটা তথাকথিত ‘খারাপ’ শব্দ ব্যবহার করে, তখন কেন আমাদের সমাজের অনেকের গায়ে ফোস্কা পড়ে? কেন তখন সেটা ‘অসভ্যতা’ বা ‘উচ্ছৃঙ্খলতা’ হয়ে যায়? এইটাই তো আসল সংকট, এইটাই তো পুরুষতন্ত্রের গেঁড়ে বসা আধিপত্য! পুরুষের ক্ষোভ, পুরুষের প্রতিবাদ যদি ‘ন্যায্য’ হতে পারে, তাহলে নারীর ক্ষোভ, নারীর প্রতিবাদ কেন ‘অশ্লীল’ হবে? আসলে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর কাছ থেকে সবসময় নম্রতা, ভদ্রতা আর নীরবতা আশা করে। যখনই নারী সেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে নিজের ভাষায় কথা বলতে চায়, তখনই সমাজের চোখে সে ‘খারাপ’ হয়ে যায়। নারীদের এই “আমরা সবাই বেশ্যা” স্লোগানটা আসলে পুরুষতন্ত্রের এই দ্বিচারিতার বিরুদ্ধেই একটা চপেটাঘাত।
পরিশেষে বলি, “আমরা সবাই বেশ্যা, বুঝে নেব হিস্যা”—এই প্ল্যাকার্ডের ভাষা হয়তো অনেকের কানে কর্কশ লাগতে পারে। কিন্তু এই কর্কশতার আড়ালে যে গভীর বেদনা, বঞ্চনা আর প্রতিবাদের আগুন আছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করা দরকার। রাষ্ট্র যখন মৌলবাদী শক্তিকে তোষণ করে নারীর অধিকারকে পায়ে মাড়ায়, তখন নারীর প্রতিবাদের ভাষাও যে এতটা শাণিত, এতটা সরাসরি হয়ে উঠবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। এই ভাষা আসলে বেঁচে থাকার ভাষা, হিস্যা আদায়ের ভাষা, আর সর্বোপরি, পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক অসম সাহসী লড়াইয়ের ঘোষণা। এই লড়াইটাকে সম্মান জানানো শিখতে হবে আমাদের।
#IfYouAskUs
#BdFeministThoughts
#WhatAreBdFeministsThinking
#WomanUnite