রওশন আরা বেগম: কানাডার আধুনিক ঝক ঝকে সভ্যতার মাঝে এক অবরুদ্ধ অন্ধকারাচ্ছন্ন কান্না রয়েছে। এই কান্না হলো এই সমাজেরই তৈরী সেই সব অবুঝ বাচ্চা মেয়েদের কান্না। যারা জীবন সম্পর্কে কোন ধারণা পাওয়ার আগেই পিতা ছাড়াই জননী হয়ে যায়। সমাজ তাকে ‘সিঙ্গেল মাদার’ হিসাবে একটি আইডি দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর মাঝে তীব্র এক কান্না রয়েছে তা আমার স্বচক্ষে দেখা। এদের সংখ্যা অনেক।
সুজানা সে রকমই একজন, যার মা যোগ্যতা হওয়ার আগেই তিন সন্তানের জননী হয়ে যায়। সোসাল ওয়ার্ক কাজের সূত্রে তার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম।
সুজানাকে দেখে কানাডার সামাজিক কাঠামো সম্পর্কে আমার একটা বিরূপ ধারণা হয়েছিল। তার পিতা-মাতা জ্যামাইকান। এখানে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া। তিন বাচ্চা নিয়ে হাইস্কুল ঝরে যাওয়া এক ব্যর্থ কানাডিয়ান। কানাডার সমস্ত নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সুজানারা বড়ই অসহায়। মাসের ১৫ দিন যেতে না যেতেই সরকারের দেওয়া সমস্ত টাকা শেষ হয়ে যায়। এই সময় তাকে ‘চেক ক্যাশের’ শরণাপন্ন হতে হয়। আমার কাছে মাঝে মাঝে টাকা ধার নিয়ে সিগারেট কিনতো। তবে এমন কোনদিন হয়নি যে সে আমার পাওনা টাকা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যার জন্য টাকা চাইলেই সে পেত। তার তিনটি বাচ্চার পিতা একজন না। পর পর তিনজনই সুজানাকে প্রতারিত করেছে সংসারের প্রলোভন দেখিয়ে। বাচ্চাগুলো কোনদিনও পিতার মুখ দেখে নাই।
বড় মেয়ে কাসা প্রায় গর্বের সংগে বলত “I have a father also, mom told me he will come back soon to see me” বাস্তবে ৫ বছরে কোন দিনও সে পিতার মুখ দেখে নাই। তা ছাড়া সুজানাও জানে না কে তার পিতা। বাচ্চা গুলোর প্রতি সুজানার সব সময় বিরক্ত ভাব ছিল। সামাজিক বন্ধন ভেঙ্গে যেখানে চুরমার, সেখানেই সাশা-কাসাদের জন্ম হচ্ছে বন্ধনহীন মায়ের গর্ভে। এর সংখ্যা এই সমাজে অনেক। এতা সুযোগ-সুবিধার পরও সুজানারা সমাজে মাথা উচু করে গর্বিত নাগরিক হতে পারছে না কেন?
জীবন যুদ্ধে সে আজ পরাজিত ও ক্লান্ত। নতুন যৌবনের লাগামহীন দৌড়, ভোগ্য পণ্যের লোভ, বিজ্ঞাপন তাকে এমন জায়গায় এনেছে এর থেকে বের হওয়ার কোন রাস্তাই তার জানা নেই। কিংবা জানা থাকলেও হয়তো বেশ দেরি হয়ে গেছে। যে সঙ্গবাসে নেই কোন ভালবাসা, নেই কোন দায়বদ্ধতা, সেই রকম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে এ দেশের বেশ কিছু অল্প বয়সী ছেলে মেয়ে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতারণার শিকার হয়। যে বয়সে সুজানাদের লেখাপড়ার কথা সেই বয়সে তারা সন্তানের জননী হয়ে সমাজের বোঝা হিসেবে তৈরী হচ্ছে। আমার মতে, সুজানার এই দুরবস্থার জন্য দায়ী আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা, যা অতীতের অকৃত্রিম সামাজিক বন্ধন থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে ভোগবাদী সমাজের উত্থানে।
সুজানার ব্যাপারটি আমার মনে এতই তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল যে কানাডার অনেক ভাল কিছু গ্রাহ্য হত না। যে উন্নত জীবনযাপনের জন্য এই কানাডাতে আসা সে উন্নত জীবন যাত্রার পাশে একি অশোভন পশু-জীবন দেখছি। তার লাগামহীন জীবন বাচ্চাগুলোকে অনেক কষ্টে ফেলেছিল। মাঝে মাঝে দুই’এক মাসের জন্যে সে উধাও হয়ে যেত। বিনিময়ে হাতে কিছু ডলার আসতে পারে সেই প্রচেষ্টাই তার এই নিখোঁজ হওয়া। আমাদের চোখে সুজানারা নষ্ট মেয়ে, কিন্তু কানাডার সমাজ তাকে নষ্ট মেয়ে বলে আখ্যায়িত করে না। কারণ তার দ্বারা উৎপাদন ব্যবস্থার খুব বেশী ক্ষতি হচ্ছে না। এই সমাজের ব্যাক্তি স্বাধীনতার অপব্যবহার করে সে তার দেহের বাণিজ্যিকীকরণ করেছে, এর বেশী কিছু না। তার মধ্যে আমি সততা দেখেছি, দেখেছি কৃতজ্ঞ হতে। তার খুব ইচ্ছে করে সংসার বাঁধতে। যদি তাকে কেউ বিয়ে করে, এই সৌভাগ্য যদি তার হয়, তাহলে সে সব ছেড়ে সমাজবদ্ধ জীবন বেছে নেবে। এই অব্যক্ত ইচ্ছার কথা সে প্রকাশ করেছিল। কিন্ত তা কি তার ভাগ্যে হবে?
কানাডার অতি আধুনিক সভ্যতার মাঝে সুজানারা অন্ধকারে হারিয়ে যায়। টিনএজ থেকে শুরু হয় এদের বিপথে যাত্রা। এমনকি বার-তের বছরের মেয়েরা পয়সার লোভে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। পরবর্তীতে তারা নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ে। সামাজিক বন্ধনহীন সম্পর্কে যে বাচ্চাগুলোর জন্ম হচ্ছে তারা বঞ্চিত হচ্ছে নানা ভাবে। অল্প বয়সী মা বাচ্চাদের সঠিক পরিচর্যাটুকু দিতে ব্যর্থ হয়। যদিও সিঙ্গেল মাদারের জন্য কিছু কিছু প্রোগ্রাম রয়েছে এইদেশে।
এখানকার হাইস্কুলের ছেলেরা বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কের দিকে বেশী ঝুঁকে পড়ছে। এর কারণ এই শারীরিক সম্পর্কের জেরে যে সন্তানের জন্ম হয়, তাদের কোন দায়-দায়িত্ব পুরুষটির উপর বর্তায় না। সরকার থেকে সামান্য কিছু ভাতা দেয়া হয়, তা যথেষ্ট না। এইভাবে ছোট ছোট বাচ্চা মেয়েদের বঞ্চনা শুরু হয়। লেখাপড়া, পেশা এদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এর ফলে দারিদ্র্য তাদের চরমভাবে পেয়ে বসে। কেউ কেউ মাদকাসক্ত হয়ে যায়। আবার অনেকেই টাকার জন্য পেশাদার দেহব্যবসায়ীতে রুপান্তরিত হয়।
কো এডুকেশন এখানকার শিক্ষার মাধ্যম। কো এডুকেশনের বড় সুবিধা হলো যে লৈঙ্গিকতা উত্তীর্ণ হওয়া। এই ক্ষেত্রে সফলও। কিন্তু আমরা বাংলাদেশিরা এদিক থেকে অনেক পিছিয়ে। কর্ম জীবনেও একজন নারী ও পুরুষ একই সংগে কাজ করতে বেশ অস্বস্তি অনুভব করি। আমরা অনেকেই লৈঙ্গিকতা উত্তীর্ণ হতে পারি না। এর কারণ হয়তো ধর্মীয় প্রেসার। অথবা ছোট কাল থেকেই ছেলেমেয়েদের জন্য পৃথক ব্যবস্থাকরণও দায়ী। তবে সুজানাদের জন্ম আমাদের সমাজেও দেখা যায়। তার কারণ অবশ্যই ভিন্ন।