পিনাকী ভট্টাচার্য: বাংলাদেশের এক ভয়ঙ্কর ক্যানিবলের নাম!

শেখ তাসলিমা মুন:

পিনাকী ভট্টাচার্যকে বেশী চিনি ২০১৩ সালের গণজাগরণমঞ্চের সময়। কিন্তু তার নাম আমি শুনি ডাক্তার হিসেবে নয়, ব্লগার হিসেবে। গণজাগরণের সময় উনি তখন বোয়ানের হয়ে, গণজাগরণমঞ্চের হয়ে টিভিতে লাইভে আসছিলেন। শহীদজননীর অবস্থান নিয়ে চমৎকার কিছু বক্তব্য দিতেন। ফেসবুকে এ নিয়ে অনেক প্রশংসা করেছি। আমি তার বক্তব্যগুলো শুনতে অপেক্ষা করতাম।

সেই মানুষের কী ঘটলো জানি না, আগাগোড়া বদলে গেল সে। মাঝখানটা আমি কিছুটা সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম, নারীর প্রতি তার কনজারভেটিভ অবস্থান দেখে একদিন আমি তাকে ফেসবুকলিস্ট থেকে রাগ করে রিমুভ করে দেই। অনেকটা এ কারনে আমি তার এ রূপান্তরটা ফলো করতে পারিনি। কিছুদিনের ভেতর কমন বন্ধুদের কল্যাণে তার কিছু পোষ্ট দেখা শুরু এবং সেই থেকে বিস্ময়ের শুরু।

কী ঘটলো? কীভাবে ঘটলো? আমার স্মৃতিশক্তি বেশ প্রখর। ৭১ লাইভে তার বক্তব্যগুলো এখনও ক্রিস্টাল ক্লিয়ার স্মৃতিতে। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারে। এটাতে অবাকের কিছু নেই, কিন্তু একজন মানুষ রাতারাতি ডেভিলের অ্যাডভোকেট হয়ে উঠলো কিভাবে এটা মাথায় আসে না কিছুতেই।

পিনাকী ভট্টাচার্যর জন্ম ব্রাহ্মণ পরিবারে। বগুড়াতে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পড়েছেন বলে জানি। যতদূর জানি তিনি আওয়ামী ঘরানার ছাত্র এবং পরবর্তীতে পেশা জীবনেও তার চিন্তা মতবাদ স্বাধীনতার পক্ষে প্রকাশ করে গেছেন। আওয়ামী সরকারের আনুকূল্যে সুবিধাও কম নেননি শুনেছি। যদিও আমার কাছে তাকে বামপন্থি বলে মনে হতো। শুনেছি ওষুধের নামে তিনি ময়দা বিক্রি করে কোটি টাকা লোপাট করেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কিছু অসাধু আমলাদের সাথে একযোগে কোটি কোটি সরকারি টাকা লোপাট করেছেন। এগুলো নিয়ে অনেক লেখা ঘুরেছে অনলাইনে। আমি অন্যের কথা বিশ্বাস করা মানুষ নই। নিজের একটি বিচারবোধ কাজে লাগানোর চেষ্টা করি আগে। আমার অবাক হবার কারন কান কথা নয়, আমার বিস্ময়, তিনি কবে আধুনিক শিক্ষিত জঙ্গি অভিভাবক হয়ে উঠলেন সেটি।

হিন্দু ঘরে জন্ম নিলেই তিনি যে হিন্দু ধর্মগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হবেন এমনটি আমিও বিশ্বাস করি না। একজন লেখকের হরাইজন অবশ্যই অনেক বিস্তৃত হবে এবং সেটাই সঠিক বলে আমার অন্তত মনে হয়। তদুপরি জানা যায় তার জীবনসঙ্গী একজন মুসলিম ঘরে জন্ম নেওয়া নারী। নিশ্চয়ই তিনি ‘হিন্দু-মুসলিম’ এসব পরিচয় থেকে বেরিয়ে এসেই মানুষ পরিচয়ে জীবন যাপন করেন সেটা ধরে নেবো। কিন্তু সেই ‘মানুষ’ পরিচয় থেকে কিভাবে ভয়ানক ‘অমানুষ’ এ রূপান্তর ঘটলো সেটা নিয়ে কৌতূহল থাকতেই পারে, কিন্তু সেটা ডিগিং করার বিষয় অনন্ত আমার কাছে হয়ে ওঠেনি। এজন্য অনলাইন এবং সামাজিক মাধ্যমে তার লেখা ঘুরলেও আমি তাকে অনেকটা এ যাবত ফান হিসেবেই দেখেছি। মনে মনে বলেছি ‘খেলারাম খেলে যা!’ দেখা যাক কোথায় ঠেকে! কিন্তু সম্প্রতি বিষয়গুলো ফান ‘খেলা’ থেকে এক ‘ভয়ঙ্কর বিষয়’ উঠেছে। যা উদ্বেগের কারণ।

একটি অশিক্ষিত কট্টর জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে তরুণ এবং অনিশ্চয়তায় থাকা প্রজন্মের তাত্ত্বিক গুরু হয়ে ওঠার বিষয়টি এখন আর সাধারন পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই। উৎকণ্ঠা সেখানে।
কয়েকটি বিষয় পৃথক করা দরকার। দেশের উৎখাতকৃত বিপন্ন মাইনোরটিজ হিন্দু গ্রুপ। ১৯৭১ সালের আলবদর রাজাকার এবং তাদের অনুসারি। জামাত- যুদ্ধাপরাধী। আলকায়দা-আনসারুল্লাহ- হিজবুত তাহরীর- হেফাজত এ ইসলাম গ্রুপদের মত গ্রুপ এবং তাদের আইএস সংযুক্ততা। ইসলামি শিক্ষালয় মাদ্রাসা ও জঙ্গি উৎপাদন কেন্দ্র। এ বিষয়গুলো নিয়ে খেলাটা বিপজ্জনক ক্ষতিকর খেলা।

হিন্দু ধর্মের উৎপাটন সিস্টেমেটিক। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ থেকে শুরু হয়েছে। এলিট এবং জমিদার শ্রেণী রাতারাতি হিন্দুস্থানের বাসিন্দা হয়ে গেলেও সাধারন জনগণের জীবনযাপন স্বপ্ন ঘিরে ছিল তাদের পূর্বপুরুষের ভিটে মাটি ঘিরেই। তাদের প্রতি আঘাতের কিছু ধরন আছে। তাদের জমি এবং তাদের নারী। এ দুটো সংখ্যাগরিস্ট ক্ষমতাধরদের বারোয়ারী সম্পত্তির মত হয়ে গেছে। রাতের অন্ধকারে পানির দরে বাড়ি বিক্রয় করে বা দখলকৃত জমি মাঠ বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ভারত পাড়ি দেওয়া অব্যাহত ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর থেকে। এখনও চলছে। এবং এই সেক্যুলার আওয়ামীলীগের আমলে সবচাইতে বেশী ঘটেছে হিন্দুদের মন্দির মণ্ডপ ভাঙ্গা, জমি বাড়ি দখল।

১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরের পর জন্মভুমিতে ফিরে আসা অগ্নিদগ্ধ ভিটেতে আবার ঘর তুলে বসবাস শুরু করার স্বপ্ন ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেছে হিন্দুদের। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের মাধ্যমে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করার প্রভাব প্রশাসনে পড়েছে ভয়ানকভাবে। আমার নিজের দেখা, গ্যাং রেইপের শিকার হবার পর হিন্দু বাবা মেয়েকে নিয়ে থানা থেকে ফিরে এসেছে। থানা মামলা নেয়নি। মেয়েকে নিয়ে ভিটে বাড়ি ফেলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কোন এক রেলস্টেশনের বস্তিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এই অসহায় বিচার না পাওয়া গ্রুপের পাশে দাঁড়ানো যেকোন সচেতন মানুষের তার মানব জন্মের দায়। একটি কথা, পিনাকী তাদের পাশে না, ‘আলেম’দের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

আলেমদের পাশে দাঁড়ানো অন্যায় সেটি আমি যুক্তিবাদী মানুষ বলতে পারি না। কিন্তু একটি কথা মনে রাখতে হবে, আলেমরা এ জনপদের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সবচাইতে সুবিধাভোগী শ্রেণী। এবং আজ নয়, বহু বছর থেকে। ‘সংখ্যাগরিস্টের’ ধর্মের সকল সুবিধাপুস্ট তারা। এমন কি উদীয়মান জঙ্গি গ্রুপ প্রকান্তরে তাদের ছায়াতেই। আলেম শ্রেণী এ দেশের ‘বিপন্ন’ শ্রেণী নয়। পিনাকী ভট্টাচার্য কোন কারনে তাদের ‘অধিকার সংরক্ষণে’ বিশেষ প্রয়োজনীয়তা অনুভবে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন সেটি একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
তাতেও সমস্যা ছিল না। কিন্তু তার লেখালেখি আজ, প্রতিটি এনলাইটেন্ড ইতিবাচক বিষয়ের বিপরীতে অন্ধকার বিষয়ের পক্ষে। তার সকল লেখা এখন মুক্ত চিন্তার বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। বিপন্ন সংখালঘুদের বিরুদ্ধে। মুক্তচিন্তা হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে।

যখন অলরেডি অত্যাচারিত দুর্বল হিন্দু গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে একটি জঙ্গিমদপুষ্ট সাম্প্রদায়িক গ্রুপ, পিনাকী ভট্টাচার্য পক্ষ নিচ্ছে তাদের কাজের। একজন ভিক্টিম টিটু রায় একজন রসরাজের পক্ষ উনি নাইবা নিলেন। ধরে নিলাম তিনি ‘ধর্মের বিরুদ্ধে উস্কানির’ বিরুদ্ধে তাই তিনি বিশ্বাসি করেছেন যে রসরাজ টিটু রায় ‘ইসলামের বিরুদ্ধে’ উস্কানি দিয়েছেন সেটি অন্যায়। কিন্তু রসরাজ টিটুর জন্য এই যে সহস্র মানুষের ঘর গৃহস্থালি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিলো, প্রশাসন, পুলিশ চুপ করে থাকলো এবং এই মানুষগুলো এমনিতেই মানবেতর জীবন যাপন করছে বছরের পর বছর তাদের এই অবস্থা সৃষ্টিকারী কর্মকে তিনি কিভাবে ডিফেন্ড করতে পারেন? প্রকাশ্য মদদ দিতে পারেন? তিনি সেটাই করছেন করে যাচ্ছেন। ঠিক একইভাবে শফির মত একজন অর্বাচীনকে ‘আলেম’ আখ্যা দিয়ে মুক্তচিন্তার লেখাগুলো ছুঁড়ে দিচ্ছে এক্সট্রিমদের সেলে।

পিনাকী যখন স্বাধীনতা জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতের মতো অস্তিত্বের বিষয়গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে লিখে ছেড়ে দিচ্ছে তারা বুভুক্ষ ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো সেগুলো ভক্ষণ করছে, পুষ্ট হয়ে উঠছে অশুভ শক্তিতে। এবং এভাবে অসম্ভব শক্তিশালী এক্সট্রিমিস্ট বাহিনী তৈরি করে ফেলেছে পিনাকী ভট্টাচার্য। মুক্ত চিন্তা চর্চার ক্ষেত্রে একটি বড় অরাজকতা এবং সন্ত্রাস সৃষ্টি হয়েছে আজ। এখন কেউ কিছু লিখতে পারছে না অনলাইন এবং সামাজিক মিডিয়াতে। এই নেকড়ে বাহিনী খেয়ে নিচ্ছে তাদের আইডি, পোর্টাল। একটি বড় বড় সন্ত্রাস।

পিনাকী যদি স্রোতের বিপরীতে না গিয়ে আলাদা ধরনের কিছু লিখতে চান, আমি তাকে স্বাগত জানাবো। আমি মনে করি বিপরীত পারস্পেক্টিভ থাকা খুব দরকার। কোন একটি ইতিবাচক বিষয়ও যদি ক্ষমতাধরের কব্জায় আসে সেটি যত ইতিবাচক বিষয় হোক অপব্যাবহার হতে পারে। হয়। তিনি সে বিষয়ে একটি কণ্ঠস্বর হলে আমি তাকে সাধুবাদ জানাতাম। কিন্তু তিনি সেটি নন, তিনি দেশের একটি ভয়াবহ গ্রুপকে ইউনাইটেড করে তাদের নেগেটিভ শক্তি বৃদ্ধি করে তিনি শুধু মুক্ত মতামত এবং চিন্তার চর্চার বিরুদ্ধে একটি অত্যন্ত অপরাধী কার্যক্রমই শুরু করে দেননি, তিনি নিজের জন্যও তৈরি করেছেন একটি চোরাবালি। তিনি তাতে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছেন। সেখান থেকে উঠে আসা তার পক্ষে আর সম্ভব হবে না।

তিনি বুঝতে পেরেছেন এ অঞ্চলে মুসলমান মৌলবাদই একটি উদীয়মান শক্তি। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক এদের পায়ে তেল মর্দন ছাড়া কারও পক্ষে ক্ষমতা পোক্ত করা সম্ভব নয়। এরাই মূল শক্তি। পিনাকী এনালিসিস করে দেখেছেন, তার ক্ষমতা এবং শক্তি এখানে বাংলাদেশের যেকোন সরকারের থেকে শক্তিশালী। সরকার যাবে সরকার বদলাবে কিন্তু এদের ক্ষমতা কেবল বাড়তেই থাকবে। এবং এটাই তার সকল সাহসের মূল উৎস।

পিনাকী আমার কাছে এখানেই অসৎ, অসাধু এবং একটি ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের নাম। পিনাকী যদি শুধু অলক্ষ্যে পড়ে যাওয়া ‘আলাদা’ বিষয়গুলো সামনে আনার দিকটি নিয়ে লড়ার ভুমিকা নিতেন আমি তাকে অভিনন্দন জানাতাম। বলতাম, এ ধরনের চিন্তাশিল বুদ্ধিচর্চা আমাদের দেশে দরকার। কিন্তু সে এমন একটি গ্রুপকে উপজীব্য করে তার শক্তির বলয় গড়ে তুলেছেন যা দেশের মুক্ত বুদ্ধিচর্চা এবং গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।

শত শত আইডি পোর্টাল মিনিটের ভেতর উধাও করে দিচ্ছে টেকনোলজির সুবিধা বা দুর্বলতা নিয়ে। একটি বিশাল সেল গড়ে তুলেছে ইতিবাচক শক্তির বিরুদ্ধে। এর শেষ কোথায় আমি জানিনা। তবে যদি সবাই এ বিষয়ে একত্রিত হয়ে কিছু না করে তাহলে একে একে অনেকের সাহসী উচ্চারণের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। কারও একাউন্ট বা পোর্টাল একদিন, একমাস, চিরদিনের জন্য বন্ধ হওয়ার এই প্রসেস বন্ধ করতে না পারলে কার এবং কাদের জয় সেটি ভেবে দেখার যে সময় এসেছে। সেটি ভেবে দেখার জন্য ইতিবাচক শক্তির প্রতি আহবান জানাবো।

আর পিনাকী ভট্টাচার্য, আপনাকে বলবো, একমাত্র পিশাচের বিবেক থাকেনা। মানুষের বিবেক থাকে! আমি জানি আপনি যে মাঠে কাজ করছেন সেটি আপনার ঠাণ্ডা মাথার সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। আপনার ভেতর একটি কদাকার উল্লাস কাজ করে এ ‘খেলায়’। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি সব ‘খেলার’ শেষ আছে। ‘গেম ওভার’ আছে। আমরাও আপনাকে দেখছি আগ্রহ নিয়ে। মনে রাখবেন, কেউই দিনশেষে বিবেক এবং বিচারের ঊর্ধ্বে নয়!

শেয়ার করুন: