সত্য ঘটনা–২

রীমা দাস:
আমি একজন প্রতিষ্ঠিত নারী। ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ে চাকরি করি। বর ব্যবসায়ী। দু’জনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি প্রাপ্ত। প্রায় ১২ বছর পর আমাদের বিবাহিত জীবনে আলো হয়ে আসলো আমার নয়নের মনি, আমাদের ছেলে। বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ির সবাই ‘আলো’কে পেয়ে দারুণ খুশি, সাথে আমরাও।

আলো’র জন্মের আগের বছরগুলো আমাদের কাছে ১২ যুগের মতো ছিলো। অন্ধকারাচ্ছন্ন পথের শেষে আমাদের জীবনে আলোর ঝরণা ধারা, কাঙ্খিত আলো এলো। আলোর সরু রেখা যখন আমরা দেখতে পেলাম, তখন থেকেই আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলাম আমাদের অনাগত সন্তানকে সুস্থ পরিবেশ, সুস্থ দেহ ও সুস্থ মন দেবার।

আমার ছেলের নাম আলো। বাবার মতো দেখতে হয়েছে সে, মনকাড়া চেহারা। আমার ছেলে বলে বলছি না, আলো’কে দেখে কেউ আদর না করে পারেই না। বাসার সবার নয়নের মনি, আমার আলো সবার আদর ভালোবাসায় বড় হচ্ছে। আমার সবচেয়ে প্রিয়জন আমার মা ও শাশুড়ি মা’র কাছে আলোর ছেলেবেলা কেটেছে। এই দুজন প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ববান মানুষের কাছে আমার ছেলের হাতেখড়ি।

আমার দুষ্টু পাখি যেরকম রূপবান, সেরকম মেধাবীও। মাত্র ৫ বছর বয়সেই সে রবি ঠাকুরের “বীরপুরুষ”; “লুকোচুরি ” কবিতাগুলো মুখস্থ বলতে পারতো। আমি মুগ্ধ চোখে আমার আত্মজকে দেখতাম। আমার শাশুড়ি রাগী রাগী কন্ঠে বলতেন–” বেশি বেশি তাকিও না, নজর লাগবে”।  মায়ের নজর কী করে সন্তানের গায়ে লাগে তা আমার বোধগম্য নয়। আমি তর্ক করি না, মিটিমিটি হাসি মা’র কথা শুনে। পাড়ার সবাই, আমার অফিসের সবাই, এমনকি ওর পরিচিতজনের কাছে আলো খুব জনপ্রিয় ও আদরণীয়।

হঠাৎ আমার আনন্দময় সংসারে দুর্যোগ দেখা দিল।  শাশুড়ি মা’র মারা যাওয়া এবং আমার বদলিজনিত কারণে আমরা দিশেহারা অবস্থায় পড়লাম। আমার মা’র কাছে ছেলে রেখে দূরের জায়গায় একা অফিস করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আমার নয়নের মনি ছাড়া আমি থাকবো, সেটা আমি কল্পনাও করি না। অগত্যা ছেলেকে নিয়ে আমার নতুন বদলি স্থানে যাওয়া। আমাদের মা- ছেলের সংসারে সপ্তাহে সপ্তাহে তার বাবার আগমনে ঘরে ভ্রমর গুঞ্জন করে। আমরা উন্মুখ হয়ে থাকি তার আগমনের প্রতীক্ষায়।

আমার আলো স্কুলে যায়। আমি তাকে স্কুলে দিয়ে আসি। অফিসের কর্মচারিরা যে যখন ফ্রি থাকে তাকে নিয়ে আসে অফিসে। আর আমরা মা- ছেলে অফিস শেষে ধীরগতিতে বাসায় যাই, রান্না করি, খাই, ঘুমাই, মাঝে মাঝে ডিগবাজি, হুটোপুটি খেলা খেলি। এই ছিল আমাদের দৈনন্দিন জীবন। দিনশেষে আমি খুব ক্লান্ত থাকতাম, কিন্তু আমার আলোর ছোঁয়ায় আমার মিষ্টি পাখিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেই আমার সব ক্লান্তি দূরে চলে যেত।

গ্রীষ্মের এক পড়ন্ত সন্ধ্যায় আলোর বাবা একজন মাঝ বয়সী বিধবা মহিলা নিয়ে বাসায় এলো। আমি মহিলাকে দেখে আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। সে রাতে আমরা তিনজন খুব আনন্দ করলাম। কে জানতো, সেদিন আমার ঘরে শনি ঢুকেছিলো!

আমাদের কর্মব্যস্ত জীবনে কিছুটা স্থিরতা দেখা দিল। আলোর খাওয়া, রেডি হওয়া সব দায়িত্ব নিলো তার বুয়া আন্টি, নতুন কাজের মহিলা। আমি আলোকে স্কুলে দিয়ে আসি। সে আর এখন অফিসে আসে না, সরাসরি বাসায় চলে যায়। আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত বুয়াকে পেয়ে। এই বিশ্বাসবোধে আমার ছোট্ট পাখি সোনার দিকে খেয়াল কমে আসে। আমি খেয়াল করিনি পাখি আমার শুকিয়ে যাচ্ছে, আমি খেয়াল করিনি আমার পাখির চোখে চঞ্চলতা হারিয়ে যাচ্ছে, আমি খেয়াল করিনি আমার ছোট্ট পাখির চোখে রাজ্যের ভয় বাসা বাঁধছে। আমার জীবনে আরাম প্রবেশের সাথে সাথে মা-ছেলের মাঝে যে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে সেটাও আমার নজরে আসেনি।

যে আমি আলোর গায়ের গন্ধ ছাড়া ঘুমাতে পারতাম না, সেই আমি কী অবলীলায় আমার ছোট্ট আলোর দায়িত্ব একজন অপরিচিত বুয়ার উপর ছেড়ে দিলাম– সেটা বুঝলামই না! নিজের মধ্যে ফিরে এলাম আমার অফিসের টি-বয় সবুজের কথা শুনে। সবুজ আমার ছেলেকে খুব ভালোবাসে। আলো যখন স্কুল থেকে অফিসে আসতো, তখন তার বেশির ভাগ সময় কাটতো সবুজের সাথে। সবুজ আলোর কথা মুগ্ধ হয়ে শুনতো। আলো পেয়েছিল একজন একনিষ্ঠ শ্রোতা। তার ছোটো ছোটো জ্ঞান সে সবুজ আঙ্কেলকে উজাড় করে দিত।

সেই সবুজ আমার মনের চোখ খুলে দিল। কিছুদিন আগে সবুজ আমার রুমে অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি প্রশ্ন করলে সে উত্তর দেয়নি। সেদিন সে প্রায় ৫/৬ বার অকারণে আমার রুমে এলো, দাঁড়িয়ে থাকলো ও চলে গেলো। আমার ইন্দ্রিয় আমাকে সজাগ করে দিল, আমি বুঝতে পারলাম, সবুজ কিছু বলতে চাইছে। অফিস টাইম শেষে ডেকে নিলাম সবুজকে– ” কী বলতে চাও নির্ভয়ে বলো, আমি কিছু মনে করবো না”।  আমার চোখে বা কন্ঠে কী নির্ভরতা ছিলো, জানি না। সবুজ ছলছলে চোখে, কান্না ভেজা কন্ঠে বললো–” আলো আঙ্কেলের কিছু হয়েছে, তাকে সময় দেন ম্যাডাম”।
আমি বাকরুদ্ধ, আমার মাথায় সম্পূর্ণ আকাশ ভেঙ্গে পড়বে যেন। আমার চোখের মনি দিশেহারা হয়ে দিকভ্রান্তের মতো ঘুরছে, আমার হৃদস্পন্দন আটকে যাচ্ছে। আমি মনে করতে চেষ্টা করলাম, লাস্ট কবে আমি আমার পাখিকে বুকে নিয়েছি, কবে আমার পাখি সোনার গায়ের গন্ধে বুঁদ হয়েছি। হায়! আমি মনে করতে পারছি না। দিশেহারা লাগছে। নিজের ভেতরের সমস্ত উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করে সবুজের কাছে জানতে চাইলাম —
” কিছু বলেছে তোমাকে?”

সে উত্তর দিলো–” বাসা তার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না, আপনাকে ছাড়া তার থাকতে ভালো লাগে না।”
আমি সবুজের নির্ভেজাল ভালো কথায় শান্তি পেলাম না। বেশি বয়সের মা আমি, সেজন্য প্রায়ই ভয়ে থাকি যদি নিজের সত্ত্বাকে ভালোভাবে মানুষ করতে না পারি। সবুজের কথায় বুকের ভেতর ভয়েরা ডানা মেললো। আমি আমার প্রাণ ভ্রমরা, প্রাণ পাখিকে কতোদিন আদর করি না!

দ্রুত সব কাজ গুছিয়ে ফিরলাম বাড়ি। সতর্ক দৃষ্টি চারদিকে। আমার আসার খবর পেয়েও আলো ছুটে এলো না। আমি ফ্রেশ হয়ে তার ঘরে গেলাম। আলো, আমার আলো সোনা, যে আমার অন্ধকার দূর করেছে, সেই এখন অন্ধকারে বসা। মা এগিয়ে গেলো ছেলের কাছে, কোলে নিল। আমার ছোট্ট ভুতু সোনা এই স্পর্শের,  এই মমতার অপেক্ষায় ছিল হয়তো, সে তার কচি দু’হাত দিয়ে মা’কে শক্ত করে ধরে রইলো। আমার ছেলে কাঁদছে, কিন্তু শব্দ হচ্ছে না।

এমন সময় বুয়া ঘরে হাজির, লাইট জ্বালাতে চাইলো সে। আমার পাখি ভয় পাচ্ছে, মা’র সাথে মিশে যাচ্ছে। মা’র কানে মুখ নিয়ে চাপা স্বরে বলছে– আলো জ্বালাতে না করো মা। আমি সাথে সাথেই বুয়াকে আলো জ্বালাতে না করলাম। তাকে কাজ বুঝিয়ে দিলাম। কিন্তু বুয়া আমাদের পেছনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। আর সেই সময়টুকু আমার আলো ভয় পাওয়া পাখির মতো ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে লাগলো।

আমি আজ আমার সম্পূর্ণ মাতৃত্ব নিয়ে, আমার সতর্ক দৃষ্টি, সতর্ক ইন্দ্রিয় নিয়ে বাসায় এসেছি, তাই আমি বুঝতে পারছি আমার সুখের ঘরে অশুভ ছায়া আছে। এই অনুভূতি আমি বুঝতে দিলাম না। যথেষ্ট শান্ত থেকে বুয়ার কাজ তদারকি করলাম, ও ছেলেকে নিয়ে পড়তে বসালাম। আজ আমার সম্পূর্ণ মনোযোগের কেন্দ্রতে আমার আলো, আমার ছোট্ট পাখি সোনা। আমি তাকে দেখছি, আর আমার বুক ফেটে কান্না আসছে। আমার পাখির চোখে চঞ্চলতা নেই, সে মা’র গা ঘেঁষে বসে আছে। মা’র আঙ্গুল নিয়ে খেলছে, কিন্তু একবারও ডিগবাজি ডিগবাজি খেলার বায়না করছে না।

রাতে ছেলের মাথায় বিলি কেটে ঘুম আনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ছেলেটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার রক্তের স্পন্দন তার কচি দু’হাত দিয়ে মা’কে জড়িয়ে রেখেছে। মা নীরবতা দিয়ে কথা বলছে, স্পর্শ দিয়ে দিচ্ছে নির্ভরতা।এভাবে কিছুক্ষণ কাটার পর আমার বাবুই পাখি কবিতা শুনতে চাইলো। আমি অনুভব করতে পারলাম আমার পাখি, ছোট্ট সোনা স্বাভাবিক হচ্ছে।

আমি আবৃত্তি করলাম— খোকা মা’কে শুধোয় ডেকে, এলেম আমি কোথা থেকে, কোনখানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে …..।কবিতার পাশাপাশি তাকে ব্যাখ্যা করে বুঝালাম। বুঝালাম “মা” পরম নির্ভরতার স্থান। মা সন্তানকে দশ মাস, দশ দিন গর্ভে ধারণ করে রাখেন। মায়ের হৃদস্পন্দন সন্তানের সবচেয়ে পরিচিত শব্দ। হৃদয় দিয়ে মা সন্তানের সাথে কথা বলেন। কথাগুলো যখন বলছিলাম ছেলে তখন মা’র বুকে কান পেতে হৃদস্পন্দন শুনতে লাগলো। আমি বুঝলাম, আমার হৃদপিণ্ড আমার প্রাণ ভ্রমরাকে নির্ভরতা দিয়েছে।

সারারাত নির্ঘুম কাটালাম। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ছেলেকে চাপ দিয়ে কথা বের করবো না। ভোরের নরম আলোয়, নতুন সকালে কখন ঘুমিয়েছি জানি না। চিৎকারে ঘুম ভাঙলো, তন্দ্রার মধ্যে শুনতে পেলাম আমার পাখির ভয় পাওয়া কন্ঠ। চোখের ঘুম নিমিষেই উধাও। শুনতে পাচ্ছি ছেলে বলছে– আমি মা’র কাছে গোসল করবো, তুমি আমাকে ধরবে না। তারপর ফোঁসফোঁস শব্দ।

আমি উড়ে গেলাম। আমার ভয়ার্ত পাখি মা’কে পেয়ে তার ডানার ভিতর লুকালো। চোখ পড়লো বুয়ার দিকে, তার চোখে-মুখে হিংস্রতা। আমি আজ নতুন আমি, সেই হিংস্রতাকে পাত্তা না দিয়ে আমার বাচ্চাকে কোলে নিলাম, গোসল করালাম। আমার ছেলে মায়ের আদর পেয়ে বলে উঠলো–  “তুমি কত সুন্দর করে গোসল করাও মা, আর ঐ পচা বুয়া আমাকে শুধু ব্যথা দেয়। আমি আর বুয়া খালার কাছে থাকবো না মা”।

ঝরণার জলের ধারা মা-ছেলেকে ভিজিয়ে দিচ্ছে আর মা তার চোখের জল লুকাচ্ছে ঝরণার জলে।

আমার জীবন বৃথা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কী হবে এতো বৈভব আর বিত্ত দিয়ে? একটা দুধের শিশুকে নিরাপত্তা দিতে পারছি না আমি। আলোর রেখার শুভাগমনে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, নিজের মনে তা রাখতে পারছি না বলে নিজেকে ধ্বিক্কার দিচ্ছি। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নতুন আমি আবার শপথ করলাম আলোকে সুস্থ পরিবেশ দেবো।

আমার শান্ত, সৌম্য ছোট্ট পাখি মায়ের আদরে ফিরে এলো স্বাভাবিক জীবনে। এর ফাঁকে ফাঁকে জানলাম লোমহর্ষক কাহিনী। কাজের বুয়াকে বিদায় দিলাম। সবুজের হাত ধরে কৃতজ্ঞতায় মাথা নু’য়ে ফেললাম। এই সবুজ আমাকে সতর্ক করেছে। হয়তো সবুজ নিজেও এরকম নির্যাতনের শিকার। হয়তো সবুজ আরো ভয়ংকর পরিবেশের মধ্য দিয়ে গেছে। ভাবতে চাই না এসব।
আমার বাবাই পাখিকে আমি আগের মতো পাচ্ছি, এ আনন্দে আমি আত্মহারা। এখন আমি আমার আলোক পাখি, বাবাই সোনাকে পৃথিবীর এসব ভয়ংকর মানুষের মুখোশ উন্মোচন করা শেখাবো। তাকে শেখাবো মা পরম নির্ভরতার স্থান। যা ভালো লাগছে না, তা মা’র সাথে শেয়ার করা। মা সন্তানকে আগলে রাখে সব সময়, যেরকম রেখেছিলো জন্মের আগের দশ মাস দশ দিন। মা আর সন্তানের বন্ধন সূর্য আর পৃথিবীর বন্ধনের মতো। আমার আলো যখন আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে, চুমু খায়, আমার মনে হয় আমি স্বর্গে আছি।

পৃথিবীর সকল শিশুর জন্য আমরা নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তুলি। সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা।

শেয়ার করুন: