“চেয়েছিলাম হিস্যা, হয়ে গেলাম বেশ্যা”

সালমা লুনা:

“চেয়েছিলাম হিস্যা
হয়ে গেলাম বেশ্যা”
এই শ্লোগানই তো উঠেছিলো গতকাল মানিক মিয়া এভিনিউতে, নাকি?
আর কোন শ্লোগান উঠে নাই?
সেগুলো আপনার কানে পৌছোবে না জানা কথাই। তাই এই শ্লোগান নিয়েই কথা হোক।

অসংখ্য ফুলস্লিভ হাফস্লিভ ব্লাউজ আর শাড়িপরা নারী, সালোয়ার কামিজ হিজাব পরা নারীদের কণ্ঠ একসাথে প্রবল আক্রোশে ঘৃণায় প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলো। আপনি শুধু দেখলেন স্লিভলেস ব্লাউজ পরিহিতা, উর্ধাংশ বেশিরভাগই অনাবৃত দুই নারীর শ্লোগান।
আমি এবং আমরা দেখলাম চা বাগানের নারী শ্রমিক, গার্মেন্টের নারী শ্রমিক, আদীবাসী মেয়েটি, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আমার সন্তানের বয়সী অসংখ্য মেয়ের কণ্ঠে নানারকম প্রতিবাদ।
আপনার সন্তান যে অপরাধ সে করেনি সেজন্য তাকে কখনো বকা দিয়েছেন তুই একটা শয়তান বা আরো কিছু বলে? আপনার প্রতিবাদী সন্তান কি তখন রাগেদুঃখে চোখভরা জল নিয়ে তেতে উঠে বলেছে, হ্যা ভালো হইছে আমি শয়তানই!
অথবা আপনি নিজেও সেই বয়সে প্রতিবাদী হয়ে আপনার প্যারেন্টসের সাথে এমন করেননি? আমি করেছি। তাই আমি জানি মানুষকে সে যা নয় তা বললে ক্ষেপে যায়। ক্ষেপে গিয়ে সে বলে বসে হ্যা হ্যা আমি তাই।
এই শ্লোগানটি তেমনই।
মেয়েরা রাস্তায় নিরাপদে চলতে চায়। তারা চায় রাস্তায়, ভীড়ে, বাসে, শপিং মলে, অন্ধকার ঘরে কেউ তার শরীরে অযাচিত স্পর্শ না করুক।
একজন কর্মজীবী নারী চায় তার চলাফেরার স্বাচ্ছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরতে। তার কী পরা উচিত কী পরা উচিত নয় তা নিয়ে কেউ পথ চলতে বাজে মন্তব্য না করুক। তার বস কিংবা সহকর্মী তাকে যৌনগন্ধী কথাবার্তা না বলুক। তার কাজের জায়গা তার জন্য একটা নিরাপদ স্থান হোক।
যে কোন বয়সের নারী একাকী চলাফেরা করলে, টিপ দিলে, চুড়ি পরলে, হাহা করে হাসলে, যাদের সঙ্গ ভালো লাগে তাদের সাথে আড্ডা দিলে আত্মীয়পরিজন তাকে মনে করিয়ে না দিক -এই বয়সের এসব করা বারণ, ওটা করা উচিত নয়। সমাজ তাকে নিয়ে বাজে ইঙ্গিত না করুক।
শ্রমজীবী নারীটি চায় সে চা বাগান গার্মেন্টস ক্ষেতে মাঠে যেখানেই কাজ করুক সমান কাজে সমান কর্মঘন্টায় সে তার পুরুষ সহকর্মীর সমান মজুরি পাক।

ঘরের গৃহিনী চায় তাকে কাজেকর্মে তার সংসারের বাকি লোকজন একটু সামান্য করে হলেও সাহায্য করুক। যে সংসার সবাইকে নিয়ে গড়ে উঠেছে সেখানে কাজেরও একটা সমতা থাকুক। তার কাজের প্রশংসা শুধু গুটিকয় স্তোকবাক্য দিয়ে নয় তার ভার লাঘব করে করা হোক।
স্বামীহারা কিংবা বাবা মা হারা মেয়েটি চায় তার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি থেকে তাকে কেউ বঞ্চিত না করুক।
পাহাড়ি মেয়েটি চায়, পাহাড় তার ঘর তার নিরাপদ ছাদ। সেখানে সে ধর্ষিত অপহৃত না হোক।
প্রতিটা মা চায় তার কন্যা নিরাপদে ঘরের বাইরে যাক, নিরাপদে ফিরে আসুক। তাকে যেন ভাবতে না হয়, দিনকাল ভালো নয়, কখন কী হয়ে যায়!

আসলেই দিনকাল ভালো নয়।
এইসব চাওয়াগুলো আসলে নারীর প্রাপ্য খুবই ন্যায্য অধিকার। নারীদের খুব স্বাভাবিকভাবেই পাওয়ার কথা। ঠিক যেমন একজন পুরুষ পায়। অথচ এই ন্যায্যতা পেতে তাকে চাইতে হয়।
একবার নয় বারবার চাইতে হয়।

কার কাছে চাইতে হয়?
কখনও পুরুষতান্ত্রিকতার মোড়কে ঘেরা রাষ্ট্রের কাছে, কখনো প্রতিষ্ঠানের কাছে, সমাজের কাছে, পরিবারের কাছে, ব্যক্তির কাছে। কারণ এরাই নারীর ন্যায্য প্রাপ্যতার পথে বিরাট প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
নারী যখন তার স্বাভাবিক প্রাপ্য অধিকার পায় না। সে তখন আওয়াজ তোলে তার প্রাপ্য অধিকার পেতে। সে আওয়াজও যখন পুরুষতন্ত্রের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে তখন নারী প্রতিবাদী হয়। চিৎকার করে জানান দেয় আমি সাম্যতার ভিত্তিতে আমার অধিকার চাই।
আর ঠিক তখনই সকলে মিলে প্রতিবাদী নারীকে ট্যাগ দেয় বেশ্যা বলে। বেশ্যারাই উঁচু গলায় কথা বলে, বেশ্যারা সকলের সামনে এসে নিজেদের কথা বলতে চায়, পুরুষের সমান হতে চায় ইত্যাদি বলে নারীকে দমিয়ে রাখতে চায়। যাতে সমাজের চোখে বেশ্যা বলে হীন প্রমাণ করতে চাইলে নারী চুপ হয়ে যায়।

সমাজে বেশ্যা একটা গালি, এই পেশাটিও ঘৃণিত। তাই এই গালি দিলে মেয়েরা আর মুখ খুলবে না বলেই তারা ভাবে।
কিন্তু এখানে মেয়েরা দমে যায় না।
তারা এই গালিকে হজম করে ফেলে না। তারা গালিবাজদের মুখের উপর থুতু দেয়ার মত করে গালিটি উগড়ে দেয়। আর পরিষ্কার বলে দেয়, চাইলাম হিস্যা, হয়ে গেলাম বেশ্যা।

কাজেই হে রাষ্ট্র, হে সমাজ, ওহে পরিবার, ওগো পুরুষ, ঘরে বাইরে কর্মক্ষেত্রে নারীর হিস্যা বুঝিয়ে দেন।
নইলে শুধুমাত্র শ্লোগানরত মেয়েদের আংশিক অনাবৃত শরীর দেখাতে গিয়ে আপনারাই উদোম হয়ে পড়বেন খুব শিগগির। অতি শিগগির।

শেয়ার করুন: