আমার শাশুড়ি আমার বান্ধবী

কামরুন নাহার:

সেদিন শাশুড়ির কোলে মাথা রেখে শুয়ে খুব মন খারাপ করে ফিল্মি আমি (পুরাটাই অভিনয়, ভেতরে ভেতরে হেসে ফেটে পড়ছি) বললাম, “আম্মা আমার যদি বাচ্চাকাচ্চা না হয়, যদি বংশের প্রদীপ দিতে না পারি, আপনি কী আপনার ছেলেকে আর একটা বিয়ে করাবেন”?
আমার কান্নাকান্না মুখ দেখে উনি হেসে দিয়ে বলেন, “আরে পাগল আরেকটা বিয়ে করাতে হবে কেন”? আমি বললাম “সিরিয়ালে তো করায়, সিনেমাতেও করায়” ! উনি বলেন, “আমি আর তুই তো সিরিয়াল সিনেমার বউ-শাশুড়ি না , বাস্তবের”।

আমি বললাম, “না আম্মা, আপনি প্লিজ আপনার ছেলেকে আর একটা বিয়ে করিয়ে দেবেন; আমি পায়ের উপর পা তুলে আরাম করবো, আর সতীনকে দাসীর মতো খাটাবো; আপনার ছেলের ছোট বিবি হবে আমার দাসী”।
আমার কথা শুনে আমার শাশুড়ি যে হাসিটা হেসেছিলেন, সেটা দেখার মতো। আমরা যে আসলে ভালো বান্ধবী সেটা বোঝানোর জন্যই এই গল্পটা বলা । কিন্তু আমার বিরুদ্ধে আমার শাশুড়ির একটা ছোট অভিযোগ আছে, আর সেটা খুব ভ্যালিড অভিযোগ। আমি ফোন দিয়ে ওনার খোঁজ নেই না। আমি আমার মায়ের খোঁজও নিতাম না, এবং আমার মায়েরও একই অভিযোগ ছিল। থাক কিছু অভিযোগ, আমার ভালো লাগে ।

বিয়ের পর আমি কিছু নতুন সম্পর্কের সাথে জড়িয়েছি। সম্পর্কগুলো নতুন এবং সারা জীবনের। বাংলাদেশের (প্রতিবেশী অনেক দেশেরও) সংস্কৃতিতে সবচাইতে স্পর্শকাতর যে সম্পর্ক, তা হলো বউ-শাশুড়ি আর ননদ-ভাবী সম্পর্ক (বলা হয়ে থাকে)। নিজে কোনো পরিবারের বউ বা কারো ভাবী হবার আগে আমি ননদ হয়েছি ; তখন ননদ ভাবীর সম্পর্কটাকে বুঝতে শিখেছি। আর এখন নিজে ভাবী হবার পর (যদিও আমি কারো ভাবী আক্ষরিক অর্থে নই, কারণ আমার ননদও বয়সে আমার বড়, কিন্তু সম্পর্কের সুত্র ধরে আমি ভাবী) ননদ ভাবীর সম্পর্কটাকে বোঝার চেষ্টা করছি।

চেষ্টা করছি শাশুড়ির সাথেও সম্পর্কটা বোঝার এবং সেটাকে পূর্ণ ইতিবাচকভাবে ধারণ করার। আমার ধারণা এই জায়গায় আমরা দুইজনই পাশ করে গেছি যদিও কিছু নম্বরে উনি এগিয়ে আছেন।

সারাজীবন বউ-শাশুড়ি সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা শুনে এসেছি, দেখেছিও এবং এখন নিজে সেই সম্পর্কে জড়িয়েছি । আমার মা শাশুড়ি ছিলেন, আমার ভাইবোনদের শাশুড়ি আছে। সেই সম্পর্কগুলো কমবেশি দেখেছি দূর অথবা কাছ থেকে। এই স্পর্শকাতর সম্পর্কগুলো নিয়ে যা বলা হয় তার সব যে সত্যি তা নয় আবার সব যে মিথ্যা তাও কিন্তু নয়। আসলে যে কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রেই সম্পর্কটাকে যত্ন করা খুব জরুরি। আমরা গাছে সকাল বিকাল পানি দেই, আগাছা পরিষ্কার করি, সার দেই কেন? দেই যাতে গাছটা সুস্থ সবলভাবে বেড়ে ওঠে, ফুল দেয়, ফল দেয়। অনেক যত্নের পরেই একটা গাছ সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠে।

মানব সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম। সম্পর্ক যাই হোক প্রেমিক-প্রেমিকা, ছাত্র- শিক্ষক , স্বামী-স্ত্রী , ননদ-ভাবী, বউ – শাশুড়ি , দেবর-ভাবী , শ্বশুর- পুত্রবধূ , মামী-ভাগ্নে , চাচা-ভাতিজা সব সম্পর্কেরই যত্ন দরকার । নিয়মিত জল হাওয়া, সার দরকার – তবেই না সম্পর্ক বেঁচে থাকবে বেড়ে উঠবে সুন্দরভাবে । মানবিক সম্পর্কের যত্নের উপাদানগুলো হোল পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ , মায়া-মমতা , সম্মানবোধ এবং সর্বোপরি ‘স্যাক্রিফাইস’ ও ‘কম্প্রোমাইজ’। আমি যখন আমাদের গুরু সাখাওয়াত আলী খান স্যারকে ফোনে বলছিলাম স্যার কাল আমার বিয়ে আমার জন্য দোয়া করবেন স্যার বলেছিলেন “ শোন মেয়ে বিয়ে হোল কম্পিটিশন অফ স্যাক্রিফাইসেস – দি মোর ইউ উইল ডু ইট ইউ উইল বি হ্যাপী”।

আপনি একটা সম্পর্ককে সুন্দর রাখবেন না অসুন্দর করে তুলবেন সেটা আপনার উপরই নির্ভর করছে। দেবর ভাবীর সম্পর্কের কেমিস্ট্রি দারুণ কিন্তু ননদ ভাবীর নয় এই মিথ ভাঙ্গার দায়িত্ব আপনার আমার হাতেই। একবার ভাবুন তো আপনার মা আপনার ভাইয়ের বউকে আপনার চেয়ে বেশি আদর ভালবাসা দিচ্ছে তখন আপনার কেমন লাগবে? যদি ভালই না লাগে তাহলে আপনি ছেলের বউ হয়ে কিভাবে আশা করেন আপনার শাশুড়ি আপনাকে তাঁর মেয়ের চেয়ে বেশি আদর ভালবাসা দেবে?
একদিক থেকে দেখতে গেলে এটাই স্বাভাবিক, এটাই প্রচলিত । কিন্তু এই প্রচলিত ধারাকে ভেঙ্গে ফেলার অস্ত্র আপনারই হাতে। আপনি আপনার শাশুড়িকে শাশুড়ি মানে আপনার প্রতিপক্ষ না ভেবে একবার ঠিক নিজের মা ভেবে দেখুনতো পরিবর্তে কী ফলাফল আসে? যে কোন এক পক্ষকে আগে ভাবতে হবে তো আপনিই না হয় ভাবুন!

আমি আমার শাশুড়ির কাছে বেড়াতে যাই যখন রোজ সকালে অফিসে যাবার সময় উনি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমায় হাত নাড়িয়ে বিদায় দেন। অফিসে পৌঁছলাম কীনা ফোন দিয়ে খোঁজ নেন , অফিস থেকে ফিরলে পরে চা বানিয়ে দেন – উনি এই কাজগুলো করেন কারন এই কাজগুলো উনি ওনার মেয়ের জন্যও করতেন। তার মানে সম্পর্ককে ধারন এবং সেটাকে যত্নের ক্ষেত্রে আমার শাশুড়ি আমার চেয়ে এগিয়ে, উনি আমাকে মেয়ে হিসেবেই নিয়েছেন, বউ হিসেবে না। উনি হাত নাড়িয়ে আমাকে বিদায় জানানোর সময় আমার জন্মদাত্রী মায়ের কথা মনে পড়ে। আমি যখন ঢাকায় ফিরতাম বাড়ি থেকে আমার মা গেটে দাঁড়িয়ে আমায় হাত নাড়িয়ে বিদায় দিতেন। আমার শাশুড়ির মধ্য দিয়ে আমার মা বারবার আমার কাছে ফিরে আসেন।

পৃথিবীতে খুব কম শাশুড়িই বউয়ের বন্ধু হয় আমার শাশুড়ি রীতিমত আমার বান্ধবী। ওনার সিরিয়াল দেখা নিয়ে আমার ওনার সাথে মধুর ঝগড়া হয় , আমি ওনার পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করি । একজন সিরিয়ালের বউ হবার যাবতীয় পন্থা আমি অবলম্বন করি মাঝে মাঝে কিন্তু কোন কাজ হয়না (যদিও আমি সিরিয়াল দেখিনা)। আমার শাশুড়ি আমার সমস্ত আচরণ হেসে উড়িয়ে দেন।

আমার এখনও স্যাক্রিফাইস বা কম্প্রোমাইজ কোনটারই দরকার হয়নি । জার্নিটা সবে শুরু হয়েছে, যখন প্রয়োজন হবে নিশ্চয়ই করবো । সম্পর্ক যাই হোক সেটাকে ধারণ, লালন-পালন আমাদেরই দায়িত্ব – দুই পক্ষেরই সেখানে ভূমিকা আছে। পৃথিবীর কোন মানুষই সম্পূর্ণ মানুষ না বা বলা চলে নির্ভুল না । সব মিলিয়েই মানুষ , আর সেই মানুষে মানুষে সম্পর্ক কিছুটা অম্ল – মধুর হবে সেটাই স্বাভাবিক। আসুন আমরা ভালবাসায় বাঁচি ।

কামরুন নাহার
সহকারী অধ্যাপক
বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট

শেয়ার করুন: