সুপ্রীতি ধর: আমাদের সোভিয়েত জীবন যে সবসময়ই হাসিখুশি, আনন্দ-বিনোদনে পরিপূর্ণ ছিল, তা কিন্তু না। খুব দু:খের দিনও গেছে আমাদের প্রায় সবার জীবনে। মাত্র ১৮-১৯ বছর বয়সে সম্পূর্ণ নতুন একটা দেশ, ভিন্নভাষী একটা সংস্কৃতিতে গিয়ে মানিয়ে নেয়া খুবই কঠিন কাজ ছিল। তার মধ্যে যে শহরে বাঙালী বেশি ছিল সংখ্যায়, সেখানে সমস্যাটা কম হয়েছে। ক্লাসের সময়টুকু ছাড়া তারা বুঝতেই পারেনি যে, দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে তারা আছে। কিন্তু যেখানে বাঙালী ছিল না, বা হাতেগোণা কিছুসংখ্যক ছিল, সেখানে ক্লাস থেকে রুম, রুম থেকে রাস্তা, সব জায়গাতেই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি আমরা দেশ কাকে বলে? ভাষা কাকে বলে? একটু বাংলা বলার জন্য, একটু বাংলা খাবারের জন্য কত দূরে দূরে আমরা চলে যেতাম। নিজের দৈনন্দিন রান্না বলতে তো এই এক ডিম।
মনে আছে মস্কোতে বেড়াতে এসেছিলাম যখন, সুস্মি বলেছিল, দেশে ফিরে গিয়ে আমি কখনও আর ডিম খাবো না, এতো ডিম খেয়েছি জীবনে। ওর সাথে ২০১০ সালে নিউইয়র্কে যখন দেখা হলো, জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ডিম খায় কিনা! ও জানায়, পারতপক্ষে খায় না। কিন্তু আমার এখনও খাওয়া হয়, হয়তো রান্নার বিপদের কারণেই। ডিম রান্না পৃথিবীর সহজ রান্না। রান্নার প্রসঙ্গই যেহেতু এলো, তাহলে একদিনের গল্প শেয়ার করি। সুস্মির হোস্টেলে থাকছি বেশ কদিন ধরেই। একদিন বাইরে থেকে একা রুমে ফিরে সুস্মিকে না পেয়ে দরজায় চিরকুট রেখে যাই। তখন আমরা বেশ মজা করে চিরকুট লিখতাম, এর ভাষা ছিল অনন্য। তো, একই হোস্টেলে থাকা রুমার রুম থেকে দু’একবার এসে দেখে গেছি সুস্মি ফিরলো কিনা! আরেকবার এসে দেখি চিরকুটটি নেই। মনে হলো সুস্মি এসেছে। কিন্তু কোথাও সে নেই। খোঁজ খোঁজ খোঁজ।
দেখি দূরে করিডরের এককোণায় একজন দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন। আমার দিকেই এগিয়ে এসে বললেন, তুমিই বুঝি লেনিনগ্রাদের লিপি? মুখে রা সরার আগেই আবারও বলেন, ‘লেখার ভাষা দেেখই বুঝেছি, এটাই তুমি। আমি মিঠু, খারকভের মিঠু’। অনন্য রায়হান মিঠু। বলেন, সুস্মিকে আমিও খুঁজছি। কথার মাঝখানেই সুস্মি এসে ঢোকে। হাতে বাজার। রুমে ঢুকেই মুরগি-ফ্রাইং প্যান, মশল্লাপাতি নিয়ে কিচেনের দিকে এগোয় সে, আমরা পিছু পিছু। এতোক্ষণ ধরে যে অপেক্ষা করছি, তাতে তার কোন বিকার নেই।
মিঠু ভাই মুরগিটা কেটেছিলেন সম্ভবত (এটা আর মনে নেই)। রান্নার পুরো দায়িত্বে সুস্মি, একপর্যায়ে দেখি দুধ ঢালছে সে মাংসে। করো কি, করো কি বলতেই হেসে বলে, আমার আম্মা এই রান্না শিখিয়েছেন। খেয়ে দেখো, ভালই লাগবে। বিস্ফারিত চোখে আমি নতুন পদ্ধতিতে রান্না শিখি। দুধ মেশানো মুরগির মাংস খেতে কিন্তু অপূর্বই হয়েছিল। এরপর থেকে আমি মুরগিতে দুধ-চিনি অনেককিছুই মেশাই :-)।
মন খারাপের কথা বলছিলাম আমি। মস্কোতে গেলে এতো এতো বাঙালীর ভিড়ে আমার মন কখনই খারাপ হতে পারতো না। এর হোস্টেল থেকে ওর হোস্টেলে ঘুরে বেড়াচ্ছি, দিন-রাতের তফাত বুঝতাম না। একবার বেড়াতে গিয়ে পাঁচদিন পড়ে রইলাম প্যাট্রিস লুবুম্বার সাত নম্বর হোস্টেলে। পাঁচদিন পর আমি আর সুস্মি ভাবলাম, এবার একটু রুমে ফেরা যাক। দুজনে রওনা হলাম প্লেখানভের উদ্দেশ্যে। হোস্টেলের গেইট পেরুতেই দেখা ক্রাসনাদার থেকে আসা জাহীদ রেজা নূর, বাবলা ভাই, সুশান্তদাসহ আরও অনেকের সাথে। কী ব্যাপার?
ব্যাপার তেমন কিছুই না, জাহীদ বিয়ে করবে। তারা সবাই বাংলাদেশ দুতাবাসে যাচ্ছে। আমরাও রুমে ফেরার কথা ভুলে তাদের সঙ্গে রওনা দিলাম। সুস্মিকে তার আম্মা একটা হলুদ রংয়ের সুতি শাড়ি পাঠিয়েছিলেন বেশ আগে। আজ নেব, কাল নেব ভেবে আর নেয়া হয়নি। সেদিনই সে ওটা নিয়ে রওনা হয়েছিল। দুতাবাসে যাওয়ার পর কিসব কাগজপত্রে আমাদের সবাইকে ‘সই’ করতে হলো। কেউ হলো উকিল মা, কেউ উকিল বাপ, আরও কত কী!
ওখানকার একজন অ্যাটাচে, বয়সে ভারী। ঊনি জাহীদের বউ খারকভে ডাক্তারি পড়তে যাওয়া শুক্তিকে দেখে মায়ায় পড়ে গেলেন। তিনি নিজেই বিয়ে পড়াবেন। তো, চলো তাঁর বাসায়। আবার আমরা সবাই দলবেঁধে মেট্রো হয়ে, দুটো বড় বড় কেক (সেইসময় মস্কোতে মিষ্টি ছিল না) নিয়ে, আর কিছু ফুল কিনে চললাম বিয়ে ‘পড়াতে’। বন্ধু জাহীদের বিয়ে বলে কথা!
সেই চাচার বাসায় যাওয়ার পর জিন্স পরা শুক্তিকে শাড়ি পরতে বলা হলো। সুস্মির সেই হলুদ-কালো শাড়িটা বহুদিন অবহেলায় পড়ে থাকার পর এবার মহৎ কাজে লাগলো। শাড়ি নাহয় হলো, কিন্তু ব্লাউজ-পেটিকোট? ওই অ্যাটাচে চাচার বউ বের করে দিলেন নিজের আলমিরা থেকে। আমি সুই-সূতা নিয়ে সেলাই করতে লাগলাম ব্লাউজ। তখনকার চিকনা শরীরের দুজন শুক্তি ওই ব্লাউজ গলিয়ে ঢুকে পড়ার কথা। শাড়িও পরানো হলো। চাচা জাহীদকে বললেন ওযু করে আসতে। জাহীদ ওয়াশরুমে গেল আর বের হলো। আমরা সবাই কার্পেটের ওপর বসে। দোয়ার জন্য হাত তুললাম। বাদ রইলাম না আমি আর সুশান্তদাও। হঠাৎ দেখি, জাহীদের পায়ে মোজা। হাসতে হাসতে আমার পেটে খিল ধরার অবস্থা। দোয়া-টোয়া শেষে জাহীদকে বললাম, তুই না ওযু করে এসেছিস, তাহলে মোজা কেন পায়ে? আমার প্রশ্ন শুনে চোখ বড় বড় করে বলে, মোজা খুলতে হয় নাকি! আমি আর কী বলবো! হাসির হুল্লোড় উঠে রুম জুড়ে।
সেইরাতে এমদাদ ভাইয়ের রুমে তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় আমাদের নানান কিসিমের আড্ডা। সেই আড্ডার চরিত্র বোঝা দায়। মধ্যরাতে মাছ আর মুরগি নিয়ে শুরু হয় রান্না। রাতভর গানে গানে আড্ডা এগিয়ে চলে, ভোররাতের দিকে সবাই নেতিয়ে এলে কোণাকাঞ্চি বের করে বিছানায়-ফ্লোরে সবাই ঘুমিয়ে যাই। স্পষ্ট মনে আছে, শুক্তির পরনে ছিল একটা লাল টি-শার্ট। ও আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভোররাতে জাহীদ সেই বিছানায় ওকে একটু সরিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। বাসর না হোক, এভাবেই একটি বিয়ের গল্প লেখা হয়। এরকম বহুত বিয়ে হয়েছে আমাদের সোভিয়েত জীবনে।
প্যাট্রিস লুবুম্বার ১০ নম্বর হোস্টেলও ছিল আরেক প্রাণকেন্দ্র। বাবুল ভাইয়ের রুম তখন জনারণ্যে ভরপুর থাকতো সবসময়। সেবারই মনে হয়, একদিন বাবুল ভাই চাল-মুগ ডাল বের করে দিয়ে বললেন, ‘লিপি, দেখি আপনি কত ভাল রান্না করতে পারেন। খিচুড়ি রাঁধেন।’ তখন কেউ রান্নার চ্যালেঞ্জ করলেই আমি ভয় পেয়ে যেতাম। শৌখিন রাঁধুনি আমি। কোনরকমে রেঁধে-খেয়ে প্রাণটা বাঁচিয়ে রেখেছি, সেইখানে এই চ্যালেঞ্জ? অগত্যা রান্নাঘরে যাই, চাল-ডাল ধুয়ে মোটামুটি ভালই একটা খিচুড়ি রাঁধি। সাথে মাংস। বাবুল ভাই কোথা থেকে যেন আচারও বের করেন খাওয়ার সময়। সবাই প্রশংসা করেন আমার রান্নার। অবশেষে, অবশেষে বাবুল ভাই বোমাটা ফাটান।
বলেন যে, ‘এই চাল এবং এই ডাল, এবং এই আচার সবই দেশ থেকে এসেছে বেশকিছুদিন আগে, এবং লিপির মা পাঠিয়েছিলেন। আজ লিপিই তা রান্না করে আমাদের খাইয়ে গেল’। আমি তখন হাসবো, না কাঁদবো, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমার মা কারও না কারও হাত দিয়ে সবসময়ই এরকম ডাল-চাল পাঠাতেন, কিছু সময় আমি পেতাম, কিছু জিনিস অন্য কারও পেটে চালান হয়ে যেত। ভাগ্য ভাল ছিল বলেই হয়তো সেবার নিজেই খেতে পেরেছিলাম।
সোভিয়েত জীবনে কেউ যদি দেশ থেকে কাঁচা মরিচ আনতো, তাহলে আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। কাঁচা মরিচ দিয়ে আলু ভর্তা মেখে খাওয়া চাই-ই চাই। একবার দেশ থেকে দিদি কাঁচা মরিচের আচারই দিয়ে দিয়েছিল। সেই নিয়েও কম কাহিনী নেই! সবাইকে দিতে দিতে আমার ভাগে এতোই কম ছিল যে, কান্না এসে গেছিল।
জাহীদের বিয়ের একবছর আগের গ্রিষ্মে আমরা বেশ মজা করে কাটিয়েছিলাম মস্কোতে। চোখের ডাক্তার মানস গোস্বামীর সাথে সেবার আমার পরিচয় বিমানবন্দরে। উনি চলে যাচ্ছেন, শুক্তিরা চোখের জল ফেলতে ফেলতে তাকে বিদায় জানাতে যাবে এয়ারপোর্ট। সারাদিন মানসদা, মিঠু ভাই, তপু, আমি আর শুক্তি মস্কো চষে বেড়ালাম আর ছবি তুললাম। শেষদিনে যার সাথে পরিচয় হলো, সেই পরিচয়ই দীর্ঘস্থায়ী হলো আমার। এখনও আড্ডার মধ্যমণি হয়ে থাকেন মানসদা।
আর সেই গ্রিষ্মেই জাহীদের সাথে পরিচয় হয়েছিল শুক্তির। পরে যা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। সেই পরিচয়ের সূত্রও ছিলাম আমি এবং আমরা কজনা। ভালই লাগে ভাবতে। আমি তখন লন্ডনে যাবো বলে মস্কোতে, জাহীদ দেশে যাওয়ার জন্য মস্কোতে। আর শুক্তি ছুটি কাটাতে মস্কোতে। তিনজন তিন শহরের বাসিন্দা। আমি আর শুক্তি উঠেছি মস্কোর কুমুর রুমে। তিনজনে মিলে পুরো সামার ছিল অভাবিত আনন্দের। সঙ্গে তপু ছিল, টিটো ভাই ছিলেন। তপু তো একটা ছবিই এঁকে ফেললো আমাদের তিনজনকে নিয়ে। ভোরবেলায় উঠে লন্ডনের ভিসা নিতে গিয়ে লাইন ধরি, প্রতিদিন তালিকা হয়, প্রতিদিনই পিছনে পড়ে যাই আফ্রিকানদের দৌরাত্ম্যে। পরে সারাদিন কাটিয়ে গিয়ে আবার সন্ধ্যায় পরের দিনের জন্য নাম তালিকাভুক্ত করে আসি। যন্ত্রণা আর কাকে বলে! এর মাঝেই আমি, কুমু আর শুক্তি মিলে অন্ধকার ভোরে হানা দেই বিভিন্ন হোস্টেলে। বন্ধুরা ভেবেও পায় না, এতো সকালে কেউ আসে কি করে! একদিন সেকেন্ড মেডিকেলে গিয়ে সুশীলকে ডেকে তুলে ওর বালিশের কাছে ফুল রেখে আসি, তারপরও সে বিশ্বাস করেনি ওটা আমরা ছিলাম। আরেকদিন ভোররাতে টিটো ভাইয়ের রুমে নক করি, ভিতর থেকে কে কে বলে ডেকে উঠে। কিন্তু দরজা খুলে কাউকে না দেখে আবার দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। আবার ঠক ঠক ঠক। দরজা খুলে কাউকে না পেয়ে এবার জাহীদই এগিয়ে আসে করিডরের দিকে। এসে শুক্তিকেই হাতেনাতে পায়। সেই থেকে আমাদের নাম দেয় ‘মহিলা ভূত’।
এর মাসখানেক পর শুক্তি খারকভ থেকে আমায় চিঠিতে লিখে, ‘লিপিদি, সেদিনের সেই ভূতই আমার ঘাড়ে চেপেছে, আমি চলে যাচ্ছি ক্রাসনাদার’। আমি পড়ি আর হাসি, অভিযানটা তাহলে বিফলে যায়নি একেবারে। কী বলেন? কিছু বুঝলেন?