নারীর শরীর ও তাঁর যৌনতা (পর্ব- ২)

শেখ তাসলিমা মুন:

নারীর শরীরের প্রতি পুরুষ পুরোহিতের ভীতি অতি প্রাচীন। এই সিরিজে আমার লেখার আজকের প্রতিপাদ্য বিষয় একটু ভিন্ন হবে। যেকোনো লেখা বা ভাবনার আগে তার গোঁড়ার কথা না ভেবে আমি সামনের দিকে এগোতে পারি না। এজন্য নারীর শরীরের সামাজিক বিপর্যয়ের গোঁড়ার কথাটি আমাদের বর্তমানকে বুঝতে সাহায্য করবে বলে আমি মনে করি।

সিমোন দ্য বোভোয়ারের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘কেউ নারীরূপে জন্ম গ্রহণ করে না, সে ক্রমশ: নারী হয়ে ওঠে’। অর্থাৎ নারীর লিঙ্গ যতোটা না বায়োলজিক্যাল, তার থেকে বেশি সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং আরোপিত। একজন নারীকে সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম এবং সংস্কৃতি ভেদে ভিন্ন ভিন্নভাবে গড়ে তোলা হয়। কল্পনা করে নেওয়া যাক, কোন কন্যা শিশু সন্তান যদি তার জন্মলগ্নে হারিয়ে গিয়ে কোন ভিন্ন জায়গায় পুরুষ বা পুত্র সন্তান পরিবেষ্টিতভাবে বড় হয়ে ওঠে, তার জৈবিক নারী শরীর নিয়েও সে কিন্তু তার পরিবেশের অন্য পুরুষ সন্তানের আচরণ নিয়ে বড় হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই বলা যায় নারীকে সো-কল্ড ‘নারী সুলভ’ আচরণ করতে শেখায় সমাজ। এবং অবশ্যই সে আচরণমালা সে সমাজের মানসকে প্রতিফলিত করে।

পৃথিবীর বিশাল অংশ আজও পুরুষতান্ত্রিক, আর তারাই ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, আইনের পুরোহিত মোল্লা। স্বাভাবিকভাবেই নারীকে ‘নারী’ করে গড়ে তোলার পেছনে তাদের ভূমিকাই মোক্ষম থাকে।
নারীর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বাইরে নারীর লৈঙ্গিক স্বকীয়তা নারীকে যে দিকগুলোতে পুরুষের থেকে আলাদা করেছে, সে নারীর শরীর। নারীর শরীর পুরুষের কাছে রহস্যে আবৃত এক দুর্বোধ্য অধ্যায়। বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের শুরু থেকেই নারীর শরীর পুরুষের কাছে যেমন প্রীতিকর, তেমনি ভীতিকর। নারীদেহ যেমন তাদেরকে আকৃষ্ট করেছে, করেছে একই সাথে করেছে বিদ্বেষপূর্ণ। শরীরের কলকব্জায় নারীর দেহ এবং এর ফাংশন যে পুরুষের থেকে আলাদা, এটা তাদের ভাবিয়েছে।

মূলত সে ভাবনা আজও বন্ধ হয়নি। নারীর ঋতুকাল এবং সন্তান ধারণ ক্ষমতা নিয়ে নানান গবেষণা দেখা যায়। কেউ কেউ বলেছেন, প্রাথমিকভাবে নারী যোনি থেকে নিঃসৃত রক্ত ভীতিকর বলে গণ্য করা হয়। তাদেরকে অপবিত্র গণ্য করে ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হয়। যার ধারাবাহিকতা আমরা এখনও কোন কোনও সমাজে দেখতে পাই। নারীর সন্তান ধারণকালকেও এর সাথে যুক্ত করে নারীকে শারীরিকভাবে দুর্বল করে দেখার মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। যেহেতু পুরুষ নারীর তুলনায় খর্বাকৃতির এবং শারীরিকভাবে পেশী শক্তিতে শক্তিশালী, তাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষকে সুপিরিয়র হিসেবে গণ্য করতে শুরু করা হয়, এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পত্তনের সূচনাকাল তৈরি হয়।

সমাজ পত্তনের আগে পুরুষ অরণ্য উপড়ে পশুর সাথে যুদ্ধ করে গোত্র তৈরি করেছে, এ ভূমিকা পুরুষকে সুপিরিয়র করেছে। বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে পুরুষ ধীরে ধীরে বুঝতে সক্ষম হয়েছে, দুর্বল কিন্তু বুদ্ধিমান পুরুষের কাছে একজন পেশীওয়ালা পুরুষকে মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে। তখন মানুষ বুঝেছে পেশীর শক্তি, শক্তির মাপে টিকে থাকতে পারছে না। বুদ্ধিবৃত্তির কাছে পেশীর হার অনেকাংশে হয়েছে এভাবে। কেবল নারী এখনও নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি পেশী শক্তির সুপিরিয়রিটি থেকে। এখনও একজন মেধাবী বুদ্ধিমান নারীকে পেশী শক্তিমান বা রুগ্ন পুরুষের কাছেও মার খেতে হয় পদে পদে।

একজন রুগ্ন মেধাহীন পুরুষ যে নেতৃত্ব পাচ্ছে, একজন সক্ষম মেধাবী নারী সে মর্যাদা বা নেতৃত্ব পাচ্ছে না। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা নারীর সাংস্কৃতিক লিঙ্গের মতো জৈবিক লিঙ্গ, শরীরকেও করেছে জবর দখল। নানানভাবে নারীর শরীরের অংশগুলোকে পাপ নিষিদ্ধ এবং ঘৃণার বস্তু করে তুলেছে। সামাজিকভাবে শিশু বয়সে একটি পুরুষ শিশুর অঙ্গ যেভাবে দেখা হয়, একই পরিবার এবং সমাজে একটি নারী শিশুর অঙ্গকে একটি লজ্জা, পাপ, ঘৃণা এবং নিষিদ্ধতার স্তুপে চাপা দেওয়া হয়। নারীর লৈঙ্গিক পরাজয় এভাবে সাধিত হয়েছে।

আগেই উল্লেখ করেছি, নারীর ঋতুকালের প্রারম্ভকে আজও একটি নিষিদ্ধ কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শহর বা গ্রাম আজও লক্ষ লক্ষ কিশোরী এ অব্যবস্থার শিকার হয়ে ধুঁকছে। অথচ এটি নারী শরীরের একটি অতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। পরিবারের নারী বা পুরুষ সকল সদস্যকে এটিকে স্বাভাবিকভাবে না নেওয়ার কোনো কারণ বা যুক্তি নেই। লক্ষ্যণীয় আজও শহর সোসাইটিতেই নারীর পিরিয়ডের প্যাড বিক্রয় অনেকটা নিভৃত এবং লজ্জা বস্তু হিসেবে সম্পন্ন করা হয়।

নারীর যৌন বিষয়টি তো চিন্তাই করা যায় না। নারী যে কেবল একটি শরীর বিড়ম্বনার নাম, সেটি বুঝে ও জুঝেই তাঁর জীবনকাল কাটে। শরীর যে একটি উপভোগের বিষয় সেটি তাদের ভাবনার ভেতরও থাকে না। অবাক হওয়ার কিছু নেই, আমাদের দেশের অধিকাংশ মেয়ের তাদের শরীরের সাথে কোন পরিচয়ই থাকে না। যেটুকুন ধারণা দেওয়া হয় সেটি কেবল পাপ, নিষিদ্ধতা, লুকিয়ে রাখা, ঢেকে রাখা ইত্যাদি হাজার রকমের ক্ষতিকর বিষয়। আমাদের দেশের কোটি কোটি মেয়ে আছে বছরের পর বছর সন্তান জন্ম দিয়ে যাচ্ছে নিজ শরীরের কিছু না জেনেই।

এমনকি শিক্ষিত সমাজের নারীও তার একটি বড় অংশ। বিবাহ প্রতিষ্ঠানে নারীর কাটে টিকে থাকার যুদ্ধে। এমনকি উচ্চ শিক্ষিত নারীর বড় অংশের কাছেও বিবাহে পারিবারিক। মানসিক বা শারীরিক চাহিদা যে একটি এখানে বিষয়, সেটি তারা যতটা সম্ভব সাপ্রেস করে জীবনযাপন করে যায় সারভাইভের প্রশ্নে। ‘ভালো’ বউ হবার যুদ্ধে নিজের চাওয়া-পাওয়াকে দমন করার প্রশিক্ষণ তাঁরা সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম ও পরিবার থেকে পেয়ে প্রশিক্ষিত হয়ে আসে। বিবাহে তাদের ইচ্ছে, চাওয়া, পাওয়া বা না পাওয়ার অসন্তোষ প্রকাশের কোনো সুযোগ থাকে না। নারীর শরীরের বঞ্চনার ইতিহাস তাই এমন পাহাড় সমান। কেবল নিছক জানার জন্যও নারীর শরীর ও তাঁর যৌনতা বিষয়ে লেখা যতটুকুন জরুরি হয়ে পড়ে, সেটি লিখতে গেলেই লেখকরা বিশেষ করে তিনি যদি একজন নারী হোন, তাকে এতো বেশি নিন্দিত এবং আক্রমণের শিকার হতে হয় যে বেশির ভাগ সময় তারা লেখা থেকে বিরত থাকেন।

মজার বিষয় সাহিত্যে নারী দেহের বর্ণনা এবং যৌন বর্ণনা সব সময়ই পুরুষ লেখকের করেন। তারাই তাদের কল্পনা এবং চাহিদা অনুযায়ি নারী দেহকে সাহিত্যে আঁকেন। নিজেরা যৌন তাড়িত হন এবং পাঠকদের যৌন তাড়িত করেন তাদের রগরগে বর্ণনায়। কিন্তু একই বিষয়ে যদি একজন লেখক যিনি নারী, তিনি লেখেন এবং তাঁর সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসি এবং চাহিদাকে লেখেন, তখন তা অশ্লীল এবং পাপ হয়ে ওঠে। এমনকি তা নিষিদ্ধ করতেও পুরুষ রাষ্ট্রতন্ত্র পিছপা হোন না।

নারীর সকল বঞ্চনাকে পুঁজি করে সামাজিক কাঠামো এভাবে ‘মজবুত’ করা হয়। অথচ একজন নারীর শরীরে আছে বহুবিধ ইউনিক যৌন অঙ্গ এবং প্রত্যঙ্গ যা পুরুষের থেকে আলাদা এবং বিবিধ। একটি মর্মান্তিক উদাহরণ দেওয়া যাক। আফ্রিকা এবং আরব দেশে একটি বর্বর প্রথা রয়েছে। কন্যা শিশু সন্তানের খৎনা দেওয়া। একটি সমাজ কতোটা ব্রুটাল হলে এটি সম্ভব হয়, ভাবতে শিউরে উঠতে হয়। এর প্রাক কথা বলতে হলে বলতে হয়, নারীর শরীরে যে বেশ কিছু যৌন প্রত্যঙ্গ আছে, ভগাংকুর নারীর এমন একটি যৌন প্রত্যঙ্গ, যা কেবল নারীর যৌনসুখ উপভোগের জন্য। এটিকে ঐ সমাজ নৃশংসভাবে কন্যা সন্তানের জন্মের পরপরই কেটে ফেলে। অর্থাৎ নারীর যৌন আনন্দকে একটি সমাজ কতটা ভীতির চোখে দেখলে তারা সেটি করতে পারে, ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। গায়ে আরও কাঁটা দিয়ে ওঠে এই ভেবে যে, আজও এটি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে এবং সরকারি বেসরকারি আন্তর্জাতিক কোন প্রচেষ্টাই এটিকে বন্ধ করতে সক্ষম হচ্ছে না।

যে বিষয়টি আলোকিত করা দরকারি বলে মনে করছি, নারী শরীরের কাছে পুরুষতন্ত্র এমনভাবে ইনফিরিয়র অনুভব করেছে যে সে তাকে দাবিয়ে রেখে নারীর শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে যা কিছু দরকার সব করেছে। তারা সেভাবেই ধর্ম আইন রাষ্ট্র সমাজ পরিবারের কাঠামো তৈরি করেছে।

পশ্চিম বিশ্বের নারীদের বিরুদ্ধে প্রাচ্য সব সময় এজন্য কুৎসা রটায় যে পশ্চিমের নারীরা ষাটের দশক থেকেই তাদের সেক্সুয়াল স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। নারীর দেহ যে পুরুষের বস্তু, বিষয়, অস্থাবর সম্পত্তি নয়, বরং তাদের নিজস্ব, সেটি তাঁরা জোরালোভাবে ঘোষণা করেছে। তাদের শরীর, তাদের যৌনতা, তাদের পাওয়ার হিসাব তাঁরা দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করেছে। যা নারীকে সামাজিক রাষ্ট্রীয় এবং পারিবারিকভাবে অনেক শক্তিশালী করেছে।

নারীকে তাঁর চাওয়া জানাতে হবে। নারীর বঞ্চনাকে স্থায়ী করার জন্য নারীর শরীর এবং যৌনতাকে যেভাবে সাপ্রেস করে রাখা হয়েছে, নারীদেহকে যেভাবে পাপ এবং নিষিদ্ধতার আঁধার করে রাখা হয়েছে তাকে ভাঙতে হবে। আর সেটা ভাঙতে হলে এগুলো নিয়ে কথা বলতে হবে। সকল নিষিদ্ধতার শব্দগুলো উচ্চারণ করতে হবে। এ বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী রুগ্ন নয়, একটি সবল জনগোষ্ঠী হিসেবে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবে। একটি সবল জনগোষ্ঠীর হাতেই কেবল একটি সবল জাতি গড়ে ওঠে।

১৪ আগস্ট ২০১৭
স্টকহোম, সুইডেন

শেয়ার করুন: