সোভিয়েত নারীর দেশে-৪

Armenia 2সুপ্রীতি ধর: মস্কো পৌঁছেই দেখলাম আমার সাথে আসা ছেলেদের বড় গ্রুপটাই চলে গেল প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা সেরে। বড়রা জানালেন, ওরা দেশ থেকেই প্যাট্রিস লুবুম্বায় ভর্তি হয়ে এসেছে। তাদের হোস্টেল ঠিক হয়ে আছে, তাই তাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

তখনই যে প্রশ্নটা মাথায় এলো, ‘আমি তাহলে কোথায় ভর্তি হয়েছি? আমি কি মস্কো থাকবো না?’ যখন শুনলাম, না, আমার ভর্তি এখানে হয়নি, আমাকে যেতে হবে ইরেভানে, আরমেনিয়ার রাজধানীতে, একেবারেই ভেঙে খান খান হয়ে গেলাম।

ইরেভান, সেটা কোথায়? সেটা কি মস্কোর কাছেই? সকালে ঘুম থেকে উঠে যে বরফ দেখে মনটা আনন্দে নেচে উঠেছিল, তার সবটাই উবে গেছে এক দু:সংবাদে। আমার জন্য দু:সংবাদই বটে! এদিকে তখন রুশ কর্তৃপক্ষ আমাদের মাথার উঁকুন আর পেটের কৃমি পরীক্ষায় লেগেছে। কী জঘণ্য সেই অভিজ্ঞতা, দ্বিতীয়বার আর মনে করতে চাই না। উঁকুন আর কৃমি যাতে আমরা অনুন্নত দেশগুলো থেকে নিয়ে এসে এখানে বিস্তার না ঘটাই সেজন্য তারা সতর্ক প্রহরী। কী আর করা, চোখ-মুখ বন্ধ করে তাদের আদেশ-নির্দেশ মেনে যাবতীয় কায়-কারবার সারলাম। কিন্তু মনটা তো খচ খচ করছেই। ইরেভানকে যে তখন আমার কী শত্রুদেশ মনে হয়েছিল! যে আমার কাছে সোভিয়েত ইউনিয়ন মানেই মস্কো আর লেনিনগ্রাদ, সেখানে ইরেভানের স্থান কোথায়!

এক ফাঁকে দুজন ছোট ছোট মেয়ে আসলো আমার হোটেলে। নিজেরও তখন যে উচ্চতা আর ওজন, তাতে ওদের ছোট ভাবার যদিও কোন কারণই ছিল না, তারপরও মনে হয়েছিল আমার ৫ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতা কিঞ্চিত হলেও লম্বা। এদের মধ্যে একজন বেশ বড় বড় ভাব নিয়ে কথা বলে গেল অনর্গল, আরেকজন চুপচাপ, নীরব শ্রোতা। শুধু হাসলো সে। তো, ওই বিজ্ঞ মেয়েটির নাম পরে জেনেছি, রুমা, মস্কোতে যে ‘ছোট রুমা’ হিসেবেই পরিচিত ছিল, মস্কো থেকে এক্সিলেন্ট রেজাল্ট করে পিএইচডি করে এসে এখন সে খুলনায় ‘অরতীর্থ’ স্কুলের পর নিজেই ‘সহজ পাঠ’ বলে একটা স্কুল খুলেছে। সাফল্য তার ব্যক্তিজীবনে ও কর্মজীবনের দুটোতেই চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে। আর বাকিজন ‘শাওন’, বর্তমানে পেট্রোবাংলার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ‘ফারহানা শাওন’। জীবনের পরবর্তী সময়গুলোতে এই এরাই কিন্তু আমার পরম বন্ধু হয়ে উঠেছিল। আজও আছে।

যাই হোক, বিকেলে হোটেলের পাশেই একটা হোস্টেলে নিয়ে গেল আমাকে। আমার তখন সেই উনিভারসিচিয়েত হোটেল আর তার সামনের রাস্তাঘাট সবই শূন্য মনে হতে থাকলো ইরেভানের প্রশ্নে। কিছুই ভালো লাগছিল না। এর মাঝেই কেউ একজন হোটেলটির পাশেই থাকা একটা হাঙ্গেরিয়ান দোকান থেকে কয়েকটা সাবান আর গাবি নামের একটি বডি লোশন কিনে দিল আমায়। এটা এমনকিছু তথ্য না। তথ্য যেটুকু, তা হচ্ছে এই গাবি লোশনটার সুগন্ধ বা স্মেল আমরা যাকে বলি, তা পরবর্তীতে, এবং এখন পর্যন্ত আমার কাছে অনেক স্মৃতিকাতর হয়ে আছে। কিছু কিছু গন্ধ যেমন অনেক কিছু মনে করিয়ে দেয়, তেমনি এই বডি লোশনটির গন্ধও। আহা, আরেকটিবার যদি পেতাম আমি!

যাক, যাচ্ছিলাম পাশেই এক হোস্টেলে। বাপস, এটা তো সেই ছোট দুটি মেয়ে রুমা-শাওনের রুম। মানুষ গিজগিজ করছে, ছেলেদের কেউ কেউ হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে করিডরের কোনদিকে যেন দৌড়াদৌড়ি করছে, আর রুমা তার গালগল্প চালিয়েই যাচ্ছে। আমাকে দেখেই ও বিছানা ছেড়ে উঠে এসে জড়িয়ে ধরে নিয়ে বসায়।

বলে, মন খারাপ হচ্ছে তোমার? তার মানে আমার ইরেভান যাত্রার কথা ওর কানে এসেছে। আমার চোখ ছলছল করে উঠে। মস্কো আসার পর গত দুদিন আমি যেভাবে বাঙালীদের মাঝে মিশে আছি, সেখান থেকে আমাকে অচেনা কোথায় চলে যেতে হবে ভেবেই ভয়ে শিউরে উঠছি। বার বার ভাবছি, তাহলে কি মস্কো আমার জন্য বিদেশ ছিল না? বিদেশ হবে ইরেভান?

Armenia 3সবাই রান্নাবান্না করছে, কারণে-অকারণে হাসছে, কথা বলছে। ওরা কীসব কথা বলছে, আমি কিছু বুঝতে পারছি, কিছু মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। দুদিন আগেও ঢাকায় যে মেয়েটা যথেষ্ট স্মার্ট ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, সেই কিনা আজ চুপসে আছে কোন অজানা আশংকায়? বড় ভাইয়েরা এসেছেন, তারাও কেমন যেন আমার দিকে করুণার দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছেন। সবাইকে ‘অপরাধী’ বানিয়ে রেখেছি আমি। আমাকে সান্ত্বনা হিসেবে আরেক বন্ধু ‘সুস্মি’র কথা বলা হলো যে, সেও বাইরের একটি শহরে গেছে। কিন্তু কোন উদাহরণই তখন আমার মনে শান্তি দিচ্ছিল না। বার বার মনে হচ্ছিল, আমি কেন শাওন বা রুমা নই?

সুশান্তদা (সুশান্ত বিশ্বাস) ছিলেন আমাদের খুব প্রিয় একজন বড় ভাই, বলা চলে, এই দাদাই সব জুনিয়রদের বাড়ির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। আমাদের মা-বাবারাও তার কাছেই চিঠি লিখে সন্তানের খবর নিতেন, দাদাও খুব যত্ন করে সব চিঠির উত্তর দিতেন। অন্তত আমার মায়ের তো একমাত্র নির্ভরস্থল হয়ে উঠেছিলেন বিদেশ-বিভুঁইয়ে পাঠিয়ে দেয়া মেয়েটার খবর রাখতে। সেই সুশান্তদা খুব সম্ভবত সেবছর বাংলাদেশ ছাত্র সংগঠন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ফলে তার দায়িত্বও ছিল অনেক। আমার মতোন এমন অসংখ্য নতুন শিক্ষার্থীর দেখভাল থেকে শুরু করে অভাব-অভিযোগ সব মেটাতে হতো তাকেই। সেই তিনিই আমাকে ইরেভান-সংক্রান্ত করুণ অবস্থা থেকে সাময়িক উদ্ধারে প্রচেষ্টা চালালেন। অন্তত আমাকে তাই সান্ত্বনা দেয়া হলো। কিন্তু লাভ হলো না।

সেই সন্ধ্যায় রুমা-শাওনের রুমে গিয়ে সেখানে উপস্থিত সবাইকে আমার প্রচণ্ড হিংসা হতে লাগলো। তারপরও রুমাকে ভাল লেগে গেল। ওকে দেখি জানালা গলিয়ে কী একটা বক্স এনে হাজির। চামচ এনে আমার মুখে তুলে দিয়ে বললো, নাও, আইসক্রিম খাও। খেলাম, সেও খেল। আবার আমাকে দিল, সেও নিল। এভাবেই এক চামচে খেতে লাগলাম আমরা দুই ‘অপরিচিত’ জন। মনে খটকা জাগলো, জানালার ওপার থেকে সে আইসক্রিম পেল কোথায়? আস্তে করে জিজ্ঞাসা করাতে রুমা দুষ্টুমি করে বললো, মস্কোতে এমনই পাওয়া যায়, জানালা খুললেই সব মেলে।

সত্যি বিশ্বাস করুন, আমি সেদিন বিশ্বাস করেছিলাম রুমার কথা। পরে অবশ্য জেনেছিলাম যে, বাইরে ঠাণ্ডা বলে কাঁচা বাজার অনায়াসেই রেখে দেয়া যেতো জানালার বাইরে। ওটা ফ্রিজের বিকল্প ছিল খানিকটা হলেও। ভরা শীতে তো সেটা সম্ভবই ছিল।

রাতের খাওয়া শেষে আমার ফেরার পালা। মস্কোর ইউনিভার্সিটি হোটেলে আটকে গেলাম আমি আর নাসির (এখন ডাক্তার), বিমানে বমি করা সেই ছেলেটা। বমি করেছিল বলে গত দুদিন যার সাথে একটি কথাও বলিনি আমি। সেই নাসির এখন আমার ইরেভান সহযাত্রী। রুমে ফিরে খুব একটা গোছগাছের কিছু ছিল না। যে দু’একটা জামা-কাপড় যা বের করেছিলাম, ভরে নিলাম। নিচে বাস অপেক্ষা করে আছে, সেই লাল রংয়ের ইনটুরিস্ট বাসটা। আজ ওটাকে আমার যমদূত বলে মনে হচ্ছে। প্রথমদিনের সেই বন্ধুপ্রিয়তা ওর সাথে আর নেই। ও আজ আমাকে নিয়ে যাচ্ছে কোথায়, কোন অজানায় তুলে দিয়ে আসবে বলে।

আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, যদি আমি এখন দেশে ফেরত যেতে পারতাম, মায়ের কাছে ফিরতে পারতাম! জীবনের এতো অনিশ্চয়তা কেন আমার জীবনে! কেন আমার মা আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলো? কেন? দরকার নেই আমার উচ্চশিক্ষার, দরকার নেই আমার বিদেশ দেখার। কিছুরই দরকার নেই। তার চেয়ে বরং আমি ময়মনসিংহের সেই গৌরীপুর কলেজে গিয়ে পড়বো, তাও হয়তো অনেক শান্তি।

মনে হলো, কেন যে আমার বাবা নেই, কেন তাকে আমার একাত্তরে হারাতে হলো? বাবা থাকলে তো তার আদরের মেয়েকে এতো দূরে পাঠাতো না! কতোকিছু যে মনে হচ্ছিল তখন আমার। শুধু এটাই মানতে পারছিলাম না যে, একটু পরই বাসটা আমাকে নিয়ে যাবে একটা স্টেশনে, সেখান থেকে ট্রেনে করে আমাকে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘপথ। শুনেছি, সেখানকার ভাষাও রুশ ভাষা না। তার মানে আমার ন্যুনতম রুশজ্ঞানও মাঠে মারা যাচ্ছে। আমি আসলে কোথায় যাচ্ছি?

মা, মাগো…………চিৎকার করে কাঁদলাম বাথরুমের দরজা বন্ধ করে। কেউ শুনলো না সেই কান্না। চার দেয়ালে আটকা পড়ে সেই কান্না আমার নিজেরই কানে ফিরে ফিরে এলো। একসময় আমি বেরিয়ে এলাম, সে অন্য এক আমি। পৃথিবীর যেকোনো কিছু তখন মেনে নিতে আমি রাজী। বেঁচে থাকতে হলে জীবনের এই চ্যালেঞ্জটুকু আমাকে নিতেই হবে।

বাসে অনেকেই আছেন বড় ভাইদের। আমার দুই মামাও এসেছে। তারা আমার জন্য খাবার কিনে নিয়ে এসেছেন। ভাত না, মাংস না, কেবল মিষ্টি জাতীয় খাবার। কেক, রুটি, পেপসি, আর কী কী যেন। বললো, খিদে পেলে খেয়ে নিতে। আরও বললো, ট্রেনে রেস্টুরেন্ট আছে, যেন খাবার কিনে নেই, কিছু টাকাও দেয়া হলো আমাকে। গুনে দেখলাম, ৩০ রুবল। নতুন টাকা, অপরিচিত নোট। আগে ভিনদেশি টাকা পেলে কী খুশিই না হতাম, অথচ তখন এই টাকা, এই খাবার আমার ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছিল। হোটেল থেকে স্টেশন। বেশ খানিকটা পথ। পথে ঘুমিয়ে গেলাম। উঠে দেখি বিশাল এক ভবনের (আমার ভাষায় প্রাসাদ) সামনে বাসটি থেমেছে। এই ভবন কী করে স্টেশন হয়, তা কমলাপুর জংশন দেখা আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকলো না।

ভিতরে গিয়ে চোখ আরও বিস্ফারিত হয়ে গেল। এতো সুন্দর সুন্দর ট্রেন সব। আমার দেশের মতোন ভাঙাচোরা না। একটা কামরায় আমাকে আর নাসিরকে উঠানো হলো। চারজনের কেবিন। সঙ্গী দুজনের গায়ের রং ফর্সা, কিন্তু চুল কালো। মামা আস্তে করে বললো, উনারা আরমেনিয়ান। হবে হয়তো, তখন যদিও কোন মানুষই আমাকে আকর্ষণ করতে পারছিল না। কেবলই ভাসছিল আমার দুদিনের মস্কো ভ্রমণের স্মৃতি। কী এমন ক্ষতি হতো আমাকে মস্কোতে রেখে দিলে! 

যথাসময়ে ট্রেন ছাড়লো, ট্রেন থেকে সময়মতো নেমে দাঁড়ানো পরিচিত মুখগুলো হারিয়ে যেতে লাগলো ক্রমেই। আর আমার তখন হু হু করে কান্না জমতে লাগলো বুকের ভেতরে। কে জানতো, আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে তখন নাসির হাউ মাউ করে কেঁদে উঠবে! আর বলবে, ‘মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে আমার’!

কে কাকে সান্ত্বনা দেবো, দুজনেই কাঁদছি, কখনও হাউমাউ করে, কখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। আর আমাদের সহযাত্রী দুজন (মা ও ছেলে) আমাদের দিকে করুণ চোখে তাকাতে লাগলেন। কী বলে সান্ত্বনা দেবেন, তা বুঝতে পারছিলেন না। ভাষাগত জটিলতা আমাদেরকে আরও দূরে ঠেলে দিতে লাগলো।

মস্কো ছেড়ে ট্রেন তখন চলছে তিন হাজার কিলোমিটার দূরের গন্তব্যে, আরমেনিয়ার রাজধানী ইরেভানের উদ্দেশে। (চলবে)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.