
লীনা হক: আজ সকালে ঘুম ভাঙল মাথা-ব্যথা নিয়ে। গত কয়েকদিন ধরেই মাথাটা ব্যথা করছে। থাকছে ব্যথাটা সকাল বিকাল সব সময়ই। প্যারাসিটামলেও যাচ্ছে না। চোখের পাওয়ারটা বাড়ল নাকি আবার কে জানে! ডাক্তার দেখাতে হবে। সকালে কাজে এসে আমাকে বিছানায় দেখে সাহেরা বলল মাথায় ভালো করে তেল গরম করে লাগালে নাকি এই ব্যথার উপশম হবে। আমাদের সাহেরার কাছে মাথা-ব্যথা থেকে হাড় ভাঙ্গা সর্ব রোগের টোটকা আছে শুধু নিজের মাসল পুলেরই কোন সুরাহা করতে পারে নাই বেচারি, এই-ই যা!
যাই হোক, রাজী হলাম তেল দিতে। তেল গরম করে এনে সাহেরা বসলো এসে আমার মাথার পাশে। হাতের সাথে সাথে তার মুখ ও চলছে সমানতালে। সাহেরার বড় মেয়েটি থাকে তার মায়ের কাছে রংপুরের গ্রামে। ক্লাস সিক্সে পড়ে। পড়াশোনায় ভালো মেয়েটি। উপবৃত্তি পায়। দেখতেও ভালো, সাহেরার ভাষায়,’মাইয়াখান মোর সোন্দর আফা, ধপধপা (ফরসা) চেহারা, মোর লাখান কালি নোয়ায়!’।
নিজের গায়ের রঙ নিয়ে সাহেরার এই তাচ্ছিল্য ভাব আসলে তার নিজের মতবাদ নয়- হাজার বছর ধরে আমাদের রক্তের গভীরে বহমান এই বর্ণবাদ। সাহেরা বেচারা এর থেকে বের হবে কি উপায়ে! সাহেরা মাসে মাসে টাকা পাঠায় তার মায়ের কাছে মেয়ের খরচাপাতির জন্য। তেল মালিশ করতে করতে সাহেরা বলে, ‘তোমাক একনা কতা কহিবার আছে আফা!’ চোখ বন্ধ রেখেই জানতে চাই কি কথা।
সাহেরা আবার বলে,’ তোমরা কিন্তুক আগ (রাগ) করবার পারবেন না আগেই কয়া রাখনু মুই, কতাখান যদিও আগের (রাগের) লাখান’। বুঝি না কি এমন রাগের কথা সে আমায় বলবে আবার কড়ার করিয়ে নিচ্ছে যে রাগ করতে পারবো না! ভাবি হয়তো বা কিছু টাকা আগাম লাগবে অথবা স্বামীর সাথে ঝগড়া করেছে আবার। কয়েকদিন আগেই ঝগড়া করে সে স্বামীর গায়ে জুতো ঢিল দিয়ে আমার কাছে বকা খেয়েছে। সত্যি বলতে লজ্জা নাই, আমি অবশ্য মনে মনে ঘটনাটা উপভোগ করেছিলাম। কিন্তু তাই বলে তো আর সাহেরাকে এই ধরনের আচরণের জন্য প্রকাশ্যে বাহবা দিতে পারি না!
‘আফা, মোর বড় মাইয়াখানের জন্যি সম্বন্ধ আইছে। ছইলখান মোর বড় বইনের ছাওয়াল। মুই কহ কি মাইয়াক বিয়া যখন দেয়াই নাগবে, এই সম্বন্ধ খান ভালো আছিল আফা।‘ আয়েশ করে মাথায় তেল লাগানো আর গেল না, উঠে বসি। ‘ও সাহেরা, মেয়ে তো এখনো শিশু, মাত্রই তেরো বছর বয়স’। সাহেরা মাথা নাড়ে, ‘মাইয়া সেয়ান হইছে আফা। কয় মাস ধরি ওমার (ওর) মাসিক শুরু হইছে। এলা আস্তে আস্তে তো বিয়া দেখাই নাগবে। বইনের পোলা মাদ্রাসাত পড়ে। মোর মাইয়ার থাকি বছর দু এর বড়।। দেখতে সোন্দর। হামার গেরামের এক গেরাম পরেই মোর বইনের ঘর। জমি জিরাত করি খায় ওমরা (তাঁরা)। ধরতে গেলে বেশী কিনি খাওয়া নাগে না। ছয় মাসেরও বেশী খেতের চাল খায় তারা। একনা টিনের চৌচালা ঘর আছে। মাতির ঘর আছে আরও দুইখান। টিপকল আছে। সংসারে মানুষও কম। বইন, দুলাভাই আর এই ছইলখান ছাড়া আর মাত্র দুইখান ছইল।‘
এক নিঃশ্বাসে বলে যাওয়া সাহেরার কথা শুনে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তবু চেষ্টা করি, ও সাহেরা, আরও দুই- তিনটা বছর না-হয় দেরী করলে। মেয়েটা তো বাচ্চা একদম গো। বুঝানোর চেষ্টা করি যে মেয়ের ১৮ বছর আর ছেলের ২১ বছর না হলে তো বিয়ে আইনত সিদ্ধ হবে না। বিয়ে রেজিস্ট্রি করা যাবে না। তুমি দোষী হবে।
মলিন মুখ তুলে বলে সাহেরা,’ আফা, আইন কি মোক খাওয়াইবে না পিন্দাইবে? এই বিয়াত কোন দেনা-পাওনা নাই। জামাইকে কোন টেকা কি কোন সাইকেল, কি ঘর কিছুই দেয়া নাগবে না।‘।
ভাবলাম মূল বিষয় যৌতুক। যেহেতু কোন যৌতুক দেয়া লাগছে না তাই শিশুটিকে বিয়ের নামে বলি হতে হবে। আমাকে চমকে দিয়ে সাহেরা আরও জানালো, তার বড় বোনের স্বামী জানিয়েছে, রেজিস্ট্রি করার দরকার নাই। আর রেজিস্ট্রি করাটাও কোন ঝামেলা না। সে ইতোমধ্যে কাজী সাহেবের সাথে একটু কথাও বলেছে। বর-কনের বয়স একটু বাড়িয়ে লিখে দেয়া কোন ব্যাপার নয়, শুধু একটু বেশী টাকা খরচ হবে, তা যৌতুক যেহেতু দিতে হচ্ছে না, সাহেরার পরিবার এই কয়টা টাকা কাজী আর মৌলানাকে দেয়ার ব্যবস্থা করুক। রোজার ঈদের পরেই বিয়েটা সেরে ফেলতে চায় তারা।
গ্রামীন জনপদে সরকারী জন্ম আর বিবাহ রেজিস্ট্রেশন এইভাবেই চলছে! আর সিস্টেমের বলি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়ে শিশুটি। জিজ্ঞ্যেস করলাম, তার স্বামী কি বলে এই ব্যাপারে! স্বামী রাজী, কোন টাকা পয়সা লাগছে না যেহেতু। মেয়েকে জানিয়েছে কিনা তাতে জানালো এখনো বলে নাই কিছু, রোজার সময় তারা যখন গ্রামে যাবে তখনই বলবে। তবে মেয়ে কাঁদবে এটা নিশ্চিত। পড়তে চায় মেয়েটি। শিক্ষক হতে চায় সে। গতবছরই ফুটফুটে এই মেয়েটিকে দেখেছি আমি। পরীক্ষা শেষে ঢাকায় মায়ের কাছে বেড়াতে এসেছিল। আমার কেমন যেন অস্থির লাগে। যেন দেখতে পাই, কাঁদছে মেয়েটি আছাড়ি পিছাড়ি, বিয়ে করতে চায় না সে এখুনি। শেষ চেষ্টা হিসেবে বলি, সাহেরা, মেয়েটি তোমার পড়ালেখায় ভালো। তুমিই না বলেছিলে মেয়েকে তুমি পড়াতে চাও। তোমার মতন ছোট বয়সে বিয়ে দিতে চাও না। কোনভাবেই কি আর কটা বছর অপেক্ষা করা যায় না? বিষণ্ণ মুখে বলে সে, এইরকম একটা সম্বন্ধ পরে যে আসবে তার নিশ্চয়তা কি? দিন যত যাবে শ্যামল বর্ণা মেয়ের বিয়ের জন্য যৌতুকের পরিমাণও পাল্লা দিয়ে বাড়বে। ডুবন্ত মানুষের মতন খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চাই, ‘সাহেরা, মেয়ের বিয়ের সব খরচ যদি আমি দেই, তাতে তো আপত্তি হবার কথা নয় তোমাদের। মেয়েটাকে বড় হতে দাও, পড়তে দাও ওকে। অন্তত ১৮ বছর বয়স হতে দাও প্লিজ’।
জলভরা চোখে সাহেরা জানায়, ‘আফা, দিন-কাল ভালো নয়, দেশ গেরামেও সব মোবাইল লাইন (সাহেরা ইন্টারনেটকে এভাবেই বলে) না কি সব হইছে, ছোইয়াল আর মাইয়ার ছবি তুলি তুলি সগ জাগাত ভাসাই (ভিডিও শেয়ার করাটা সাহেরার ভাষায় ভাসানো) দেয়। মাইয়া সেয়ান হইছে। ঢাকার বস্তিতে মোর কাছত রাইখবার পারি না, আবার গেরামে থুইয়াও শান্তি নাই। কত কিছু হইবার পারে আফা। তোমরা মানা করিয়েন না।‘
হায়রে, আমি মানা করলেও তো আটকাচ্ছে না এই বাল্য বিবাহটা! চরম দারিদ্র্যের সাথে সাথে নিজেদের মেয়ে সন্তানদের ব্যক্তিগত অনিরাপত্তার ভীতি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে! আর কথা আগায় না আমাদের মধ্যে। বসে থাকি দুইজন চুপ-চাপ। সাহেরার চোখ থেকে টপ টপ করে জল ঝরে। আমার বুক ভরা জ্বালা।
কেমন এই নারী জীবন! জন্ম থেকেই দারিদ্র্য, অশিক্ষা, যৌতুক আর পারিবারিক সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অভাবের শিকার হতেই থাকবো আমরা! কোথায় মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের এচিভমেন্ট? জাতিসংঘ অথবা রাষ্ট্র কার কাছে এর বিধান চাইবে তেরো বছরের এই কিশোরীটি? জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৩২৫ প্রস্তাবনায় কি ইন্টারনেট ব্যবহার করে নারীর মর্যাদা হেয় করার বিষয়টি স্থান পাচ্ছে? আমাদের ভিশন ২০২১ এর রূপরেখায় কি এই সমস্যা সমাধানের কোন পথ বাতলানো আছে? বসেই থাকি আমি…….।