ইশরাত জাহান ঊর্মি:
এইটা কোন শক্তিশালী ক্যারেক্টার না। কিন্তু একটু বেদনা আছে। একটু বেদনা? নাকি একজীবনের? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি আমার যে উদগ্র প্রেম, নারীমুক্তি প্রশ্নে তার কিছু কিছু গল্পে আমার সেই প্রেমও কেমন থমকে যায়। কিন্তু গল্পগুলা তো ঊনিশ শতকের গোড়ার। নারীরা যেমন ছিলেন সেসময়, রবীন্দ্রনাথ তাই দেখিয়েছেন, নারীরা কেমন হওয়া উচিত ছিল তা তিনি বলে দেননি। তিনি লেখক অনেকখানি, সমাজ সংস্কারক সর্বদা নন।
মধ্যবর্তিনী গল্পে চিরকালীন বাঙালী এক আনরোমান্টিক এক পুরুষকে আঁকেন ঠাকুরমশাই।
“নিবারণ প্রাতঃকালে উঠিয়া গলির ধারে গৃহদ্বারে খোলাগায়ে বসিয়া অত্যন্ত নিরুদ্বিগ্নভাবে হুঁকাটি লইয়া তামাক খাইতে থাকে। পথ দিয়া লোকজন যাতায়াত করে, গাড়ি ঘোড়া চলে, বৈষ্ণব–ভিখারি গান গাহে, পুরাতন–বোতল– সংগ্রহকারী হাঁকিয়া চলিয়া যায়; এই–সমস্ত চঞ্চল দৃশ্য মনকে লঘুভাবে ব্যাপৃত রাখে এবং যেদিন কাঁচা আম অথবা তপসি–মাছওয়ালা আসে, সেদিন অনেক দরদাম করিয়া কিঞ্চিৎ বিশেষরূপে রন্ধনের আয়োজন হয়। তাহার পর যথাসময়ে তেল মাখিয়া স্নান করিয়া আহারান্তে দড়িতে ঝুলানো চাপকানটি পরিয়া, এক–ছিলিম তামাক পানের সহিত নিঃশেষ–পূর্বক আর–একটি পান মুখে পুরিয়া আপিসে যাত্রা করে। আপিস হইতে ফিরিয়া আসিয়া সন্ধ্যেবেলাটা প্রতিবেশী রামলোচন ঘোষের বাড়িতে প্রশান্ত গম্ভীর ভাবে সন্ধ্যা যাপন করিয়া আহারান্তে রাত্রে শয়নগৃহে স্ত্রী হরসুন্দরীর সহিত সাক্ষাৎ হয়।
সেখানে মিত্রদের ছেলের বিবাহে আইবুড়ো–ভাত পাঠানো, নবনিযুক্ত ঝি’র অবাধ্যতা, ছেঁচকিবিশেষ ফোঁড়নবিশেষের উপযোগিতা সম্বন্ধে যে–সমস্ত সংক্ষিপ্ত সমালোচনা চলে তাহা এ–পর্যন্ত কোনো কবি ছন্দোবদ্ধ করেন নাই, এবং সেজন্য নিবারণের মনে কখনো ক্ষোভের উদয় হয় নাই।”
এই পর্যন্ত পড়ে গল্পে যে প্রেম উপজীব্য হতে পারে ধারণা করা কঠিন। নিবারণ এর স্ত্রী হরসুন্দরীও যে বিশেষ রোম্যান্টিক তেমন প্রমাণ আমরা পাই না। কিন্তু একটা অসুখ, একটা অসুস্থতা কীরকম অনুপান হয়ে এলো প্রেম নামের নেশার।
হরসুন্দরী ফাল্গুন মাসে অসুস্থ হলো। স্ত্রীর সকল রকম সেবা সে করলো। চল্লিশ দিন পরে সে ব্যাধিমুক্ত হলো, কিন্তু দুর্বল আর শীর্ণ, “শরীরটি যেন বহুদূর হইতে ক্ষীণস্বরে আছি বলিয়া সাড়া দিতেছে মাত্র”। হরসুন্দরীরা চিরকাল সংসারের কাজ করে, তাদের প্রতি বিশেষ যত্ন, বিশেষ মনোযোগে যে দরকার তা সংসার বা স্বামীও মনে করে না, হরসুন্দরীরাও মনে করে না। তাই অসুস্থতায় স্বামীর সেবা পেয়ে সে হতবিহ্বল।
“মনে যখন একটা প্রবল আনন্দ একটা বৃহৎ প্রেমের সঞ্চার হয় তখন মানুষ মনে করে আমি সব করিতে পারি। তখন হঠাৎ একটা আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা বলবতী হইয়া উঠে। স্রোতের উচ্ছ্বাস যেমন কঠিন তটের উপর আপনাকে সবেগে মূর্ছিত করে তেমনি প্রেমের আবেগ, আনন্দের উচ্ছ্বাস, একটা মহৎ ত্যাগ, একটা বৃহৎ দুঃখের উপর আপনাকে যেন নিক্ষেপ করিতে চাহে।
সেইরূপ অবস্থায় অত্যন্ত পুলকিত চিত্তে একদিন হরসুন্দরী স্থির করিল, আমার স্বামীর জন্য আমি খুব বড়ো একটা কিছু করিব। কিন্তু হায়, যতখানি সাধ ততখানি সাধ্য কাহার আছে। হাতের কাছে কী আছে, কী দেওয়া যায়। ঐশ্বর্য নাই, বুদ্ধি নাই, ক্ষমতা নাই, শুধু একটা প্রাণ আছে, সেটাও যদি কোথাও দিবার থাকে এখনই দিয়া ফেলি, কিন্তু তাহারই বা মূল্য কী।
‘আর, স্বামীকে যদি দুগ্ধফেনের মতো শুভ্র, নবনীর মতো কোমল, শিশু–কন্দর্পের মতো সুন্দর একটি স্নেহের পুত্তলি সন্তান দিতে পারিতাম! কিন্তু প্রাণপণে ইচ্ছা করিয়া মরিয়া গেলেও তো সেই হইবে না।’ তখন মনে হইল, স্বামীর একটি বিবাহ দিতে হইবে। ভাবিল, স্ত্রীরা ইহাতে এত কাতর হয় কেন, এ কাজ তো কিছুই কঠিন নহে। স্বামীকে যে ভালোবাসে সপত্নীকে ভালোবাসা তাহার পক্ষে কী এমন অসাধ্য। মনে করিয়া বক্ষ স্ফীত হইয়া উঠিল।”
নিবারুন প্রথমে উড়িয়ে দিলেও ধীরে ধীরে তার মনের ভিতরেও আরেকটা বিয়ে করার, “সন্তান পরিবৃত গৃহের সুখময় চিত্র” স্পষ্ট হতে থাকলো। এবং একসময় নোলক পড়া অশ্রুভরা ছোটখাটো এক মেয়ের সাথে তার বিয়ে হলো, নাম তার শৈলবালা। আনরোমান্টিক, সংসার এবং স্ত্রীতে চিরঅভ্যস্ত নিবারনের ভিতরেও প্রেমের বান ডাকলো।এ বড়ো কৌতূহল, এ বড়ো রহস্য। এক টুকরা হীরক পাইলে তাহাকে নানা ভাবে নানা দিকে ফিরাইয়া দেখিতে ইচ্ছা করে, আর এ একটি ক্ষুদ্র সুন্দর মানুষের মন— বড়ো অপূর্ব। ইহাকে কতরকম করিয়া স্পর্শ করিয়া, সোহাগ করিয়া, অন্তরাল হইতে, সম্মুখ হইতে, পার্শ্ব হইতে দেখিতে হয়। কখনো একবার কানের দুলে দোল দিয়া, কখনো ঘোমটা একটুখানি টানিয়া তুলিয়া, কখনো বিদ্যুতের মতো সহসা সচকিতে, কখনো নক্ষত্রের মতো দীর্ঘকাল একদৃষ্টে, নব নব সৌন্দর্যের সীমা আবিষ্কার করিতে হয়।
ম্যাক্মোরান কোম্পানির আপিসের হেডবাবু শ্রীযুক্ত নিবারণচন্দ্রের অদৃষ্টে এমন অভিজ্ঞতা ইতিপূর্বে হয় নাই।”
তো শৈলবালার সাথে যখন প্রাপ্তবয়স্ক নিবারুণের প্রেম জমে উঠলে হঠাৎ একটা বজ্রশলাকা দিয়ে যেন চোখ খুলে দিল কেউ হরসুন্দরীর।হায়, আজ কোথায় সে বল যে বলে হরসুন্দরী মনে করিয়াছিল স্বামীর জন্য চিরজীবনকাল সে আপনার প্রেমের দাবির অর্ধেক অংশ অকাতরে ছাড়িয়া দিতে পারিবে। হঠাৎ একদিন পূর্ণিমার রাত্রে জীবনে যখন জোয়ার আসে, তখন দুই কূল প্লাবিত করিয়া মানুষ মনে করে, আমার কোথাও সীমা নাই। তখন যে একটা বৃহৎ প্রতিজ্ঞা করিয়া বসে, জীবনের সুদীর্ঘ ভাঁটার সময় সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিতে তাহার সমস্ত প্রাণে টান পড়ে। হঠাৎ ঐশ্বর্যের দিনে লেখনীর এক আঁচড়ে যে দানপত্র লিখিয়া দেয় চির দারিদ্র্যের দিনে পলে পলে তিল তিল করিয়া তাহা শোধ করিতে হয়। তখন বুঝা যায়, মানুষ বড়ো দীন, হৃদয় বড়ো দুর্বল, তাহার ক্ষমতা অতি যৎসামান্য।
দীর্ঘ রোগাবসানে ক্ষীণ রক্তহীন পাণ্ডু কলেবরে হরসুন্দরী সে দিন শুক্ল দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো একটি শীর্ণ রেখামাত্র ছিল; সংসারে নিতান্ত লঘু হইয়া ভাসিতেছিল। মনে হইয়াছিল, ‘আমার যেন কিছুই না হইলেও চলে।’ ক্রমে শরীর বলী হইয়াউঠিল, রক্তের তেজ বাড়িতে লাগিল, তখন হরসুন্দরীর মনে কোথা হইতে একদল শরিক আসিয়া উপস্থিত হইল, তাহারা উচ্চৈঃস্বরে কহিল, তুমি তো ত্যাগপত্র লিখিয়া বসিয়া আছ, কিন্তু আমাদের দাবি আমরা ছাড়িব না।
হরসুন্দরী যে দিন প্রথম পরিষ্কাররূপে আপন অবস্থা বুঝিতে পারিল সেদিন নিবারণ ও শৈলবালাকে আপন শয়নগৃহ ছাড়িয়া দিয়া ভিন্ন গৃহে একাকিনী গিয়া শয়ন করিল।
সেই চিরদিনের দু:খী, একাকী, ত্যাগী নারী। সমাজ-সংসার যাকে নিজেদের সুবিধার্থে নির্মাণ করে। ওদিকে নিবারণ তখন বঙ্কিমচন্দ্রের চন্দ্রশেখর পড়ে ফেলেছে, আধুনিক দু’একটা কবির কবিতাও সে আদরের সই তথা শৈলবালাকে পড়ে শুনিয়েছে। শৈলবালা একটু কাজ করলেও তার ব্যথা লাগে। এ নিয়ে সে মৃদু অভিযোগ করলে হরসুন্দরী শৈলবালাকে কোন কাজ করতে না দিয়ে নিজে মুখ বুঁজে সংসারের সব কাজ করে। কিন্তু এসবের মধ্য দিয়ে নিবারণের পাশাপাশি প্রেমে পড়ে আসলে হরসুন্দরীও।
“কেবল নিবারণ নহে, হরসুন্দরীও একটা নূতন বেদনার পরিচয় পাইল। এ কীসের আকাঙ্ক্ষা, এ কীসের দুঃসহ যন্ত্রণা। মন এখন যাহা চায়, কখনো তো তাহা চাহেও নাই, কখনো তো তাহা পায়ও নাই। যখন ভদ্রভাবে নিবারণ নিয়মিত আপিসে যাইত, যখন নিদ্রার পূর্বে কিয়ৎকালের জন্য গয়লার হিসাব, দ্রব্যের মহার্ঘতা এবং লৌকিকতার কর্তব্য সম্বন্ধে আলোচনা চলিত, তখন তো এই অন্তর্বিপ্লবের কোনো সূত্রপাতমাত্র ছিল না। ভালোবাসিত বটে, কিন্তু তাহার তো কোনো উজ্জ্বলতা, কোনো উত্তাপ ছিল না। সে ভালোবাসা অপ্রজ্জ্বলিত ইন্ধনের মতো ছিল মাত্র।”
তারপর যা হবার তা হলো। অতিরিক্ত আদরে আদরের মর্ম না বোঝা শৈলবালা দিনে দিনে অবুঝ হয়ে উঠলো। চারদিক থেকে স্বাভাবিক সেবা, সম্পদ, সৌভাগ্য সবই যেন তার পাওয়ার কথা এমনই সে ভাবলো। এই শৈলবালার আব্দার মেটাতে গিয়ে নিবারণ অফিসের টাকাও ভাংতে লাগলো নিয়মিত। চাকরি গেল। সহায়-সম্পত্তি গেল। খুব খারাপ অবস্থায় পড়লো পুরো পরিবার। এরই মধ্যে শৈলবালা গর্ভবতী হলো। স্বামীর যে আগের অবস্থা নেই, তা সে কিছুতেই বুঝবে না।
“অবশেষে শৈলবালার শারীরিক সংকটের অবস্থায় গুরুতর পীড়া হইল, এমন–কি গর্ভপাত হইবার উপক্রম হইল।
নিবারণ হরসুন্দরীর দুই হাত ধরিয়া বলিল, “তুমি শৈলকে বাঁচাও।”
হরসুন্দরী দিন নাই, রাত্রি নাই, শৈলবালার সেবা করিতে লাগিল। তিলমাত্র ত্রুটি হইলে শৈল তাহাকে দুর্বাক্য বলিত, সে একটি উত্তরমাত্র করিত না, “কিন্তু শৈলবালা বাঁচিল না। সংসারের সমস্ত সোহাগ আদর লইয়া পরম অসুখ ও অসন্তোষে বালিকার ক্ষুদ্র অসম্পূর্ণ ব্যর্থ জীবন নষ্ট হইয়া গেল।”
তা তো গেল। আর নিবারণেরও খুব একটা মুক্তির স্বাদ পেল। কিন্তু হরসুন্দরী কি আর স্বামীর প্রতি প্রেমে পড়তে পারলো। গল্পের শেষে আমরা দেখি নিবারণ তার অতি পরিচিত ঘরটিতে আবার শুতে আসে চোরের মতো।
মানব মনের অদ্ভুত সব পরিচয় পাই আমরা এই গল্পটাতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যোগাযোগ এর কুমুকে তৈরি করেছেন, স্ত্রীর পত্র’র মৃণালিনী, ‘নষ্টনীড়’ এর চারুলতা, ল্যাবরেটরির সোহিনী, চোখের বালি’র বিনোদিনীকে, আবার তিনিই এরকম অনেক ছোটগল্পে নারীকে ত্যাগী, সংযমী ইত্যাদি ইত্যাদি চেহারায় দেখিয়েছেন। রাবীন্দ্রিক মুন্সীয়ানায় নারী চরিত্র যখন যেটা এঁকেছেন সেটাই ভাস্বর, উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। নিজের সকল দাবী ছেড়ে দেওয়া হরসুন্দরী ঠিক করেছিলেন না ভুল করেছিলেন, নিবারণ যা করল, নারী হয়ে হরসুন্দরী যদি একই কাজ করতো তাহলে কী হতো, ঠাকুর কী লিখতেন, তা প্রশ্নবোধকের মতো ঝুলেই রইল।
চির পরিচিত ঘরে নিবারণ আর হরসুন্দরী আবার একসাথে শুলেও মাঝখানে একটা মৃত বালিকা তাদের শুয়ে থাকে। আর কে না জানে কখনও কখনও সামান্য দূরত্ব অতিক্রম করাও কত কঠিন!