একজন সংখ্যালঘু প্রিয়া সাহার অপরাধগুলো!

সাহাবউদ্দিন মাহমুদ:

একের পর এক নাস্তিককে কুপিয়ে হত্যা করেছে, লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে দেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য করেছে, দিনের পর দিন সংখ্যালঘুদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে, জোরপূর্বক তাদের জমি দখল করা হচ্ছে, সংখ্যালঘু নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে। দুর্নীতিতে দেশ বার বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য পরিণত হয়েছে এই দেশ। ভোট চুরি করে একটা সরকার জোর করে ক্ষমতায় বসে আছে, প্রতিনিয়ত বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধাকে পর্যন্ত ধর্ষণ করা হচ্ছে।

এতো কিছুর পরেও আপনাকে বলতে হবে বাংলাদেশে কোন সমস্যা নেই। যদি আপনি সংখ্যালঘু হয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে বলতে হবে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় দেশ। জোর করে কেউ আপনাকে ধর্ষণ করলে বলবেন, কিছুই হয় নাই, জাস্ট একটু আদর করা হয়েছে। কেউ আপনার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে সবকিছু পুড়িয়ে দিলে, আপনাকে বলতে হবে সামান্য একটু আগুন লেগেছে মাত্র, পরে পানি দিয়ে নিভিয়ে ফেলেছি। জোর করে আপনার জমি দখল করে আপনাকে ভিটেমাটি ছাড়া করার পর আপনাকে বলতে হবে, আমি জাস্ট একটা জায়গা থেকে আরেকটা জায়গায় ঘুরতে যাচ্ছি।

মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে দলবেঁধে এলাকাবাসী এসে আপনার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিবে, অতঃপর আপনাকে বলতে হবে, না তারা আসলে আমার বাড়িতে এসেছে দাওয়াত খাওয়ার জন্য। আপনাকে হিন্দুর বাচ্চা বলে গালি দেওয়া হবে, আপনাকে মালাউনের বাচ্চা বলে গালি দেওয়া হবে, আপনাকে বিধর্মীর বাচ্চা বলে গালি দেওয়া হবে, এতো কিছুর পরেও আপনাকে বলতে হবে, না তারা আমার খুব ভালো বন্ধু।

হাজারও অন্যায় অত্যাচার সহ্য করেও আপনাকে বলতে হবে ইসলাম শান্তির ধর্ম, মুসলমানরা সবাই শান্তিপ্রিয়, বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় দেশ। এদেশের মুসলমানরা সংখ্যালঘুদের একেবারে মাথার উপরে করে রাখে। কিন্তু যখনই আপনি এই মিথ্যা কথাটা বলতে পারবেন না, তখনই আপনি হয়ে যাবেন দেশদ্রোহী, দেশবিরোধী। এবং আপনাকে ধর্মান্ধরা পুড়িয়ে হত্যা করার চেষ্টা করবে।

আসুন সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের কিছু তথ্য দেখি। ২০১৮ সালে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ৮০৬টি ৷ তাই এটা স্পষ্ট যে, চলতি বছরের শুরু থেকেই সংখ্যালঘু নির্যাতন বাড়তে শুরু করেছে৷

সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি দখল: অভিযোগ করায় হয়রানি! তাদের দেয়া হিসাব অনুযায়ী এই চার মাসে হত্যার শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ২৩ জন৷ হত্যা চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০ জন৷ হত্যার হুমকি পেয়েছেন ১৭ জন এবং শারীরিক আক্রমণের শিকার হয়েছেন ১৮৮ জন৷ ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫ জন৷ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে লুটতরাজের ঘটনা ঘটেছে ৩১টি, বাড়ি ঘর ও জমি জমা থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন ১৬২ জন, দেশত্যাগের হুমকি পেয়েছেন ১৭ জন৷ ১০৪ জন ধর্মান্তরিত হয়েছেন, ২৯টি মন্দির ও মঠে হামলা হয়েছে, ৪৩টি মূর্তি ভাঙচুর করা হয়েছে এবং জবর দখলের ঘটনা ঘটেছে ৩৮টি৷ এর বাইরে অপহরণ, ধর্মস্থান দখল, মূর্তি চুরির মতো ঘটনারও অভিযোগ করা হয়েছে৷

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ আরও জানিয়েছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল ১,৪৭১ টি৷ ২০১৭ সালে তা কমে হয়েছিল ১,০০৪টি৷ ২০১৮ সালে আরো কমে ৮০৬টি৷ কিন্তু চলতি বছরের শুরুতেই তা আবার বাড়তে শুরু করেছে৷

১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের ধর্মীয় জনসংখ্যার অবস্থান।

১৯৪৭ সালের জনসংখ্যার হিসাব।
ভারত ৯০% হিন্দু – ৮% মুসলমান
পাকিস্তান ২২% হিন্দু – ৭০% মুসলমান
বাংলাদেশ ৩৬% হিন্দু – ৬০% মুসলমান

২০১৮ সালের জনসংখ্যার হিসাব।
ভারত ৭৫.৩% হিন্দু – ১৯.২% মুসলমান
পাকিস্তান ১.৮৫% হিন্দু – ৯৬.০% মুসলমান
বাংলাদেশ ৯% হিন্দু – ৯০% মুসলমান।

এটাই হচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থান।

প্রিয়া সাহা সম্ভবত সংখ্যাটা একটু বাড়িয়ে বলেছেন, বিষয়টা এরকম, কাউকে একটা থাপ্পড় দিলেও সারাদিন কাঁদে, আর কাউকে একটা হাত কেটে ফেললেও কাঁদে না। আমাদের বুঝতে হবে তার আঘাতটা কতটুকু, আপনার আমার ঘরবাড়ি যদি কেউ জ্বালিয়ে দেয়, তাহলে আমরা কী করতাম? যখন নিজের দেশের সরকার এবং জনগণ দ্বারা অত্যাচারিত হতে হয়, তখন আপনার আমার কীইবা করার আছে? সামান্য নালিশটুকুও কী করা যাবে না, নাকি নালিশ দেওয়া বিশাল বড় অন্যায়?

যারা মনে করেন কোন এক মানুষের নালিশ এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে গেছে, তারা কি ধরে নিয়েছেন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি একেবারেই সস্তা যে সামান্য এক নারীর মাধ্যমে ভাবমূর্তি উড়ে চলে যায়?

সরকার ভোট চুরি করে জোর করে ক্ষমতায় বসে আছে, এটাতে কি ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না? একটা দেশ ধীরে ধীরে স্বৈরতন্ত্রের দিকে চলে গেছে, এটাতে কি ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না? এইদেশে দুধের শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত ধর্ষণ হয় এটাতে কি ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না? এদেশে দল বেঁধে চার সন্তানের জননীকে ধর্ষণ করা হয়েছে এটাতে কি ভাবমূর্তি নষ্ট হয়নি? এইদেশে একের পর এক প্রকাশ্যে কুপিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, তখন কি ভাবমূর্তি নষ্ট হয়নি? একের পর এক নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত, এটাতে কি ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে না? যখন শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, তখন কি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়নি?

নদীতে ট্রলার ডুবে শত শত মানুষ সহ ট্রলার হারিয়ে গেছে এটাতে কি ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না? তাজরীন ফ্যাশনে আগুনে পুড়ে হাজার হাজার শ্রমিক কয়লা হয়েছে, সেটাতে কি ভাবমূর্তি নষ্ট হয়নি? রানা প্লাজা ধসে হাজার হাজার শ্রমিক মারা গেছে সেটাতে ভাবমূর্তি নষ্ট হয়নি? বরঞ্চ রানা প্লাজা ঘটনার পরেই তো আমেরিকা বাংলাদেশ থেকে জিএসপি সুবিধা উঠিয়ে নিয়েছে, আমরা কি ভুলে গেছি সেই ঘটনা?

নালিশ এই প্রথম দেওয়া হয়নি, গত ৪৭ বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের নামে বিভিন্ন জায়গায় নালিশ দিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকায় শেখ হাসিনাকে পঁচা ডিম মারা হয়েছে, জুতা নিক্ষেপ করা হয়েছে, তাকে গালাগালি করে প্রকাশ্যে স্লোগান দেওয়া হয়েছে, এগুলোতে ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না?

আসল সত্য হলো প্রিয়া সাহা একজন সংখ্যালঘু নারী, তিনি হিন্দু পরিবারের একজন মানুষ। সংখ্যালঘু হয়ে নালিশ দেওয়াটাই ছিল তার অপরাধ। বাঙালি মুসলমানরা শত বছর ধরেই দুর্বলদের আঘাত করে এসেছে, এবং ভবিষ্যতেও করবে। হাজার অত্যাচার সহ্য করেও আপনাকে চুপ থাকতে হবে, কথা বললেই বিপদ।

প্রিয়া সাহা হয়তো আর বাংলাদেশে বসবাস করতে পারবে না, যদিও বসবাস করার চেষ্টা করে তার উপর চালানো হবে অমানুষিক নির্যাতন। এই পৃথিবীতে, দুর্বল, এবং সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ কোন জায়গা নেই, এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।

– সাহাবউদ্দিন মাহমুদ
ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

শেয়ার করুন: