সুচিত্রা সরকার:
মেয়েটি আমাকে বলছিলো আশ্চর্য কণ্ঠে! বলছিলো, কোনো আত্মীয় স্বজন নেই, যে তার কষ্টটা বুঝবে। যার কাছে গিয়ে সে দাঁড়াতে পারে।
প্রশ্নটা সরল কিন্তু অমোঘ। বললাম, তোমার মা কি তোমার পক্ষে?
উত্তর এলো ওপ্রান্ত থেকে- ‘না’!
বললাম, আর কাকে চাইছো পাশে? যার গায়ের গন্ধের সঙ্গে তোমার গায়ের গন্ধের মিল, সে দুরাচারী হলে আর কাউকে খুঁজো না।
একাই লড়ো!
‘লড়াই করো, লড়াই করো, লড়াই, যতদিন না বিজয়ী হও’!
মেয়েটি দীর্ঘ বারো বছর পর আমার কাছে একটা বিষয়ে সাহায্য চাইলো।
কতটা খড়কুটোহীন হলে বারো বছরের ব্যবধান ঘুচিয়ে আসতে হয়!
সমস্যা অসামান্য। মেয়েটির পৈর্তৃক বাড়ি ঢাকার সুত্রাপুরে। যখন গিয়েছিলাম ওদের কয়েকটা ঘর ছিল। আর চারপাশে প্রচুর খোলা জায়গা।
তখনই দেখেছি, চারপাশ থেকে লোকেরা খোলা জায়গাটা দখল করতে চাইছে, আর ওর বিধবা মা, বড় দুই ভাই আপ্রাণ লড়ছে জমিটা ধরে রাখতে!
কিন্তু পারেনি। বেদখল হয়ে গেছে।
বেঁচে গেছে বোধহয় সেই ঘরগুলো। তাও কম নয়। ঢাকা শহরে একটি বাড়ি থাকা কম কথা নয়।
জমিটা ছিল তার দাদুর নামে। বাবার নামে দলিল হয়নি। সুতরাং উত্তরাধিকার আইনে মামলা করে তারা সম্পত্তি পেয়েছে। তো, দুই ভাই সেই মামলায় বোনকে বাদ রেখেছে।
সেই বোনকে, যাকে পাড়ার মাস্তান বা উঠতি যুবকরা ‘ টিজ’ করলে ভাইদের রক্ত গরম হয়ে যেত!
সেই বোনকে, মেলায় হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে গেলে যে ভাইদের পিঠে চড়ার আবদার করতো!
মেয়েটি বললো, ‘ ডিসি অফিস থেকে যখন জানলো, দুই ভাই ছাড়াও পিতার একটি কন্যা সন্তান আছে, ওরা ভাইদের মামলা খারিজ করে দিয়েছে। সেখান থেকে নির্দেশ দিয়েছে বোনকে সম্পত্তির অংশ দিতে হবে।
কিন্তু ভাইদের তাতে আপত্তি। বোনকে কেন দিতে হবে? তারা আরেকটি আবেদন করে, এবং সেটি উকিলের মাধ্যমে।
এবং সবটাই বোনটিকে না জানিয়ে!
ছোট থেকে জমি দখলের খেলা তো দেখেই বড় হয়েছে ভাইয়েরা! সুতরাং বোনকে কীভাবে ঠকাতে হবে, নীলনকশা ‘জিনে’ ঢুকে গেছে!
জিজ্ঞেস করলো, হিন্দু আইনে কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে দিদি?
বললাম, হলে তো জানতাম!
হলে, আমিই একটা মিছিল বের করতাম! আনন্দের মিছিল। স্বর্গ থেকে ‘হেনাদি’ ( হেনা দাস) পরম তৃপ্তিতে হাসতেন!
হিন্দু নারীর সম্পত্তির অধিকার না পাওয়ার অতৃপ্তি নিয়ে মারা গেছেন হেনাদি! সুতরাং খুশি হতেনই।
বললাম, অতো আইনের দরকার নেই। তুমি রবিবার ডিসি অফিসে যাও। জিজ্ঞেস করো কোন আইনে তারা, ভাইদের সঙ্গে তোমাকেও সম্পত্তি দিতে চাইছে। তারপর একজন আইনজীবীর কাছে যাও!’
বললো, ভাই’রা যে পাল্টা আবেদন করেছে, আগামী রবিবার সেই মামলার প্রথম শুনানি। আর সেটি জানিয়েছে গতকাল। গতকাল ছিল সপ্তাহের শেষ ‘ ওয়ার্কিং ডে’।
ভাইরা তবে সম্পত্তি দেবার বেলায় ‘জাত শুয়োরের’ বাচ্চা!
বোনটি অবলা। বোনেরা অবোধ। তারা ইলেভেনথ আওয়ারে আর কী পারে!
বললাম, এখন তো আর উকিল পাবে না। কাগজপত্র গোছাতে একদিন অন্তত তাদের দিতে হয়! আইনে একটা নিয়ম আছে, কেউ উকিল না নিয়ে নিজের পক্ষে নিজেই কথা বলতে পারে! তুমি আদালতে দাঁড়িয়ে বলবে, জানতে না! সময় চাও।
ও নিজেও তাই ভাবছিলো।
তারপর লিপি আপার নম্বর দিলাম।
জানি না এই ‘ সমুদ্রসম ‘ যুদ্ধ মেয়েটি কীভাবে জিতবে! আদৌও সম্ভব কিনা!
রাতের ঘুমটা বেদম ছাড়া ছাড়া ছিল! ঘুম ভাঙতেই মনে হলো- কেন হিন্দু মেয়েরা সম্পত্তির অধিকার পায় না? কেন ছেলেরা সম্পত্তি পায়? উত্তরাধিকার আইনে ছেলেরা সম্পত্তি পেলে, কন্যারা কেন বঞ্চিত হবে?
তারা কি তবে বাবা মায়ের সন্তান নয়? হাজার হাজার সত্যবতীর গর্ভে কোটি কোটি জারজ জন্ম? তারচে তো, ভ্রুণ হত্যা ভাল! হত্যা করে ফেলুন ভ্রুনটিকে মধ্যযুগের মত! নইলে এ জন্ম খুব শ্লাঘার। বড় পাপের হয় – যেখানে ভাইদের আদর চেটেপুটে খাওয়া বোনেরা অবাঞ্ছিত ঘোষিত হয়!
আর যদি সভ্য সমাজের দোহাই দিয়ে ভ্রুণ হত্যা করতে না চান, হিন্দু মেয়েরা নিজেদের ‘জারজ’ ঘোষণা করুক! পিতা মাতা দুজনের পরিচয়ই তারা অস্বীকার করুক!
এই মুহূর্ত থেকে!