ফাহমি ইলা:
নারীরা কাগজে-কলমে অর্থনীতিতে যুক্ত হলো পঞ্চাশ বছর হয়ে গেছে বোধ হয়। একসময় যা ‘পুরুষের কাজ’ হিসেবে বিবেচিত ছিলো, তা এখন নারী-পুরুষের সমান চারণভূমি। মোটা মোটা বই পড়ে শিক্ষিত হয়ে, মগজ খাটিয়ে জ্ঞান অর্জন করে, শারীরিক শ্রমেও সমান দক্ষতা দেখিয়ে নারী প্রমাণ করেছে দুর্বলতার বোগাস টার্ম শুধু তাকে অবরোধবাসিনী করে রাখার কৌশল বৈ কিছুই নয়। এ সমাজ নারীকে ঘরে বন্দী করে লাভবান ছিলো, যেখানে নারীকে মূল্যহীন শ্রমিক হিসেবে পাওয়া যেত।
নারী তো বাইরে বেরিয়ে প্রমাণ করেছে সে একজন দক্ষ মানুষ হবার সকল যোগ্যতা বহন করে। কিন্তু যা ‘নারীর কাজ’ হিসেবে একদা গণ্য হতো, সেখানে কী পুরুষের অবাধ বিচরণ হয়েছে? নারীকে আগে শুধু গৃহস্থালি কাজ করতে হতো, সে হরেক রকম কাজ। তারা মাঠের কাজ করতো বটে, তবে মাঠ জুড়ে ফসলের সোনালী পয়সা যেত পুরুষের থলিতেই। নারীর এতো বাহারি ঘরের কাজের মূল্য পয়সায় রূপান্তর হয়নি আজো। শুধু স্বর্গীয় সম্মানের শুকনো বুলিতে এতোদিন চিড়ে ভিজেছে। পুরুষ আজো তার মেল শোভিনিস্ট ইগো দিয়ে ‘নারীর কাজ’কে আলাদা করে রেখেছে। যেখানে গমন করলে তার পৌরুষ খসে পড়বার ঝুঁকি থাকে। অথচ পুরুষের কাজ বলে খ্যাত সকল কাজেই নারী দেখিয়েছে যোগ্যতা।
যাকে আমরা ঘরের কাজ বা গৃহস্থালি কাজ বলছি সেগুলো করতে কী কোন আলাদা বিশেষ অঙ্গের প্রয়োজন পড়ে? সেই অঙ্গ শুধু নারীর আছে? পুরুষের নেই? তাহলে সেগুলোকে নারীর কাজ হিসেবে ডিফাইন করি কিসের জোরে? সমাজের আর কৃষ্টি কালচারের জোরে। যে সমাজ কৃষ্টিকালচার আবার প্রয়োজনমাফিক কালে কালে রূপ বদলায় অবলীলায়। সমাজের রূপ না বদলালে সভ্যতা সমাজ আদতে আগাতোও না। আমরা সমাজ এগিয়ে নেবার কথা বলি, অথচ হাজার বছরের পুরানো ‘নারীর কাজ’ টার্ম থেকে বেরুতে চাই না। না চাওয়ার পেছনে কারণ হলো-
১| এগুলোর পয়সায় ভ্যালু নাই, আর ভ্যালুলেস কাজ করে সময় নষ্ট করবার মতো সময় কোথা পুরুষের?
২| নারী যেহেতু অধঃস্তন তাই অধঃস্তনদের কাজ করবার মধ্য দিয়ে নিজেকে ছোট করার কি দরকার আছে?
৩| মুখ বুঁজে যেহেতু নারী ঘরের কাজ করছেই, তাতে লাভটা তো পুরুষের। কে আর জলজ্যান্ত লাভ খাওয়া বাদ দিতে চায়?
নারীকে ঘরের বাইরে আনার সময় এ সমাজব্যবস্থার কী একটুও মনে পড়েনি নারীকে আসলে প্রোডাক্টিভ এবং রিপ্রোডাক্টিভ দুটো রোলই পালন করতে হবে? একবারও মনে পড়েনি এতে নারীর বার্ডেন ডাবল হয়ে যাবে? একবারও মনে পড়েনি নারী আরো ভালনারেবল হবে? এ সমাজব্যবস্থা সেসকল চিন্তা না করলেও নারী ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে সে আসলে কতটা দক্ষ, কতটা পারদর্শী! সে এই ডাবল বার্ডেন কাঁধে চাপিয়ে হেঁটে চলেছে সামনের দিকে। তারপরেও তাকে ন্যূনতম পিছলে পরা, হোঁচট খাওয়ার ভয় পেতে হয়। কেননা তার দিকে তাকিয়ে থাকে কোটি কোটি পুংচোখ। এতোটুকু চ্যুতি ঘটলে তাকে দায়ী করা যাবে কেলেংকারির কালিতে।
নারী আসলে প্রকৃত অর্থেই স্বাবলম্বী হবার উপযুক্ত। যে ঘরের কাজ বাহিরের কাজে সমান পারদর্শী। পুরুষ ঘরের কাজে মারাত্মকভাবে নির্ভরশীল। সে নির্ভরশীলতা নারীর প্রতি কিংবা বাজার ব্যবস্থায় কিনতে পাওয়া যায় শ্রমের প্রতি। অথচ এ কাজগুলো বাদে সভ্যতা সংজ্ঞার স্তম্ভে দাঁড়িয়ে থাকাও সম্ভব নয়।
দাম্ভিক পুরুষের উচিত নিজের পৌরুষ বাঁচাতে আত্মনির্ভরশীল হওয়া। একই সাথে আদিম কুৎসিত পিতৃতান্ত্রিক ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের আধুনিক প্রগতিশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাও জরুরি। যেহেতু নারীর বাইরে যাওয়ার সাথে সাথে সমাজের বদল ঘটেছে, সেহেতু পুরুষের উচিত এ বদলকে মানিয়ে নেয়া। পুরুষের উচিত ঘরের কাজগুলোকে ভাগাভাগি করে নেয়া। পুরুষের উচিত আদিম ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে যুক্তিযুক্ত শিক্ষিত হওয়া।