সুপ্রীতি ধর:
একজন বোরকা পরা মা তার মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে ক্রিকেট খেলছেন, আপাতদৃষ্টিতে ছবিটি নিরীহ এবং গুরুত্বপূর্ণ। একজন মা তার সন্তানকে খেলাধুলায় উৎসাহ দিতে নিজেই ব্যাট হাতে নিয়ে নেমে পড়েছেন, এটা তো অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তাই না? কিন্তু ছবিটা কি আসলেই নিরীহ বা নৈর্ব্যক্তিক? তাহলে ভাইরাল হলো কেন? এটা বোঝাতে যে এই মা কতবড় আদর্শ মা, যে কিনা ছেলের জন্য সব করতে প্রস্তুত? নাকি বোরকাও যে কোনো মাকে আটকে রাখতে পারে না বা বোরকাও যে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না ছেলের স্বপ্নপূরণের সাথী হতে, সেইসব তত্ত্ব কপচানোরই নামান্তর মাত্র? নাকি এই বোরকা পরা মা আর মাদ্রাসা পড়ুয়া ছেলের ছবি বর্তমান বাংলাদেশের ইঙ্গিত দেয়?
ছবিটা যদি আজ পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের হতো, এই আমরাই কিন্তু বাহ্বা দিতাম। কারণ আমরা ওই দেশ দুটির সামাজিক প্রেক্ষাপটটা জানি। সেখানে নারীর অবস্থান কী, তা জানি। কিন্তু দেশটা যেহেতু বাংলাদেশ, তাই এর ঐতিহাসিক দিকটা মাথায় থাকে বলেই প্রশ্ন উঠে। সমালোচনা হয় কারণ আমরা ক্ষুব্ধ হই। কষ্ট লাগে ভেবে যে কী দেশ আমরা চেয়েছিলাম একাত্তরে, আর কী দেশ হলো গত ৫০ বছরে! আজকে এই বোরকা পরা মা’কে সমালোচনা না করে প্রশ্ন করা উচিত ছিল, এই মায়ের শরীরে এমন পোশাক কেন উঠলো? কীভাবে উঠলো? কত বছরে উঠলো? কাদের তোষামোদী রাজনীতির বলি হচ্ছে আমাদের জনগণ?
কেউ কেউ বলছেন, ছবিটা দেয়াই হয়েছে পলিটিক্যাল পয়েন্ট থেকে। এ নিয়া এতো আহ্লাদের কোনো কারণ নেই। আবার সেই যুক্তি খণ্ডন করে কেউ বলছেন, এইটা পলিটিক্যালিই খুবই পজিটিভ একটা ছবি। বোরখা পরা নারী বোরখা ছাড়া নারী, সব নারীকেই ওওন করতে হবে। বোরখা পরলে কেন তারা আর আমাদের থাকে না, আদারস হয়ে যায়, এই ভাবনা ভাবাটা জরুরি। কেউ বলছেন, এসব ছবি পুশ করা হয় যাতে করে ধীরে ধীরে একটা এক্সপেটেন্স তৈরি হয়ে যায় সমাজে। পড়ালেখা বা পেশায় ভালো করার সাথে হিজাবের যে দ্বন্দ্ব নেই তা বোঝাতে অনেক মিডিয়াই ধারাবাহিকভাবে এগুলো ছাপিয়ে যাচ্ছে।
খুবই যৌক্তিক ভাবনাগুলো। আরও অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। মূলধারার গণমাধ্যমে ছবিটা যেহেতু বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে, তাই ভাবনার অবকাশ আছে। তাছাড়া এটি কেবল যে ভাইরাল হয়েছে তাই নয়, এর পক্ষে মনে হচ্ছে একদল পঙ্গপালকে অনলাইনে মোতায়েন করা হয়েছে সৈনিক হিসেবে। তারা সদলবলে হামলে পড়ছে সেইসব আইডিগুলোতে, যারা ছবিটার সমালোচনা করে দুই-চার লাইন লিখছে। অনেকদিন পর মনে হয় অনলাইন সরব হলো। তাও এমন একটা ছবি নিয়ে, যা কিনা সত্যি সত্যিই অনেকগুলো প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। ছবিটার নানান অর্থ করা যায়। ধর্মীয় অর্থের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক অর্থও করা যায় ছবিটার। এবং তাই করছে সবাই।
কেউ বলে না দিলে ছবিটি আমিও আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের কোনো এক প্রদেশের বলে ভেবে নিতাম। এর আগে একবার বোরকা পরা মেয়েদের একটা ছবি শেয়ার করেছিলাম আমার টাইমলাইনে, কোনো একটা স্কুলের ছবি ছিল তা। ওটা দেখে আমার এক ইয়েমেনি বন্ধু মন্তব্য করেছিল, ‘এটা কি তোমার দেশের ছবি? আমি ভেবেছিলাম আমার দেশের’।
আমার সাথে এখানে বেশ কয়েকজন আফগানি এবং সিরিয়ান মেয়ে পড়ে ভাষা ক্লাসে। সিরিয়ান দু’একজন ছাড়া সবাই হিজাব পরে। কিন্তু এদের বেশিরভাগই সাইকেলে করে বা গাড়ি চালিয়ে ক্লাসে আসে। দারুণ স্মার্ট। স্কুল প্রাঙ্গনে ধর্ম, রাজনীতি নিয়ে কথা বলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এখানে। নোটিশ টাঙানো আছে এ নিয়ে। তো, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একদিন জানতে চেয়েছিলাম হিজাব কেন করে? সবাই একসাথে বলে উঠেছিল, তারা মুসলমান, তাই হিজাব করে। ইসলামে বলা আছে, তাই তারা এটা করতে বাধ্য। আমি বললাম, পুরুষরা কেন হিজাব পরে না? তোমাকেই কেন ঢেকে রাখতে হবে সব? তোমার শরীর যদি পুরুষের সমস্যার কারণ হয়, তাহলে পুরুষ কেন তার চোখ ঢাকে না? ওরা কোনো উত্তর দেয়নি। আবার এসব উদারমনা, গণতান্ত্রিক দেশে, যেখানে সবারই নাকি বাক্ স্বাধীনতা আছে, সেখানেও কারও ‘ব্যক্তিগত চয়েজ’ নিয়ে প্রশ্ন করা যায় না, তাই আর কিছু জানা হয় না ওদের কাছ থেকে।
ফিরে আসি বাংলাদেশের ছবিটার প্রসঙ্গে। দেখলাম যে কেউ কেউ এই ছবিটির পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে পোশাকের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতার কথা বলছেন। বলছেন যে, ওই পোশাকে ওই নারীর যদি সমস্যা না হয়, তবে অন্যের কী? আজকাল অনেক নারী নিজেই এই পোশাকটা বেছে নিচ্ছে তাদের কাছে ‘আরামদায়ক’ উল্লেখ করে। সেইরকম মন্তব্যও নজরে এসেছে যারা নিজেরাই বোরকা বা হিজাব পরার কারণ হিসেবে নিজেদের চয়েজ এবং আরামের কথা বলেছেন। তারা কেউই বলছে না যে এটা তাদের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, এবং সেটা হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে এইদেশে এই কালচার আমদানি আর উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে। ধর্মের আফিম খাইয়ে পুরো দেশকে লেজেগোবরে করে কোন পথে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠাটা উচিত ছিল।
আবার আরেক পক্ষ সরাসরি ওই নারীকে তো গালমন্দ করেছেই, সেইসাথে দুনিয়ার তাবৎ হিজাবি নারীদেরও সমালোচনা করছে। তাদের ভাষাটাও যে কোনো সুরুচির পরিচয় দেয়, তা নয়। মোটামুটি কদর্য ভাষাতেও কয়েকজনকে সমালোচনা করতে দেখলাম। এটাও কাম্য নয় মোটেও। কারণ আমরা কেউই কিন্তু মেয়েটার সামাজিক অবস্থানটুকু সম্পর্কে জানি না। সুতরাং ‘জাজ’ করা আমাদের মানায় না। হয়তো সে বাধ্য হয়েছে বা নিজেই বেছে নিয়েছে এই পোশাকে নিজেকে মুড়িয়ে রাখার জীবন, আর সন্তানকে সাধারণ স্কুলে না দিয়ে মাদ্রাসায় হয়তো দিয়েছে সেই একই কারণে। তবে বাধ্য হলেও যে সে চায় তার সন্তানটি খেলাধুলা করে ‘স্বাভাবিক’ একটা জীবন পাক অন্য আর দশজনের মতোন, তাও কিন্তু স্পষ্ট।
আমার একটা ব্যক্তিগত অভিমত আছে এমন ক্ষেত্রে। সেটা হচ্ছে, অবশ্যই যার যার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, রুচি আছে নিজের পোশাক বা অন্য যেকোনো কিছু নির্বাচনে। তারই অংশ হিসেবে যে কেউ স্বল্পবসনা যেমন হতে পারে, তেমনি কেউ অধিকবসনাও হতে পারে। সমস্যাটা কোথায়? ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো সমস্যা হয় না হিজাবি বা বোরকা পরা মেয়েদের নিয়ে। আমি নিজে মডারেট ধরনের। যা পরলে আমার আরাম হবে, আমার গতিরোধ হবে না, কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে না, সেটাই আমার পোশাক। তবে অন্যের কৌতুহলের কারণও আমি হতে চাই না। আর তাই দেশে থাকতে আমার ‘সোকলড সংস্কৃতি’র সাথে যায় না বা কৌতুহল উদ্রেককারী পোশাক যেমন আমি পরিনি, তেমনি বিদেশে এসেও শাড়ি বা সালোয়ার কামিজও খুব একটা পরা হয় না কেবলমাত্র অন্যের চোখে যাতে আলাদা না মনে হয়, সেই কারণেই। আবার আবহাওয়াও একটা বড় ফ্যাক্টর পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে। শীতের দেশে শীতকালে যেমন সবাইকে ঢেকেঢুকে আড়াই মণি হয়ে চলতে হয়, তেমনি স্বল্পকালীন গ্রীষ্মের ওই কয়টা দিনে হালকা পোশাক পরতেই পছন্দ করে সবাই। আবার মধ্যপ্রাচ্য বা মুসলিম দেশগুলো থেকে আসা নারীরা তাদের পছন্দমতো হিজাব পরেই চলে ওই গরমেও। হিজাব পরে তারা সুইমিং পুলেও নামে।
আলোচনায় ধর্মীয় দিকটা উহ্য রাখতে চাইলেও সম্ভবপর হয় না। কারণ গত এক থেকে দেড় দশকে বাংলাদেশে যে আমূল বিপ্লব ঘটে গেছে হিজাবিয়ানাতে, সেটার পিছনের কারণটা নিয়ে কেন জোরালো কোনো আলোচনা হয় না? এই যে বসুন্ধরা মার্কেটে একটা পুরো ফ্লোরই মেয়েদের নানা ডিজাইনের হিজাব বা বোরকা বিক্রি করে, সেটা কি একদিনে হয়েছে? এতোবড় মার্কেটে একটাও বইয়ের দোকান নেই, অথচ প্রবেশ পথেই এক কোণায় দেখবেন ইসলামি নানা কিতাব বিক্রি হতে। তো, এই পণ্যের চাহিদা কি একদিনে তৈরি হয়েছে? তাতো হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে পুশ করা হয়েছে এই জিনিস। ধর্মের ‘বাড়াবাড়ি’র সাথে এই পোশাকেরও বাম্পার ফলন হয়েছে। অনেকেই এই বিষয়টাকে মোটেও ‘থ্রেট’ হিসেবে দেখে না, তারা প্রশ্ন করে না, বরং তারা একসাথে পথচলার কথাই বলে বার বার। এই যে বিভেদ মানুষে মানুষে, এর ভবিষ্যত আসলেই কী?
হিজাব বা বোরকায় আমার যতোটা না ধর্মীয় বিভেদের কথা মাথায় আসে, তার চেয়েও বেশি আসে একটি মেয়ের অসহায়ত্বের বিষয়টি। ভয়াবহ গরমের দেশে আপাদমস্তক কাপড়ে জড়িয়ে কেউ যদি বলে সে ‘আরাম’ পাচ্ছে, আমি বিশ্বাস করি না। তার চলাফেরাও তো বাধাগ্রস্ত হওয়ার কথা! অনেকগুলো ভঙ্গিমায় তোলা ছবিগুলো দেখলাম, আর মায়া লাগছিল আমার। মেয়েটি যদি নিজেই তা পরে থাকে, তাহলেও প্রশ্ন থেকেই যায়, তাকে এটা পরতে উৎসাহিত করলো কে বা কোন আদর্শ? নিশ্চয়ই তার ভেতরে এই বিশ্বাসটা ঢুকানো হয়েছে নানা উপায়ে, তাই না? তো, সেই বিশ্বাসটা তো অবশ্যই ধর্মীয় বিশ্বাস। এবং ধর্ম হচ্ছে পুরোটাই পুরুষতান্ত্রিক। পুরুষ তাদের নিজেদের প্রয়োজনে ধর্মগ্রন্থ লিখেছে, বিধান জারি করেছে, মেয়েদেরকেও মুড়িয়ে দিয়েছে তার নিরাপত্তার কথা বলে। এটাই কি সমাধান? পোশাক কি কখনও নারীর নিরাপত্তা দিতে পারে? দিয়েছে কখনও?
সব কথার শেষ কথা, একজন নারী যতদিন না নিজের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করতে শিখবে, নিজের ভালোমন্দ বুঝে নিতে না শিখবে, যতদিন না এসব শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে চাইবে, ততদিন এরকম ছবি আমাদের দেখে যেতেই হবে। আর তার চেয়েও বড় কথা, সিস্টেমটা ভেঙে নতুন করে গড়তে হবে সবকিছু, আর কোনো উপায় নেই।