মুসাররাত নাজ:
নিজেই নিজের দায়িত্ব নিতে সক্ষম একজন নারী যতক্ষণ একা, ততক্ষণ তার যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে থাকেন।
যদি বিবাহিত না হন এবং যার বাবা-মাও গত, তাকে কি আর কারও কাছে কৈফিয়ত দিতে হয়? যদি একা বসবাসকারী নারী নিজে নিজের দেখভাল করতে পারেন, নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, নিজেকে বিপদাপদ থেকে রক্ষা করে চলতে পারেন, তাহলে শুধু বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করলেই কেন এই নারীকে অনুমতি নিতে হয়? কৈফিয়ত দিতে হয়? বিয়ের পরেই কি নারী ভুল করতে থাকে? বিয়ের পর কি নারীর বুদ্ধি লোপ পায়? বিচারক্ষমতা বা সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা লোপ পায়?
বিয়ের আগে বাবা-মাকে মান্য করে জীবন চালাতে হয়। সেখানেও কিছু ছাড় পাওয়া যায়। কিন্তু স্বামীর বেলায়? বা শশুরবাড়িতে? বিনা অনুমতিতে কোনো কিছু করলে এবং তা যদি স্বামীর অপছন্দ হয় তো তাকে কী পরিমান শাস্তি আর দুর্ভোগ পোহাতে হয় তা আশা করি নারী মাত্রই জানেন।
ভেবে দেখুন তো, অনুমতি নেয়া না হলে কোনো কাজ কি আপনি স্বাচ্ছন্দ্যে করতে পারেন? শুধু স্বামী কেন, শ্বশুরবাড়ির প্রায় সকলেই মেয়েটির কোনো একটা মতামতে বা কাজে বাগড়া দেবার ক্ষমতা রাখেন। শুধু নারীর নিজের তা পারতে নেই।
একটা নতুন জীবন শুরু করার পর ঠিক কোন বিষয়টা একজন নারীকে সবচেয়ে বেশি ভাবায়? জানি বেশির ভাগ জবাব আসবে স্বামীর মেজাজ মর্জি কেমন হবে, তিনি কতটা ছাড় দিবেন এবং তার পরিবার কেমন হবে, এই তিনটি বিষয়।
নিজের চেয়ে বয়সে বড় স্বামী, সমবয়সী স্বামী, প্রেমিক থেকে হওয়া স্বামী, এরেঞ্জ মেরেজের স্বামী অথবা নিজের চেয়ে বয়সে ছোট স্বামী, ঘরজামাই স্বামী, শিক্ষিত স্বামী, অশিক্ষিত, শারীরিকভাবে অক্ষম স্বামী, উপার্জনে অক্ষম স্বামী, বিকলাঙ্গ স্বামী— স্বামী যেমনই হোক, স্বামীকে নারী ভয় পায়। পেতে হয়। ক’জন নারী বলতে পারবেন যে ভয় লাগে না? চাইলে দ্বিমত করতেই পারেন, তবে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন তো, আপনি কি আপনার প্রতিটি স্বাধীন পদক্ষেপ নেবার আগে একবার ভাবেন না যে স্বামী কী মনে করবে? রেগে যাবে না তো?
সামাজিকভাবে আপত্তিকর কিছুতে অথবা যদি সত্যি তেমন ভুল কিছু করে ফেলছে বুঝতে পারে, বর আপত্তি জানাতেই পারে।
কিন্তু সাধারণ কেনাকাটা, হুট করে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার ইচ্ছে, হয়তো কোনো দাওয়াতে যাবে কিনা বা একা যাওয়া, নিজ বাড়িতে আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবীদের আমত্রণ জানানো, কাউকে কিছু কিনে দেয়া, সোনার গয়নার ফ্ল্যাটর বাড়ি, সন্তানের নাম, সন্তান কোন স্কুলে পড়বে, ধর্ম শিক্ষা, ইত্যাদি সাধারণ বিষয়েও স্বামীর অনুমতি না নিলে নারীর রীতিমতো ভয় হয়।
একজন পুরুষ যে বয়সেই বিয়ে করুক না কেন, অভিজ্ঞতা থাক বা না থাক, বিয়ের পর সে চাইলে স্ত্রীর বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিয়ের পর নারী পড়াশুনা করবে কিনা! চাকরি করবে কিনা! শ্বশুরবাড়ি থাকবে নাকি স্বামীর সাথে তার কর্মস্থলে, এখনই সন্তান ধারণ করবে না আরও পরে, কোন আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ করবে, কার সাথে করবে না, কতদিন বাপের বাড়ি থাকতে পারবে, তার পোশাক কেমন হবে, তার খাদ্যাভ্যাস, সাজসজ্জা, এমনকি ঘুমের সময়টুকু পর্যন্ত ইত্যাদি সব বিষয় বরের ইচ্ছেটাই প্রধান। এটা না মানলে নারী হয়ে যায় বেয়াদব, উচ্ছৃঙ্খল, সংসারে অমনোযোগী, উড়নচণ্ডী ইত্যাদি ইত্যাদি। আর কমন একটা বাক্য শুনতে হয়। তা হলো — বাপ মা কোনো শিক্ষা দেয় নাই।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুজন মানুষ একসাথে বসবাস শুরু করে শূন্য সাংসারিক অভিজ্ঞতা নিয়ে। কিন্তু স্বামী হয়ে যায় অভিভাবক। আরও একটু বাস্তবসম্মত করে বললে বলতে হয় পুরুষের আচরণটি হয় মনিবের মতো। মনে হয় নারী তার ক্রয়কৃত দাসী। তার হাতে থাকে সব ক্ষমতা। তার ইচ্ছেমতো চলতে হয়। এবং তার পছন্দ না হলে, শাস্তি দেবার ক্ষমতাও তিনি বিয়ে হওয়ার সাথে সাথে পেয়ে যান। কে দেয় এই ক্ষমতা? সমাজ? পরিবার? নারী নিজে?
কেন এবং কবে থেকে এই অনুমতির নিয়ম তৈরি হলো ঠিক জানা নেই। তবে ধারণা করা যায় প্রাচীন কাল থেকে নারীকে হুকুমের দাস করে রাখার প্রবণতা এর জন্যে দায়ী। একটা সময় নারীকে মানুষ বলেই তো মনে করা হতো না। শিশুকালেই কন্যাকে বিয়ে দিয়ে কন্যাদায়গ্রস্ততা থেকে মুক্তি নিতো বাবা-মা। কন্যাকে শিক্ষা দান করা যায় এটাই হয়তো জানতো না। বিয়ের পর স্বামী নারীর ভরণপোষণ করতো। স্বামী হতো কন্যার বয়সের তিনগুন। শিশুকাল থেকে একটা অন্য পরিবারের কড়া শাসনে থাকা এবং বহির্জগত সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় নারী নিজেকে অসহায় ভেবে এসেছে। এবং পুরুষের সাহায্য ছাড়া কিছু করার কথা ভাবতেই পারতো না। এ অবস্থায় স্বামীর হুকুমের অপেক্ষায় এবং তার সাহায্যে জীবন চালানোই নিরাপদ ও বুদ্ধিমানের কাজ বলেই নারী মনে করতেন। এটাই কি এখন মজ্জাগত?
বর্তমানে নারী নানাদিকে নিজেকে মেলে ধরে উন্নতির শিখরে পৌঁছালেও মানসিকভাবে কেন স্বামীকে মনিব ভাবার এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না, কে জানে! আর কতদিন একজন নারীকে জীবনসঙ্গীর ভয়ে ভীত হতে হবে? নারীর এই মানসিক মুক্তি কি মিলবে না? নাকী এটাও পুরুষ কর্তৃক উপহার হিসেবে আসলে নারী খুশি মনে তা গ্রহণ করবে?
মুসাররাত নাজ
২৪ শে জুলাই, ২০২২