জীবিত নাঈমাদের পাশে দাঁড়ানোর এখনই সময়

সুপ্রীতি ধর:

আমরা নারী অধিকার আন্দোলনে যারা কাজ করি, সবাই নারীর জন্য একটা সমতাপূর্ণ বিশ্ব গড়ার কথা বলি, শ্লোগান তুলি, দাবি জানাই। বছর বছর সেই লক্ষ্যে অনেক টাকা বরাদ্দ হয়, নারী সংগঠনগুলো কাজও করে সেই টাকা দিয়ে। খালি চোখে আমরা কিছু ‘নারী উন্নয়ন’ও দেখতে পাই, যেগুলোকে আমরা বইয়ের ভাষায় ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ বলে অভিহিত করি।

১৯৭৬ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নানা বেসরকারি সংগঠন নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। আর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কাজ করছে স্বাধীনতারও আগে থেকে। মোটামুটি ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন সংগঠনের সাথে পরিচয় থাকা এবং পথচলার কল্যাণে নারী অধিকার, নারীর অসম মর্যাদা, বৈষম্য, নারী নির্যাতন এবং এসব থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে যেসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় তার সাথে কমবেশি সুপরিচিত। নিজেই এসব কর্মকাণ্ডে নানাভাবে অংশগ্রহণ করেছি, এবং ভেবেছি, যাক, কিছুটা হলেও তো অবদান রাখছি! তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা আর কী! কিন্তু আজ একজন শিক্ষিত, স্বাবলম্বী নাঈমা নার্গিসের এভাবে চলে যাওয়ার পর আমাদের কর্মকাণ্ডের পুরো প্রক্রিয়াটাই এখন পর্যালোচনার দাবি রাখে। কী আমরা করতে চেয়েছিলাম, কী করতে চাই, কীভাবে করতে চাই!

আসলে এই ‘সমতার বিশ্ব’ শব্দটা কতোটা বাস্তবসম্মত? কতোটা মিথ? নারীর ক্ষমতায়ন আসলে কোথায় নিহিত? একমাত্র অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায়? কোনরকম পরিসংখ্যান না দিয়েও তো আমরা সবাই জানি অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ কীরকম উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বেড়েছে গত কয়েক দশকে! বলা চলে, নারী এখন রাষ্ট্রের অর্থনীতির অন্যতম সচল চালিকাশক্তি। তারপরও আমাদের নারীর অবস্থান কোথায়? নারীর মর্যাদা কি বেড়েছে কোথাও? কেন একজন নারী, একজন মা দশ মাস সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেও অভিভাবক হতে পারছে না? কেন একজন মা তার সর্বশক্তি দিয়ে সন্তান বড় করার পরও সেই সন্তান তার হয় না? কেন সেই ফেলে যাওয়া, পালিয়ে যাওয়া স্রেফ বীর্যদাতা ওই সন্তানের অভিভাবকত্ব পাবে?

আজ আমরা আমাদের বন্ধু, সহকর্মিকে হারিয়ে ফেলেছি। এটা মেনে নেয়া ভীষণ কষ্টের আমাদের। বিশেষ করে যারা প্রতিনিয়ত এই লড়াইয়ের মধ্যে বেঁচে আছি তারা তো জানি এই অসম যুদ্ধ মানসিক ও শারীরিকভাবে কতোটা পঙ্গু করে দেয় একজন মাকে। তাই বলছিলাম যে এই ক্ষত কাঁচা থাকতেই অন্য এক সিংগেল মাকে মানসিক বা শারীরিক হত্যার আগেই আমরা সোচ্চার হই। একজন মায়ের নাড়ি কেটে যে সন্তানকে আলাদা করা হয়, সেই মায়ের প্রতিটি মুহূর্তের অনুভবে সেই সন্তান তার শরীরের অংশ হয়ে বেঁচে থাকে। সুতরাং সন্তানকে ছিঁড়েখুঁড়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার এই বীভৎস অধ্যায়ের রাশ টানতে হবে এখনই। সম্ভব হলে সেই অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। একেবারেই তা না পারলেও যেন জীবনভর সে তার কৃতকর্মের রেশ টানে, সেই ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হবে।

নারী অগ্রগতির সূচকে আমরা আশপাশের দেশকে টপকে গেছি, অথচ আইন মাকে সন্তানের অভিভাবকত্ব দেয়নি। বরঞ্চ একজন মাকে আদালতের বারান্দায় দৌড়াতে দেখতেই ভালবাসে রাষ্ট্র। বীর্যদাতাকে করা হয়েছে ন্যাচারাল গার্ডিয়ান। কী প্রহসন! যে রাষ্ট্র এতো বড় অন্যায় নারীর উপর জারি রাখে, সেখানে এসব মৃত্যু নিয়ে স্রেফ কথার কথা না বলে মাঠে নামতে হবে। এখনই সময়।

আফরোজা চৈতীর কথার রেশ ধরেই বলতে চাই, আসুন, জীবিত নাঈমাদের জন্য হলেও অভিভাবকত্ব আইন ও নারীকে তার আপন সন্তানের কাছ থেকে দিনের পর দিন দূরে সরিয়ে দেবার যে রাজনীতি, যে বাস্তবতা, যে অসহায়ত্ব, সেই মায়েদের জন্য আইন সংশোধনের জন্য লড়াইটা করি। আগুনে ঝলসে মেরে ফেলা অথবা পিটিয়ে মেরে ফেলার তো আইনগত সমাধান আছে, কিন্তু যে নারীদের শুধুমাত্র পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখতে পারে না বলে প্রতিদিনের মৃত্যুর সমন দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়া হয় সেই নারীদের জন্য আইন হোক, সেইসব হিংস্র মানুষগুলোকে আইনের আওতায় আনা হোক যারা সন্তানের সাথে মায়ের বিচ্ছেদকে উৎসাহিত করে, যারা মায়ের সাথে সন্তানের দূরত্বে হাততালি দিয়ে পাশবিক হাসি হাসে।

 

সুপ্রীতি ধর, প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক উইমেন চ্যাপ্টার

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.