‘মাদ্রাসায় আমি যেভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছি’

মোস্তাকিমবিল্লাহ মাসুম:

আমি কীভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছি, সেটাই বলতে চাচ্ছি।

আমি আমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর সর্বশেষ সন্তান। আমার জন্মের পর ৩-৪ বছরেও আমি কথা বলতে পারিনি। সেকারণে আমার মা সর্বক্ষণ তটস্থ ছিল আমাকে নিয়ে। কোনো একদিন রাতে আমার মা তার নামাজ শেষ করে মোনাজাতে তার ইশ্বরের নিকট প্রার্থনা করে এবং মানত করে যে, তার ছোট সন্তান যদি কথা বলতে শিখে, তাহলে সে তার এই সন্তানকে কওমি মাদ্রাসায় পড়িয়ে কুরান মুখস্ত করাবে। কিছুদিন পর আমি কথা বলতে শুরু করি। এবং এরপরেই তাদের জন্য তাদের মানত রক্ষা করাটা ওয়াজিব হয়ে যায়।

মোস্তাকিমবিল্লাহ মাসুম

যাই হোক, আমার বয়স যখন ৭ কিংবা ৮, তখন আমাকে বগুড়ায় নিশিন্দারা একটা কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়। আমি সেখানে এক বছর পড়াশুনা করে, ক্বায়েদা এবং আমপারা পড়া শেষ করি। তারপর সেখানে থেকে আমাকে বগুড়ার হাকিরমোড় নামক স্থানের এক মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়, সেখানে আমি ছয় বছর কাটিয়ে মক্তব এবং হিফজ শেষ করি। আমার যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতাটা এই মাদ্রাসায় পড়াকালীনই, তাই একটু খোলাসা করেই লিখলাম।

আমি দুটো মাদ্রাসাতেই ছেলেদের হাতে মোলেস্টেশনের শিকার হই। প্রথম যে মাদ্রাসায় ছিলাম সেখানে আমি তিনজনের দ্বারা মোলেস্টেড হই। এই মাদ্রাসায় যে রুমে থাকতাম, সেই রুমে আমার সাথেই আরো ৪-৫ জন থাকতো। এই ৪-৫ জনের মাঝেই একজন একটু শারীরিক অবয়বে একটু বড় ছিল আমাদের তুলনায়। তাকে আমাদের রুমের শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বভাবতই সে দায়িত্ব পেয়ে সবসময় মোড়লগিরি দেখাতে থাকে। তার এই মোড়লগিরি সবাইকে সহ্য করতে হতো না। শুধুমাত্র যারা শারীরিকভাবে দুর্বল, তাদেরই এধরনের পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতো।

আমি জন্মগত রোগা একটা ছেলে বলে আমাকে বেশ ধকল পোহাতে হতো। আমি যে খুব একটা প্রতিবাদী ছেলে, এমন না। প্রতিবাদ করার মতো সাহস খুব বেশি আমার নেই। কিন্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে কিছু করার থাকে না। একবার এজন্য ওর এই কীর্তিকলাপের কথা হুজুরদের জানিয়ে বলেছিলাম, রুম চেঞ্জ করবো। রুম তো চেঞ্জ হয়ইনি, উলটো ওকে কিছু গালিগালাজ করে ছেড়ে দেয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে শাস্তি।

ও আমার এই প্রতিবাদ মেনে নিতে পারে না। একদিন বিকেলে আমাকে ওর সঙ্গের আরেকটা ছেলেকে (যাকে আমি ভালো মনে করতাম) দিয়ে ছাদের চিলেকোঠায় (যেখানে একটা লোহার খাট ছিল, খাদেমদের জন্য) ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে আমি ওকেসহ তিনজনকে দেখি। ওরা আমাকে প্রথমে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে থাকে, তারপর আমি কেন হুজুরদের বলছিলাম, এটা জিজ্ঞেস করে।
তারপর বলে “তোর শাস্তি হবে।” এরপর ওরা আমাকে দুহাত দুদিকে বাঁধে। আমি ভেবেছিলাম ওরা আমাকে মারবে। কিন্ত এরপরে যেটা হয়, সেটা আসলে একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। ওদের দুজন আমার দুই পা দুদিকে ধরে থাকে, এবং একজন আমার শরীরের উপরে তার স্টিমরোলার চালাতে থাকে। এভাবে একে একে তিনজনই মনোবাসনা পূরণ করে।
আমার মলদ্বার ফেটে যায়। এবং বেশ ভালোভাবেই জায়গাটাতে জখম হয়। এরপর তাদের পক্ষ থেকে আমাকে বলা হয়, এটা নাকি তারা আমাকে শিক্ষা দিল। আমি যে হুজুরকে বলে দিয়েছিলাম, এতে বড়দের প্রতি অশ্রদ্ধা হয়েছে, তাই ইসলাম অনুসারে ছোটদের এভাবেই নাকি আদবকায়দা শিক্ষা দেওয়া হয়। আর এই শিক্ষা দেওয়ার ঘটনা যদি আমি বাসায় কিংবা হুজুরদের জানাই, তাহলে নাকি আমি জাহান্নামের বাসিন্দা হবো। বলাই বাহুল্য ছোট্টবেলায় সেই আমি জাহান্নামকে বেশ ভয় পেতাম, তাই এগুলো কোথাও বলা হয়নি। ইন ফ্যাক্ট, আমার কাছের ২-৩টা ফ্রেন্ড বাদে এই ঘটনা আজতক কেউ জানেনি। আজকের পর থেকে সবাই জানতে পারবে।

এই ঘটনার কিছুদিন পর আমাকে এই মাদ্রাসা থেকে অন্য একটা মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয় হাকিরমোড়ের, পড়াশুনা ভালো হচ্ছে না এই কারণে। এই মাদ্রাসায় আমি দুইবার মোলেস্টেশনের শিকার হই। প্রথমবার একটা ছাত্র, এবং দ্বিতীয়বার একজন হুজুরের দ্বারা।
প্রথমবার যে ছাত্রের দ্বারা আমি মোলেস্টেড হই, সে আমার বড় ছিল, এবং পড়াশুনার দিক দিয়েও আমার চেয়ে এগিয়ে ছিল। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে ঐ মাদ্রাসায় একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, সুন্দর এবং দুর্বল ছেলেদের সাথে অনেকেই বন্ধুত্ব করতে চাইতো এবং এই বন্ধুত্বের সুযোগে তারা অ্যানাল সেক্স করতে চাইতো, যার নাম দিয়েছিল তারা ‘প্রেম’। এই ছেলেটিও আমার সাথে সেই উদ্দেশ্যেই একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে। আমাকে সে সবসময় বেশ খাতির করতো। আমি যদিও ওকে তেমন গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু সে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।
এক রমজান মাসের রাতে আমাদের তারাবি পড়ানো হচ্ছিল। সেই তারাবির নামাজ পড়তে পড়তে কিছুক্ষণ পর আমার প্রস্রাবের বেগ পায়, আমি নিচে কাজ সারতে আসি। আমি জানতাম না, ও নিচেই ছিল। আমি যে বাথরুমে ঢুকবো, সেখানে ও আগে থেকেই ঢুকে বসে ছিল। আমি গিয়ে বাথরুমের লাইট অন করে ভিতরে গিয়ে দেখি, ও ভিতরে, আমার মুখে হাত দিয়ে আমাকে ভিতরে ঢুকে নিয়ে ও দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি চিৎকার করতে পারিনি, যদিও আমি বুঝতে পারছিলাম, কী ঘটতে চলেছে আমার সঙ্গে। যথারীতি সে আমার হাত-পা ভালো করে ধরে, একটা কাপড় দিয়ে বাঁধে এবং একটা রুমাল আমার মুখে ঢুকে দেয় যেন চিৎকার না করতে পারি। এরপর সে তার কাজ সারে। ততোদিনে আমি জেনে গেছি, এটা একটা অপরাধ হলেও ঐ মাদ্রাসার রক্ষকেরাই তখন ভক্ষক, তাই বিচার পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।

ফাইনালি ঐ মাদ্রাসার এক ভক্ষকরূপি হুজুরের দ্বারাই সেইম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে আমার সাথে। এই হুজুরটা যদিও বেশিদিন আমাদের মাদ্রাসায় টিকতে পারেনি। কিন্ত যে ক’দিন ছিল, তার হাতে বেশ কিছু স্টুডেন্টই মোলেস্টেশনের শিকার হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই তালিকায় আমার নামও আছে। মূলত ঐ হুজুর প্রত্যেক রাতে একজন করে স্টুডেন্টকে টার্গেট করতো। তার কিছু বাঁধা স্টুডেন্ট ছিল, যারা ছিল তার সমস্ত অপকর্মের সহযোগী। তাদের দ্বারা সে তার টার্গেটেড স্টুডেন্টদের ফুসলিয়ে ডেকে আনার ব্যবস্থা করতো। আমি এগুলো পরে জানতে পারি।

যাই হোক, এরকমই কোন একদিন রাতে আমি খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমানোর আয়োজন করছিলাম। দিনটা সম্ভবত গরমের সময়। যথেষ্ট গরমের দিন ছিল। আমাকে ঐ হুজুরের এক বাধা স্টুডেন্ট এসে বললো, সেভেনআপ খাবো কিনা, হুজুর খাওয়াচ্ছে, খাইতে চাইলে হুজুরের রুমে তার সাথে যেন যাই। এমনিতেই গরমের দিন, যে কেউ রিফ্রেশমেন্টের জন্য এমন প্রস্তাবে না করবে না। আমিও না করিনি। আমি তার সাথে হুজুরের রুমে যাই। গিয়ে দেখি, হুজুরের সেই বাঁধা স্টুডেন্টরাই বসে আছে। আমি যাওয়ার পরে কাছাকাছি বসিয়ে একটা এক লিটারে সেভেনআপের বোতল বের করে দেয়, আমি খাওয়া শুরু করি। অর্ধেক খাওয়ার পর আমার মাথা ঘুরতে থাকে। আমি সে কথা বললে, ওরা বলে সেভেনআপ শেষ করে ফিরতে। নইলে হুজুর নাকি রাগ করবে। আমি শেষ করার জন্য আরও কয়েক ঢোক গিলি, কিন্তু শেষ করতে পারি না। তার আগেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়ি আমি।

তারপরে আমার সাথে কী হয়েছিল, আমি জানি না। পরদিন আমি নিজেকে নিজের বিছানায় আবিষ্কার করি। আশেপাশের স্টুডেন্টদের থেকে জানতে পারি, আমাকে নাকি অজ্ঞান এবং খুব রক্তাক্ত অবস্থায় আমার বিছানায় রেখে যায় ওরা। পরে কিছুদিন আমার হাটতে কষ্ট হয়, কিন্ত রিকভার করে নিতে সক্ষম হই।
এছাড়া, এই মাদ্রাসায় থাকাকালীন আমি একবার খাদেমদের দ্বারা এক স্টুডেন্টকে এবং আরেকবার বড় ভাইদের দ্বারা এক ছোটভাইকে মোলেস্টেড হতে দেখছি। আর এর সবগুলাকেই আমি ধর্ষণের সাথেই তুলনা করবো।

আমার এই ঘটনাগুলো আমি কখনোই কাউকে বলিনি আমার খুব কাছের বন্ধুরা ছাড়া। আপনারা হয়তো বলবেন, আমি শেষের দুটো ঘটনা আমার বাসায় বলিনি কেন? একটা ভয় ছিল আমার মাঝে যে, তারা আমাকে ভুল বুঝে আমাকেই এসবের জন্য দায়ী করবে কিনা, আর সেজন্য আমাকে বাসায়ও অপমান হতে হবে কিনা!

এই ঘটনাগুলো হয়তো কখনোই আমি জানাতাম না। কারণ এই স্মৃতিগুলো আমার জন্য রীতিমত ট্রমাটাইজড হওয়ার কারণ। কিন্তু গত কিছুদিন থেকে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক মোলেস্টেশনের ঘটনার ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি আর আজকে একজনের পোস্টে অপর একজনের কমেন্টে “আপনার সাথে তো এরকম ঘটেনি” টাইপ কমেন্ট করে বাস্তবতা অস্বীকার করতে চাওয়ার প্রবণতা আমাকে এই পোস্ট লিখতে বাধ্য করলো।

সবশেষে এটাই বলতে চাই, মাদ্রাসাকেন্দ্রিক এই নির্যাতনের ঘটনাগুলোতে শুধু বিচার না করে এই সমস্যার কারণ খুঁজে বের করে তা নির্মূল করা জরুরি। অন্যথায় এই সমস্যার সমাধান দেখি না।

শেয়ার করুন: