দিনা ফেরদৌস:
সেদিন পূজায় হিন্দু নায়ক-নায়িকাদের দেখে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যেই পরিমাণ হাহাকার দেখালেন তাতে মুমিনের ঘরে জন্ম নেয়ার কারণে নিজেরও কিছুটা লেগেছে। কেউ কেউ বলছেন, নায়ক বাপ্পী হিন্দু, এটা তো জানতাম না (জানলে কী করতেন জানি না)। অনেকে বলছেন, মডেল ও নায়িকা মীম (বিদ্যা সিনহা মীম) হিন্দু, এটা জানতাম না, খুব কষ্ট পেয়েছেন কারণ মীম আমার মুমিন ভাইদের ক্রাশ। কেউ কেউ কষ্টে, যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে বলেছেন, মুসলমানি নাম মীম রেখেছে লাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতায় মুসলমানদের ভোট পাওয়ার জন্যে (মীম আরবী একটা অক্ষরের নাম)। মুমিন ভাইগণের কথা শুনে কষ্ট হচ্ছিল। আমরা কী মেসেজ দিচ্ছি নিজেদের সম্পর্কে! ধর্মপ্রাণ মুমিনদের তো ওইসব বেদাতি নাচ, গান, সুন্দরী প্রতিযোগিতার নামে যাকে আমরা প্রতিদিন বেলেল্লাপনা বলি, সেইসব দেখাই উচিত না। কিন্তু আমরা ওই সব মন ভরে দেখি, সুন্দরীদের ভোট দেই, তারপর মন্তব্যে গিয়ে গালি দিয়ে ঈমানদার সাজি।
এর মধ্যে কেউ কেউ দেখলাম চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসকে ধুয়ে দিচ্ছেন এই বলে যে সাকিব খানকে বিয়ে করার সময় মুসলমান হলো, এখন আবার হিন্দু হয়ে গেছে। কথাগুলো শুনে মনে হলো তারা হয়তো সাক্ষী ছিলেন সাকিব খানের বিয়েতে। সাকিব খান কীভাবে, কোন ধর্ম মতে বিয়ে করেছিলেন সব জানেন তারা। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, অপু বিশ্বাস (যদি মুসলিম হয়েও থাকেন) কি ইসলাম ধর্মের প্রতি অনুরাগ থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, নাকি শুধু সাকিব খানের বউ হওয়ার জন্য ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন? যদি শুধুমাত্র ধর্মীয় রীতিতে বিয়ে করার জন্যে অপু বিশ্বাস মুসলমান হয়ে থাকেন, তার রেজাল্ট তো হাতে-নাতেই পেয়েছেন। আমাদের ধর্মপ্রাণ মুমিন নায়ক সাকিব খান নিজের বিবাহিত বউ-বাচ্চার পরিচয় লুকিয়ে ধর্মের মুখ যেইভাবে উজ্জ্বল করেছেন, তাতে অপু বিশ্বাসকে বলার সুযোগ নেই শান্তির পথ ছেড়ে হিন্দু ধর্মে আবার চলে গেলেন কেন?
তারপরও আমরা বলি। কারণ অপু বিশ্বাস বাংলাদেশ প্রথম সারির নায়িকা। প্রথম সারির নায়িকা মুমিন হলে ধর্মের মুখ উজ্জ্বল হয়। প্রথম সারির নায়িকাকে দেখিয়ে ধর্মের বিজ্ঞাপন করালে দলে দলে লোক মুমিন ধর্মে যোগদান করবে বলে আমরা ধরে নেই।
আমাদের ধর্ম প্রাণ মুসলমানরা এখন এতোটাই আধুনিক হয়েছি যে নাচ, গান, অভিনয়কে হারাম জেনেও সেই নাচ, গান, মডেলিং, অভিনয়ের জন্যেও মুমিন ভাই-বোনদের খুঁজি। সেদিও দেখলাম অনেকে মন্তব্য করেছেন, কারিনা কাপুর মুসলমানকে বিয়ে করে কেন বিকিনি পরে বেড়ায় এখনও! তারা আশা করেছিলেন, কারিনা কাপুর সাইফ আলী খানকে বিয়ে করেছে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে। কারিনা কাপুরের শাশুড়ি সেই যুগে মুসলিমকে বিয়ে করে বিকিনি পরেছেন, আর এই যুগে যদি মনে করি কারিনা কাপুর বোরকা পরে দুই চোখ বোরকার ফাঁকে বের করে ছবি দিয়ে বলবে, আলহামদুলিল্লাহ, বেহেশতের টিকিট হাতে পেয়ে গেছি, তো বলার আর কিছু বাকি থাকে না।
নায়ক/নায়িকাকে ধর্মে এনে টানাটানি না করলেই কি নয়? এরা তো ধর্ম প্রচার করতে আসেনি, নাচতে, গাইতেই এসেছে। আপনারা তাদের ফলো করা বাদ দিয়ে দেন, দেখবেন ছবি ফ্লপ হতে হতে রুজি বন্ধ হয়ে আল্লাহকে ডাকবে। সেদিনও নায়িকা সানা বা সানাই ধর্মের পথে এসেছেন জেনে এটা প্রচার করতে কেউ কেউ উঠে পড়ে লেগে গেলেন। মনে হলো এই বিজ্ঞাপন দেখার সাথে সাথেই দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করবে। জেনে রাখুন, আপনাদের নোংরামির কারণে বহু মানুষ প্রতিদিন ধর্মান্তরিতও হচ্ছে। দয়া করে মডেল/নায়ক – নায়িকাদের দিয়ে ধর্মের বিজ্ঞাপন করানোটা বাদ দেন। ধর্মকে নিজস্ব মহিমায় উজ্জ্বল হতে দিন।
এই যে প্রতিদিন নায়ক/নায়িকা, গায়ক/গায়িকা, মডেল, অভিনেতাদের ইসলামের পথে আহবান করেন, এইসব না করে নিজে সুস্থভাবে ধর্ম পালন করুন। নাকি আপনাদেরকেও কেউ পিছন থেকে গালি দিয়ে, খুঁচিয়ে, ভয় দেখিয়ে জোর করে ধর্ম পালন করাচ্ছে? যদি তা না হয়ে থাকে তো বুঝে নিন ওইসব জোর করে বলে কয়ে হয় না, মানুষ অন্তরের তাগিদ থেকেই করে। আর সুস্থভাবে যখন ধর্ম পালন করবেন, তখন নায়ক/নায়িকাদের ওয়ালে বা ভিডিওতে উঁকি দেবার ইচ্ছে হবে না। অন্যকে মৃত্যু নিয়ে ভয় দেখানোর আগে নিজের মৃত্যু নিয়ে ভাবুন।
যে বেহেশতে যেতে চায় সে নিজ দায়িত্বেই যাবে। গালি দিয়ে, কটাক্ষ করে, জোর করে, ধর্মান্তরিত করে, ভয় দেখিয়ে, কাউকে বেহেশতে নেয়ার দরকার নেই। আল্লাহর যদি ইচ্ছে থাকতো তো দোযখ না বানিয়ে শুধু বেহেশত-ই বানাতেন, আর সবাইকে মুসলিম বানিয়ে আগেই শয়তানকে ধ্বংস করে দিতেন। দোযখ বানিয়ে রেখেছেন, কিছু মানুষ দোযখে যাবে সেটাও সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায়। বরং আপনি সবাইকে ঠেলে বেহেশতে নিয়ে গেলে সৃষ্টিকর্তার কাজে উল্টো বাধা দিয়ে ফেলবেন। কী সুন্দর নিয়ম করে রেখেছেন কিয়ামতের দিন বিচার-আচার হবে। সব ভালো হয়ে গেলে কার বিচার হবে? তার চেয়ে নিজের রাস্তা মেপে চলেন। আর কথাগুলো যে বললাম, ভাবুন বার বার।