বছরে একবার দেশে যেতে চাই কেবল …

অরিত্রি সরকার:

দেশের বাইরে আসার এতোগুলো বছর পর এই প্রথম এতো ভালো করে দুর্গা পূজা উদযাপন করে খুবই খুশি ছিলাম কিন্তু এখন ভেতরে প্রচণ্ড অপরাধবোধ কাজ করছে!! কথা আমি কখনোই গুছিয়ে বলতে পারি না তারপরও মনে হচ্ছে আমার বলতে হবে আমার নিজের জন্য!!!

আপনাদের প্রতি একটা অনুরোধ আমার… চারপাশে যা ঘটে গেছে বা ঘটে যাচ্ছে তার প্রতিবাদ করার আগে নিজেদের দিকে একবার তাকিয়ে দেখবেন কি? আমার মনে হয় প্রতিবাদ করতে হলেও যোগ্যতা থাকা লাগে, শুধুমাত্র মানুষ হবার যোগ্যতা!

ছোটবেলা থেকে আমাকে শেখানো হয়েছে হিন্দু হবার আগে মানুষ হতে হবে, সব ধর্ম সমান , সব ধর্মের উৎসব সমান। এখনো ঈদের দিন নতুন জামা ছাড়া আমি বের হই না… আমার মা নিজে কিনে দেয় আমার ঈদে পড়ার নতুন জামা! ঈদ আর পূজায় ঠিক একইরকম উত্তেজনা কাজ করে আমাদের মাঝে।

আমার মামা শিখিয়েছিলো আযানের সময় যদি তুমি মুসলিমদের মাঝে থাকো এবং উনারা যদি মাথায় কাপড় দেয় তুমিও দিবে, উনাদের সম্মানের জন্য। আযানের সময় জোরে আওয়াজ না করা আমার পরিবার থেকে শেখা আমার। কত্তবার নাচের রিহার্সেলের মাঝে গান বন্ধ করে দিয়েছি যদিওবা আশেপাশে কেও ছিল না তারপরও!
আমার বিয়েতে আমাকে ধান-দুর্বা-প্রদীপ দিয়ে আশির্বাদ করার বেশিরভাগ ছিলেন ধর্মপ্রাণ ভিন্নধর্মী আন্টিরা। যাদের মধ্যে কয়েকজন ঠিক আমার মায়ের পরে আমার ভরসার জায়গা,আশ্রয়ের জায়গা।আমাকে নিজের মেয়ের মতো ছোট থেকে এখন পর্যন্ত আগলে রেখেছেন।

হলিক্রস স্কুলে শিখেছি কীভাবে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান একই মন্চে বসে একসাথে প্রার্থনা করতে হয়। গলা ছেড়ে গাইতাম “ ত্রিভুবনে প্রিয় মুহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়”।
আমার একটা বিশাল মামা গ্রুপ আছে যাদের একজনও হিন্দু না! আমার মা মানে তাদের দিদির একডাকে সবাই চলে আসে সেই ছোট্ট থেকে দেখছি। তাদের একজনকে কানাডাতে পেয়ে আমি যে কত সাহস পেয়েছি সেটা বলতে পারবো না।
অস্ট্রেলিয়ায় সাত বছর যারা আমাকে আগলে রেখেছিল তাদের ৯৯% মুসলমান। আমার আরেক পরিবার।

ছোটবেলা থেকে দেখেছি বাসায় ইফতার থেকে শুরু করে দুই ঈদেই বিশেষ আয়োজন করা হয়।আমি নিজে এখনো সেটা বজায় রেখেছি। দেশের বাইরে বসেও আমার বাসায় ইফতারের দাওয়াত হয়, ঈদের দাওয়াত হয়। হালাল মেনে বাজার করা হয়। শবেবরাতে হালুয়াটাও বাদ যায় না। যারা নিমন্ত্রিত তাদের কেওই হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসী না।কারণ আমাকে শেখানো হয়েছে সব উৎসব আনন্দ ভাগাভাগি করে নেবার জন্য!
বিশ্বাস করেন এতে আমাদের এতটুকু কিছু নষ্ট হয়নি, কারণ নিজের ধর্মের বিশ্বাস টা নিজের মনে এবং অবশ্যই সেটা এতো ঠুনকো না!
এতোকথা লিখলাম শুধু কিছু ছোট্ট প্রশ্ন করার জন্য…

– আমার এতে এতো বন্ধু আর কাছের মানুষজন যারা সবসময় আমাকে সবার আগে পেয়েছেন নিজেদের আনন্দ ভাগাভাগিতে…. কতজন নিজের থেকে পুজায় একটা সামান্য শুভেচ্ছা জানাতে আসেন বলতে পারবেন কি? এতেও কি ধর্ম নষ্ট হয়ে যায়, এতোটাই ঠুনকো বিশ্বাস?

– বন্ধুদের বাড়িতে মজার ছলে কতবার হিন্দু বন্ধুদের মালাউন বলে, শাঁখা-সিঁদুর নিয়ে, শিব পুজা নিয়ে নোংরা মজা করে, শবদেহ চিতায় পোড়ানো নিয়ে, গোমাংস খাওয়া না খাওয়া নিয়ে হাসি তামাশা করেছেন বলতে পারবেন বুকে হাত দিয়ে সত্যি করে? ঠিক একই কথাগুলো আপনার বিধর্মী বন্ধু বললে নিতে পারবেন তো??

আমরা ইগনোর করে যাই কারণ আমাকে শেখানো হয়েছে কেউ খারাপ বললে বা করলেই তোমাকে সেই লেভেলে নিচে নামতে হবেনা। আপনারা যদি নিজেদের নিয়ে একটু ভেবে দেখেন তাহলে হয়তো আপনার পাশের ভিন্নমতধর্মী মানুষটার চোখে আপনি নিজের এবং আপনার ধর্ম নিয়ে অনেক বড় সম্মান আর ভালোবাসা’র জায়গাটা দেখতে পারবেন।

আমি যেরকম সেরকমই থাকবো, সব করে যাবো যা এতোদিন শিখেছি…অন্যরা আমাদের নিয়ে যাই করুক না কেনো। আমার ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য করে যাবো। ওরাও আমার মতো এটা শিখেই বড় হবে “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”।
আমার জীবনে, আমার মনে কোনদিন গোঁড়া হিন্দু-মুসলিমের জায়গা ছিলো না, কোনদিন হবেও না।
শেষে একটা অনুরোধ আমাদের নিজের দেশে যাওয়াটা বন্ধ করে দিবেন না…. আমার বাবা শুয়ে আছে সেই মাটিতে, বছরে একবার শুধু ছুঁয়ে যেনো আসতে পারি।

শেয়ার করুন: