ঝর্ণাকে আপনারা সিনেমার নায়িকা ভেবেছিলেন?

নাসরীন রহমান:

নিউজফিডে ভিডিওটি সামনে আসায় কেন জানি না দেখলাম! আসলে কমেন্টগুলোই আমাকে আগ্রহী করে তুললো আসল ঘটনা কী দেখতে!
অনলাইনে আরজে কিবরিয়ার জনপ্রিয় একটি শো এর কথা বলছি। ‘ঝর্ণা’ নামের একটি মেয়েকে গালমন্দ করে ধুয়ে দেওয়া হচ্ছে।
অনেকে লিখেছেন, ‘বাবা’ গরীব বলে ঝর্ণা অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন বাবার সাথে যেতে।
অনেকে লিখেছেন বাবাকে দেখে জড়িয়ে ধরেননি ঝর্ণা, তাই মেয়েটির শিক্ষার মূল্য নাই ইত্যাদি ইত্যাদি।

এখানে একটু বলে রাখি যে ঝর্ণা কে? ঝর্ণা হলো একটি মেয়ে, যে কিনা আনুমানিক পাঁচ বছর বয়সে বাসা থেকে বেরিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল, পরে তার স্থান হয়েছিল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে। বিশ বছর ধরে সেখানেই সে আছে, লেখাপড়া করেছে ভারতেশ্বরী হোমসে, এবং সেখান থেকে পাশ করে বেরিয়ে এখন অনার্স পড়ছে। বেশ আধুনিক এক তরুণী আজ ঝর্ণা। কিবরিয়ার ওই শোতে ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া অনেককে ফিরে পাওয়ার গল্প আমরা জানতে পারি। তথ্যমতে, এপর্যন্ত ৫০টির মতো এমন ঘটনা সফল হয়েছে, যেখানে হারিয়ে যাওয়া স্বজন ফিরে পেয়েছে তাদের আত্মীয়দের, ফিরে গেছে নিজ নিজ সংসারে। বলাবাহুল্য যে খুবই স্পর্শকাতর এবং সংবেদনশীল, আবেগঘন একটি শো এটি। মিলিয়ন দর্শক এই শো এর। তো, ঝর্ণাও এই শো’এর মাধ্যমে ফিরে পেতে চেয়েছে তার হারিয়ে যাওয়া পরিবারকে এবং শেষপর্যন্ত তাদের সন্ধান মিলেছে। সেই অনুষ্ঠানটি নিয়েই আজকের এই আলোচনা।

আমার প্রশ্ন সেইসব দর্শকের কাছে যারা ঝর্ণাকে দোষারোপ করছেন, সমালোচনা করছেন নানানভাবে। আপনারা কি বাংলা সিনেমা দেখতে বসেছিলেন নাকি? আপনারা কি ভেবেছিলেন ২০ বছর পর বাবাকে দেখে মেয়ে স্লো মোশনে ‘বাবা’ বলে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবে বাংলা সিনেমার মতো!
অত:পর মেয়ে ফিরে যাবে পিতৃগৃহে এবং সকলে মিলে সুখে শান্তিতে বসবাস করিবে? এমন একটা ছবিই নিশ্চয়ই মনে এঁকে নিয়ে বসেছিলেন শো’টি দেখতে। তাই না?

তাইলে বলি। এই যে ২০ বছর মেয়েটি সবাইকে হারিয়ে এতিমের মতোন বড় হলো একটা আশ্রয়কেন্দ্রে, এটা কম সময় নয় কিন্তু। এই ২০ বছর একটি মেয়ে পরিবার ছাড়া বড় হয়েছে। পাঁচ বছরের একটি শিশু ছোটবেলা থেকে জেনে বড় হয়েছে সে পালিতা, যার কাছে থাকেন তিনি তার আসল মা নন।
যতই আদরে পালিত হোক এই শিশুটি একটি মানসিক কষ্ট নিয়েই বড় হয়েছে, সে তার চারপাশে মা-বাবাকে না পেয়ে, না দেখেই বড় হয়েছে। হয়তো সে আশা ছেড়েই দিয়েছিল কোনদিন তাদেরকে ফিরে পাওয়ার! আজ সে বড় হয়েছে, পড়াশোনা করছে, কিন্তু তার মানসিক কষ্টের সাথে বসবাসের দিকটি কিন্তু মিথ্যে হয়ে যায়নি। এই ২০টা বছর মিথ্যে হয়ে যায়নি। প্রতিনিয়ত সে যে ছবিটা মনের মধ্যে নিয়ে বড় হয়েছে, সেই ছবিটি বাস্তবতা থেকে দূরের হওয়াটাই কি স্বাভাবিক না?

আজ এই মেয়েটিকে ২০ বছর পর যখন তার হারিয়ে যাওয়া বাবা-মায়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়, ভিতরে ভিতরে সে অস্বস্তিতে পড়ে। এটা কিন্তু শ্রেণিগত পার্থক্যের কারণে অস্বস্তি নয়, এটা হচ্ছে তার শূন্য জীবনে হঠাতই প্রিয়জনদের উপস্থিতি তাকে বিহ্বল করে দেয়, সে তখন কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারে না, কারণ সে কনফিউজড হয়ে যায়, তার ভিতরে মৃতপ্রায় অনুভূতিটাকে জাগ্রত করতে, সেই পরিস্থিতি মানতেও তো তাকে সময় দিতে হবে।

অনুষ্ঠানটি চলাকালে এবং শেষ হওয়ার পর যে হারে মেয়েটিকে গালমন্দ করা হলো, সেটা কি কেবলই সে মেয়ে বলে? নাকি মেয়েটি আজ পড়াশোনা করে একটা ভিন্ন পরিবেশে বড় হয়েছে বলে? বাস্তব তো সিনেমা নয়!
দর্শক ভেবে বসেছিলেন নারী মানেই সব পরিস্থিতি গ্রহণে অনুকূল মনোভাব। নারী সর্বংসহা, নারী বিনয়ী, নারীর নিজের মতামত নেই!

ঝর্ণা এই ২০ বছর একধরনের পরিবেশে বড় হয়েছে, যিনি বা যারা তাকে লালন-পালন করেছেন তাঁর সাথেই ঝর্ণার আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা শেয়ার হয়েছে। জন্মদাতা বাবা-মায়ের সাথে নয়। উলটো এই ২০ বছরে জন্মদাতা বাবা-মায়ের অধিকাংশ স্মৃতিই সে ভুলে গেছে। সুতরাং বাবা-মাকে দেখে তাদের জড়িয়ে না ধরা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং জড়িয়ে ধরলেই বিষয়টা নাটকীয় মনে হতো, কৃত্রিম মনে হতো।

ঝর্ণা একজন প্রাপ্তবয়স্কা স্বাধীন নারী, সে কার কাছে থাকবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার আছে, যদি একান্তই বাবা-মায়ের কাছে ফিরে না যেতে চায়, দর্শক হিসাবে তার সেই সিদ্ধান্তকে সম্মান করার শিক্ষাটুকু সবার থাকা উচিত।
কেউ এখন পারিবারিক মূল্যবোধ ইত্যাদি ইত্যাদি কপচাবেন না দয়া করে। একটি পাঁচ বছরের শিশু যখন হারিয়ে গিয়েছিল, কীরকম পরিস্থিতিতে সে একটা আশ্রয়কেন্দ্র খুঁজে পেয়েছিল, তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হয়েছিল, আমরা কেউ জানি না। সেদিন তার যে ট্রমা তৈরি হয়েছিল, আজীবন তাকে তা কুড়ে কুড়ে খাবে।
এটা ভুলে যাবেন না ঝর্ণার সাথে তাদেরই মানসিক নৈকট্য তৈরি হয়েছে এতোদিনে, যাদের সাথে সে এতোগুলো বছর ধরে আছে। তাদেরই সে আপন ভেবেছে, জগত ভেবে নিয়েছে।
সুতরাং সেই পরিবেশ ছেড়ে নতুন পরিবেশে যেতে ঝর্ণা দ্বিধান্বিত হতেই পারে। বিশেষত যাদের সাথে তার কোন মধুর স্মৃতি মনে নেই, উপরন্তু কিছু কষ্টের স্মৃতিই ঝর্ণাকে এতোগুলো বছর তাড়া করে ফিরেছে।
আর তাইতো বাবা-মাকে পেয়ে সে আহলাদে আটখানা হতে পারেনি। বরং অভিমান, ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে। স্বাভাবিকভাবেই সে জবাবদিহিতা চেয়েছে, জানতে চেয়েছে কেন তাকে অকারণে মারা হতো?

পাঠক খেয়াল করুন, ঝর্ণার তখনও কোন জাগতিক জ্ঞান না হলেও এটুকু বুঝেছিল যে মা ভাইকে শাসন না করে ঝর্ণাকেই শাসন করেছেন উল্টো!
সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে মারধর করেছেন মা, অথচ ছেলে বলে ভাইকে কিছু বলছেন না!
যেখানে ঝর্ণা সম্পূর্ণ নির্দোষ। আর ভাই ছিল দোষী। সেই ভাইটি এখন বিদেশে থাকে। একপর্যায়ে আমরা দেখেছি যে সেই ছোট্ট শিশুমনের ক্ষোভটি রয়েই গেছে ঝর্ণার মনে, আর তাইতো সে ভাইয়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেছে।

সেই ছোট্ট ঝর্ণা মায়ের সাথে অভিমান করে ঘর ছেড়েছিলেন। মাকে একটু শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। ২০ বছর পরও সে ক্ষোভ এতোটুকু প্রশমিত হয়নি মায়ের প্রতি। বার বার সে মায়ের কাছে জানতে চেয়েছে, কেন তাকে মারধর করতো মা! এখানে মা রুপক অর্থে, আসলে শিক্ষাটা সে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকেই দিতে চেয়েছে। এই যে শিশুদের ছোটবেলায় মারধর করা হয়, বৈষম্য করা হয়, আমরা কিন্তু কেউ জানি না এর কী ভয়াবহ ছাপ ফেলে শিশুটির ভবিষ্যত বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে!

ঝর্ণার এই তেজ একজন নারীর স্বাধীন সত্তারই বহিঃপ্রকাশ। তাইতো আমরা দেখি ঝর্ণা হোমে থেকে লেখাপড়া শিখেছে। মানুষ হতে চেয়েছে। আর দশজন হোমের শিশু থেকে সে আলাদাভাবে জীবন গড়তে চেয়েছে, যার প্রচেষ্টা আমরা তার কর্মে দেখি। আর এই তেজটাকেই কমেন্টকারীরা ‘উদ্ধত’ বলে নামকরণ করতে চাইছে। তেজি, জেদি মেয়েদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মানবে কেন? কবেই বা মেনেছে?

এখন দর্শক চাইছেন বাংলা সিনেমার মতো ঝর্ণাকে বাবার সংসারে ফিরিয়ে দিতে! ঝর্ণা না বলায় ইতিমধ্যে অনেকেই নাখোশ হয়েছেন। তারা নানা ভাষায় তাকে আক্রমণ করেছেন।
কমেন্টের বন্যায় যার প্রকাশ ঘটেছে, আমার প্রশ্ন এখানেই।
যারা ঝর্ণাকে বাবার সংসারে ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছেন বাংলা সিনেমার যবনিকাপাত ঘটাতে, তারা কি এই নিশ্চয়তা দিতে পারবেন ঝর্ণা এই ২০ বছর যে পরিবেশ, ভালোবাসা পেয়েছেন সেই পরিবেশ, ভালোবাসা নতুন জায়গায় পাবেন?
যদি না পান তবে কিন্তু ঝর্ণার বড় হওয়ার উদ্যম এখানেই মারা যাবে।

আমি বারবার যে বিষয়ে আলোকপাত করতে চাচ্ছি তা ঝর্ণার একটা পরিবেশে বেড়ে উঠার অভিজ্ঞতা, মূল্যবোধ, শিক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি।

দরিদ্র পিতামাতার কাছে ফিরে গিয়ে সে সেটা কি পাবে? তার বাদবাকি পড়ালেখার কী হবে?
আর কাউন্সেলিং এর কথা বাদই দিলাম।
একটা ট্রমার মধ্য থেকে গিয়ে ঝর্ণা আরেকটি ট্রমায় পড়বে। এখানে ট্রমা বলতে নতুন পরিবেশ, অভিজ্ঞতা, পুরোনো বিষাদময় স্মৃতি বোঝাচ্ছি।

ঝর্ণার অর্ধশিক্ষিত নিম্নবিত্ত মা, বাবা কি তাকে কাউন্সেলিং দিবে? নাকি এর গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবে??

পরিশেষে বলতে হয় এই ধরনের পারিবারিক মিলনমেলা অনুষ্ঠান মানসিক দিক দিয়ে কতটা যৌক্তিক, তা ভাবার বিষয়।
এখানে ভিকটিম বা ভুক্তভোগী বা নির্দিষ্ট ব্যক্তি কিন্তু একধরনের ট্রমা থেকে আরেক ধরনের ট্রমায় গিয়ে পড়েন!
কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভেবে দেখবেন কি?

শেয়ার করুন: