উম্মে শায়লা রুমকী:
“মা কথাটি ছোট্ট অতি,
কিন্তু জেনো ভাই,
ইহার চেয়ে নামটি মধুর
তিন ভুবনে নাই।”
কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে “বাবা” ডাকটাও আমার কাছে মধুর বলেই মনে হয়! আমার ছেলেটা তার বাবাকে ‘বাবা’ বলে ডাকে।আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, আয়ানের মুখে ‘বাবা’ ডাকটা অসম্ভব মধুর শোনায়। আব্বু, ড্যাড, পাপ্পা এই শব্দগুলোর চাইতে সবচেয়ে মধুর হলো ” বাবা “।
কিন্তু আমরা চার ভাইবোনই বাবাকে ‘আব্বু’ বলেই ডাকি। ছোটবেলায় আব্বু ছিলেন আমাদের কাছে একটা ব্রিফকেস। আমি আর বড় আপু সব সময় অপেক্ষায় থাকতাম, আব্বু কখন ব্রিফকেস নিয়ে বাড়ি আসবে! আব্বু যখন ব্রিফকেস হাতে লঞ্চ থেকে নামতেন, আমরা দু বোন চাচার হাত ধরে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমাদের প্রধান লক্ষ্য থাকতো ব্রিফকেসে। কারণ আমরা জানি, ওখানে অবশ্যই নতুন জামা আছে, মাথার হ্যাট থাকবে, নয়তো পুতুল থাকবে, আর চকচকে দুটাকার নোট থাকবে। ছুটি শেষে আব্বু যখন কাজে ফিরে যেতো সেসব আত্মীয়দের চকচকে দু’টাকা, পাঁচ টাকার নোট দিয়ে যেতেন। তাই আত্মীয় স্বজনদের ধারণা ছিলো তার ব্রিফকেস ভর্তি সব সময় বোধহয় নতুন চকচকে টাকা থাকে। যেটা আসলে সাধারণ মিথ ছাড়া অন্য কিছু নয়। আমার বাবা আসলে দিতে ভালোবাসেন। তাই সবাইকে কিছু না কিছু দিতেন।
ছোটবেলা থেকে দেখেছি, আমাদের বাড়িতে একজনের ভাত বেশি রান্না করা হতো। কারণ আব্বু নামাজে বা বাজারে গেলে পরিচিত, অপরিচিত বা সামান্য পরিচিত লোকদের ধরে নিয়ে আসতো,তারা দুপুরে খাইয়ে দাইয়ে পান মুখে নিয়ে হাসিমুখে বিদায় হতেন। তখন বুঝতাম না, বড় হতে হতে বুঝতে পেরেছি, আব্বু আসলে মানুষের আনন্দ, হাসিমুখ দেখতে ভালোবাসেন।
আমাদের চার ভাইবোনকে বাবা কোনোদিন গায়ে হাত তোলেননি। এখন ভাবতে অবাক লাগে! ছেলেমেয়েদের শাসন করা, গায়ে হাত তোলা, বকাবকি করার যে সংস্কৃতিতে বড় হয়েছি, সেখানে এই মানুষটি কী করে আদর, স্নেহ আর ছেলেমেয়েদের যতটুকু পেরেছেন ততটুকু আব্দার রক্ষা করেছেন!! কী করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পার না হয়েও এতোটা শিক্ষিত আর মানবিক!!
আমার বাবা আমার কাছে একজন, পৃথিবীর সবচেয়ে সরল সহজ আর আবেগী মানুষের নাম। আব্বু যেকোনো ভালো মন্দ খবরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন, ছেলে স্কলারশিপ পেয়েছে, মেয়ে ফেলোশিপ পেয়েছে,নাতি ভালো রেজাল্ট করেছে, ওমুকের অসুখ হয়েছে, তমুকের খুব অভাব, ভালো মন্দ সব রকম খবরই সে আবেগী হয়ে যায়। আব্বুর এই কেঁদে ফেলার স্বভাবটা আমরা চার ভাইবোনই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি।
ছোট বোনটা তো ছোটবেলায় বাংলা সিনেমা দেখেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতো। নায়কের দু:খ দেখে বড় হয়ে সে পুলিশ হতে চাইতো!আমাদেরও খুব খুব ছোট ছোট কথায়, অভিমানে চোখে জল আসে। বড় হতে হতে বুঝতে পারি, আমার বাবা খুব অভিমানী মানুষ, জীবনের ছোট ছোট কত পাওয়া না পাওয়া, কত শত সম্পর্ক হয়তো তাকে অভিমানী করেছে! আমাদের সংস্কৃতিতে বাবারা কেবল বাবাই হয়, বন্ধু হয় না। বন্ধু হলে হয়তো জানতাম, একটা মানুষ কতটা কষ্টসহিষ্ণু হতে পারে! কত ভালোলাগা, মন্দলাগাকে পাশ কাটিয়ে, পাত্তা না দিয়ে একটা জীবন ছেলেমেয়ে, বাবা মা, ভাই বোনদের জন্য কষ্ট করে যেতে পারে!
তবু এই সময় এসে আমার মনে হয়,আমার বাবা একজন সার্থক মানুষ। ভিটাবাড়িয়া নামে ছোট এক গ্রামে জন্মেছিলেন। বাড়ির মেজো ছেলে হিসাবে নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন দায়িত্ব। মাত্র সতের বছর বয়সে প্রথম বার চাকুরীর কারণে শহরে গেলেন,বলতে গেলে জঙ্গলে গেলেন।
ফরেস্টে খুবই ছোট একটা পোস্ট দিয়ে চাকুরি জীবন শুরু করেছিলেন। কিন্তু একাগ্রতা, সততা দিয়ে কাজ করে গেছেন নিরবে। কখনও জীবনের প্রতি অভিযোগ ছিলো বলে দেখিনি। আব্বু হাসিমুখে পরিবারের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করেছেন। ওই ছোট একটা চাকুরি থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়েছেন, ভাইদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন, অভাবের সংসারকে তিলে তিলে পূর্ণ করেছেন, নিজের ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন।
গ্রামে যেখানে মেয়েরা পঞ্চম শ্রেণির বেশি পড়ার সুযোগ পায় না, সেখানে আমরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ সার্টিফিকেট অর্জন করেছি। আমাদের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কেবলমাত্র আমরাই সবাই স্ব স্ব কাজে প্রতিষ্ঠিত। মায়ের অবদান অনেক। কিন্তু এখন বুঝি বাবার সহযোগিতা ছাড়া এতোদূর আসা কি সহজ ছিলো?
চাচাতো ফুফাতো বোনদের যেখানে মেট্রিকের আগেই বিয়ে হয়ে যেতো, সেখানে আমরা বড় হয়েছি নিজেদের মতামত নিয়ে, বড় হয়েছি স্বাধীনতা আর পারিবারিক মূল্যবোধ নিয়ে। ছোটবেলায় না বুঝলেও এখন তো জানি, আমাদের পথকে সহজ করতে বাবা মায়ের কী অক্লান্ত পরিশ্রম, কত শত আত্মত্যাগ!
আমার বাবা সার্থক! সুনামের সাথে চাকুরি শেষ করেছেন, চারজন ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন, মাকে নিয়ে হজ্ব করেছেন, ওমরাহ করেছেন। একটা শখের বাড়ি করেছেন, নিজের বাবা-মা-ভাই-বোনদের নিয়ে জীবনের পড়ন্ত সময়টা তার ভালো কাটছে। উন্নত প্রযুক্তির কারণে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়েরা দূরে থেকেও কাছাকাছি থাকে! তিনি মসজিদ করছেন, গরীব অসহায় মানুষদের জন্য কাজ করছেন, তিনি জীবনের সব কাজ ঠিকভাবে পালন করেছেন, পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা।
আব্বুর সাথে আমার একটা স্মৃতি ভীষণ মনে পড়ে। তখন বোধহয় বারো বা তেরো বছর আমার! আমি আর আব্বু মেলায় গিয়েছিলাম।অনেক ঘোরাঘুরি করে আমার একটা পুতুল পছন্দ হলো। ছোট একটা পুতুল সাদা কুশিকাটার জামা গায়ে নাচ করছে। এতো চমৎকার!!কিন্তু অতিরিক্ত দাম চাওয়াতে আব্বু কিনে দিলো না। আমার খুব মন খারাপ হলো। আমাদের ঘোরা শেষ হলে বাড়ি ফিরবো, গেট পার হয়ে রিকশা নেবো, এমন সময় আব্বু বললো, চলো, পুতুলটা কিনে নেই। মেয়ের মন খারাপ ভাবটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। তাই দাম দিয়ে পুতুলটা কিনে দিয়েছিলো। তখন এসব বুঝি নাই, এখন নিজেই মা। সব বুঝতে পারি!
আয়ানের বাবা যখন ছেলের জন্য চকলেট নিয়ে ঘরে ফেরে, ছেলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। আমি দুজনের চোখেই আনন্দ দেখি! ভালোবাসার কী অপরিসীম ক্ষমতা! কী আনন্দ!!
বাবা শব্দের আভিধানিক অর্থ কী আমি জানি না। আমি কেবল জানি বাবা মানে আত্মত্যাগ, বাবা মানে পরম নির্ভরতার জায়গা, বাবা মানে ভালোবাসা, বাবা মানে সব আব্দার মেনে নেয়া।
জগতের সকল বাবারা ভালো থাকুক। সব বাবাদের জন্য শুভেচ্ছা।