সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান

ঈহিতা জলিল:

কিছুদিন আগে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে আমার একটা শেয়ার করা পোস্টে কিছু কমেন্ট এসেছে। কয়েকজনের কমেন্টে-ই যেহেতু একটি কথা উঠে এসেছে তার মানে আমি বোঝাতে পারিনি। সেই প্রসঙ্গ থেকেই প্রায় বেশ কয়েক বছর পর আমার লিখতে বসা।

প্রসঙ্গের অবতারণা আসলে বাবা দিবসে। আমাদের কিছু মানুষ বিশেষ দিবসগুলো আসলেই একই লেবু বার বার কচলানোর মতো করে একই বিষয় বারেবারে বলে থাকেন।
তার মধ্যে সবচাইতে কমন যেটি, সেটি হলো, “বাবা-মায়ের প্রতি এতো ভালোবাসা থাকলে বৃদ্ধাশ্রমে কারা থাকে”! এবার আরও একটা বিষয় দেখলাম, সবার বাবা ভালো হলে দুর্নীতিবাজ, খুনি এরা কারা! আমার ভাবনার বিষয় হলো —-

১. যিনি অপরাধী তার সেই অপরাধের বিচার হবে। কিন্তু এতে তার বাবা/মা সত্ত্বা কেন প্রশ্নবিদ্ধ হবে?
২. আমি বলছি না খারাপ বাবা/মা নেই, কিন্তু তারা আসলে কত পার্সেন্ট? একই ভাবে খারাপ সন্তান কত পার্সেন্ট? কারা সন্তান রাস্তায় ফেলে যায়? কারাই বা পিতা-মাতাকে রাস্তায় ফেলে যায়?
৩. এই যে বিশেষ দিবসগুলোতে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে সবার বাবা-মায়েদের ছবি ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, দেখতে কি আনন্দ হয় না? আমার তো হয়। কোন আনন্দে কেউ অংশগ্রহণ করতে নাই পারে, কিন্তু একে প্রশ্নবিদ্ধ করে বিষাদগ্রস্ত করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত?

যে কথাকে খণ্ডাতে এই লেখার শুরু।
“সন্তানের উপর বোঝা/বার্ডেন”
বিষয়টি আসলে এর কোনটাই না।
বিষয় হলো, কাছাকাছি বয়সের মানুষের সংস্পর্শে থাকা এবং নিরাপত্তা দুটোই।

বেশ কিছুদিন আগে এই ফেবুতেই একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিলো। মনে আছে? আসুন মনে করি।

একজন সন্তান বৃদ্ধ মাকে মোটা টাকার বিনিময়ে একজন নারীর দায়িত্বে রেখেছিলেন। বাসায় ক্যামেরা লাগানো ছিলো। কর্মস্থলে বসে সন্তান দেখেছিলেন যার হাতে যত্নের জন্য বৃদ্ধ মাকে রেখেছিলেন, কী নির্মম অত্যাচারের শিকার সেই মাকে হতে হয়েছে!

এমন আরও অনেক জানা-অজানা ঘটনা আছে। কিছু ভাইরাল হয়, কিছু হয় না। রয়ে যায় পর্দার আড়ালেই।
আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম একটি ভুল কনসেপ্ট এর উপর দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য এটি অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের সেই মানের আশ্রম আছে কিনা! আশা করি সরকারি ও বেসরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। হয়তো হচ্ছেও। অবসর জীবনের পর আমরা নিজেরাও ছোট ছোট উদ্যোগ নিতে পারি। আমাদের এতো এতো ক্লাব আছে, কিন্তু বয়স্ক মানুষের জন্য ওভাবে এখনও কোনকিছু গড়ে ওঠেনি কেনো? এটি ভাববার চূড়ান্ত সময় এখনই। আমাদের শিশুদের জন্য যেমন দিবা-যত্ন কেন্দ্র প্রয়োজন, তেমনি আমাদের পিতা-মাতার জন্যও নিরাপদ যত্ন কেন্দ্র প্রয়োজন।

এখন আসুন কঠিন বাস্তবতার নিরীখে আমাদের অবস্থা দাঁড়িপাল্লায় মাপি। আমাদের জেনারেশনের প্রায় ৮০ ভাগ সন্তান কর্মজীবী। পেট চালানোর জন্যই তাদের কাজ করতে হয়। আমরা যারা মধ্যবিত্ত/উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে পড়ি, আমাদের নিজে কাজ করা ছাড়া উপায় নেই। মা-বাবার খেয়াল রাখতে গেলেও অর্থের প্রয়োজন। আর অর্থের জন্য কাজ। যার যার বাবা-মায়ের দায়িত্বও তার তার-ই হওয়া উচিত। আমরা আমাদের জীবনসঙ্গী থেকে সাহায্য নিতে পারি, কিন্তু তাদের উপর পুরো দায়িত্ব দিতে পারি না। তাছাড়া তাদের নিজেদেরও বাবা-মা রয়েছেন। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি যেহেতু বিশ্বাসী মানুষ। আমি বিশ্বাস করি মা-বাবার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজে লাগতে পারার মতো পূণ্য আর নেই। আর সবার ভাগ্যে এই পূণ্য থাকেও না। আমি মনে করি সেই সব সন্তান অবশ্যই সৃষ্টিকর্তাকে এমনভাবেই সন্তুষ্ট করেছেন, যাদের সৃষ্টিকর্তা এই উপহার দিয়েছেন। না হয় বহু মানুষের বহু সম্পদ আছে, কিন্তু সেটি কাজে লাগানোর জন্য পিতা-মাতা নেই। আর আমি আমার এই পূণ্যের ভাগ কাউকে দিতে রাজী না। এমনকি আমার জীবনসঙ্গীকেও না, একইভাবে তাকেও এই পূণ্যের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে চাই না।

আমাদের পিতা-মাতা যদি অতীতকাল হয়, আমরা যারা ৮০’র দশকে জন্মে ৯০’র দশকে বেড়ে উঠেছি, তারা হলাম বর্তমানের ক্রান্তিকাল। আমাদের জেনারেশনকে সবকিছুতে প্রমাণ দিয়ে দিয়ে টিকে থাকতে হচ্ছে। আমাদের প্রেমে পরিবার হতো প্রধান বাধা, আর আমাদের ছোট ভাই-বোনদের বলা হয়, “নিজে পছন্দ করতে পারিস না”! ঠিক একইভাবে এই বিষয়গুলোতেও আমাদের পরের প্রজন্মকে কোন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে না।

কর্মজীবী সন্তানেরা চাইলেও বাবা-মাকে টেক কেয়ার করতে পারে না। তাদের ভিতর একটা চাপা কষ্ট এটা নিয়ে এমনিতেই থাকে। আমাদের সমাজের মানুষ সেটিকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে এটাকে আরও বাজে জায়গায় নিয়ে যায়, অথচ খোঁজ করলে দেখা যাবে, হয়তো তারা নিজেরাই তাদের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করেন না। আমাদের সন্তানেরা আরও পারবে না। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি একা থাকতে পছন্দ করি। আমি আমার জগতে কারো ইন্টারফেয়ারেন্স চাই না। এটা আমার কথা। আমি পরিষ্কার জানিয়ে যেতে চাই। আমার সন্তান বা তাঁর সঙ্গীকে যেন কোন সোশ্যাল বুলিং এর শিকার হতে না হয় এজন্য।

এর বাইরে আমার আরেকটা কথা মনে হয়। আমার কাছে আমাদের জেনারেশনকে এতোটা কুটিল মনে হয় না। কম-বেশি সবাই দায়িত্ববান এবং বাবা-মায়ের প্রতি যত্নশীল। আর বরাবরই আমাদের আগের জেনারেশনকে খুবই কুটিল মনে হয়। “আই এ্যাম সরি” কোন জেনারেশনকে হেয় করা আমার উদ্দেশ্য না। এটি আমার ব্যক্তিগত অবজারভেশন। আর পরের প্রজন্ম নিয়েও আমি আশাবাদী, কারণ তারা খুবই ব্যস্ত, একটু ইয়ো ইয়ো টাইপ, কিন্তু দায়িত্ববান।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই।
কিছুদিন আগে আমার সন্তানের সাথে আমার আর ওর বাবার প্রচণ্ড ফাইট হয়েছে। বিষয় অবশ্যই মোবাইল। সে ক্ষেপে যেয়ে অনেক রকম কথা বলেছে।
আমরা বলেছি, “তুই বড় হলে তোর সাথে থাকবোও না, এসব দেখবোও না। যতদিন থাকবো, ততদিন তো বলবো”। সে কিন্তু রাগের মাঝেও বার বার একটা কথা রিপিট করেছে, “তুমি আর বাবা আমার রেসপন্সিবিলিটি, আমি তো তোমাদের এতো সহজে ছাড়বো না। আমার দায়িত্ব আমি কীভাবে পালন করবো, সেটা আমি বুঝবো!

আমি আর আমার স্বামী পরে ভেবে দেখলাম, আমরা কি তাহলে আমাদের সন্তানের মাঝে সঠিক চিন্তা দিতে পেরেছি? তারপর ভাবলাম, না, সিদ্ধান্তে পৌঁছুবার সময় এখনও আসেনি। এরপর যে বিষয়টা মাথায় এলো, আমাদের সন্তান তো একা না। সে একটা জেনারেশন। এমন নিশ্চয়ই শুধু আমাদের সন্তান একা ভাবছে না। ওর মাথায় যখন এটা আছে, তার মানে ওর বয়সী আরও অনেকের মাথায় এটা আছে। ওরা যখন ওদের বন্ধুদের সাথে গল্প করবে, তারাও এটা নিয়ে ভাববে। শিখবে।

মরাল অফ দ্য স্টোরি-
দায়িত্ব পালন করাটা বড় কথা।
কীভাবে পালিত হলো সেটা বড় কথা নয়।

আরেকটা মজার কথা বলি।
আমার সন্তান কিছুদিন আগে স্বপ্ন দেখেছে আমি এমনই আছি, কিন্তু বুড়া হয়ে গেছি। বিছানায় শুয়ে নেটফ্লিক্সে সিরিজ দেখছি, আর সে আমার পা টিপে দিচ্ছে। আমি দোয়া করি এমন দিন কোনদিন না আসুক। কারণ কেউ আমার পা টিপে দিচ্ছে, এটা আমাকে কেমন অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। তারপরও সন্তানের স্পর্শ অন্যরকম এক প্রশান্তি দেয়। আগে আব্বুর মাথায় হাত বুলালে আব্বু বলতো, “তোমার হাতটা আরাম লাগে”। এখন আমি বুঝি বিষয়টা। আমার সন্তান যখন আমার হাত ধরে, মাথায় হাত রাখে, অন্যরকম লাগে। এই স্পর্শ কিন্তু অনেক কার্যকরি। কালের পরিক্রমায় এই হাত অন্য হাতে যাবে। এটাই নিয়তি। শুধু হাতটা যেন ছুটে না যায় তার খেয়াল রাখা আমাদের দায়িত্ব।

আর একটা খুব গুরুত্বপূূর্ণ কথা, যৌবনে যে আচরণ আমরা আমাদের সন্তানের সাথে করবো, তার প্রতিফলন বৃদ্ধ বয়সে আমাদের সাথে তাদের আচরণের মধ্যে অবশ্যই অবশ্যই দেখতে পাবো। পাবোই। সেটা ভদ্রভাবে হলেও।

তাই সন্তানকে শাসন করুন, কিন্তু নিষ্ঠুর হবেন না। প্রতিটা বয়সের বেসিক কিছু দুষ্টামি থাকে, চাহিদা থাকে। সেগুলো করতে দিন। চিন্তা করুন। আমার মতো চিন্তা করে করে প্রেসার, সুগার বাড়িয়ে ফেলবেন না। মনে রাখবেন, আমাদের সবার জীবনে ভুল আছে। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই আমরা বেড়ে উঠেছি। উঠছি। আমাদের সন্তানেরাও ভুল করতে করতেই শুদ্ধ মানুষ হয়ে উঠবে, কারণ প্রতিটা ভুলই শুদ্ধতার পথ প্রসারিত করে।

তাই আসুন, শুদ্ধ চিন্তা করি।
শুদ্ধ চিন্তা ছড়াই।
শুদ্ধতায় বাঁচি।

সবার জন্য ভালোবাসা।

ঈহিতা জলিল
২৫.০৬.২১
শুক্রবার

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.