নারীবাদী পুরুষদের হাজারও বিপদ!

নাহিদা নিশি:

পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীবাদী নারীদের চেয়েও বেশি বিপদে আছে নারীবাদী পুরুষেরা। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীবাদী নারীদের তাও সহ্য করতে পারে, কিন্তু নারীবাদী পুরুষদের একদমই করে না। পুরুষ আর পিতৃতন্ত্রকে সমার্থক বলে মনে করে। স্যোশাল মিডিয়ায় চোখ বুলালে দেখবেন, প্রতিনিয়ত নারীবাদী পুরুষদের কীভাবে বুলি করা হয়!

‘ও তো সিম্প। মেয়ে পটানোর জন্য এসব করে। অ্যাটেনশন চায়’, “নারীবাদী পুরুষেরা নারীর পাশে দাঁড়াতে গিয়ে শুয়ে পড়ে”, “পুরুষ কখনো নারীবাদী হতে পারে না, সবই নারীবাদীদের সাথে শোয়ার ধান্ধা”, “নারীবাদী পুরুষেরা পুরুষ জাতির কলঙ্ক”, “নারীর পা চাটতে অভ্যস্ত যেসব পুরুষ, তারাই নারীবাদী হয়”

এসব কমেন্ট পড়ি আর হাসি। বলি, নারীবাদী পুরুষেরাই শুধু শোয়? দেশের বাকি সব পুরুষ কি তবে ভার্জিন? নিজেকে প্রগতিশীল দাবি করা অনেক নারী-পুরুষকেও দেখেছি এরকম অযৌক্তিক এবং হাস্যকর মন্তব্য করতে। যেখানে দেশের বেশিরভাগ নারীই পিতৃতান্ত্রিক, যেখানে বেশিরভাগ নারীই চায়, পুরুষ তাকে শাসন করুক, স্বামী তার খাওয়া-পরার দায়িত্ব নিক, যেখানে বেশিরভাগ নারীই নারীবাদ’কে খারাপ জিনিস মনে করে, সেখানে কোনো পুরুষকে শোয়ার জন্য নারীবাদী সাজতে হয়, এই যুক্তিটা মানতে পারলাম না।

যাই হোক, স্যোশাল মিডিয়ার কল্যাণে এই সমস্ত মন্তব্য খুব সহজেই আমাদের চোখে পড়ে। তাই অনেকেই মনে করে যে, ‘নারীবাদী’ শব্দটা আজকাল গালির মতো হয়ে গেছে। নারীবাদী মানেই হাস্যকর কিছু। এইসমস্ত মন্তব্যের কারণে কেউ কেউ নিজেকে ‘নারীবাদী’ হিসেবে পরিচয় দিতে সংকোচ বোধ করে। কিন্তু সত্যটা হলো, নারীবাদ/নারীবাদী এই শব্দগুলো চিরকালই এরকম গালির মতো ছিলো। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কোনো কালেই কোনো নারীবাদী’কে সম্মান করে নাই। লাঞ্ছিত করেছে, নির্যাতন করেছে, নির্বাসিত করেছে। নানা উপায়ে প্রাণপণে দমাতে চেয়েছে। যখনই কোনো পুরুষ সমতার কথা বলেছে, নারীর অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে, তখনই পিতৃতন্ত্রের মোড়লেরা তাকে দলবেঁধে আক্রমণ করেছে। চরিত্র নিয়ে মিথ্যাচার করেছে।

নাহিদা নিশি

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’কে আজকে আমরা সমাজ সংস্কারক বলে প্রচুর সম্মান করি, অথচ তাঁর সময়ে তাকে কতো জঘন্যভাবেই না অপমানিত করা হয়েছিলো! বিধবাবিবাহ’কে আইনসঙ্গত করার জন্য যে আবেদনপত্রটি দাখিল করা হয়েছিলো, সেখানে বিধবাবিবাহের পক্ষে স্বাক্ষর ছিলো মাত্র ৯৮৭টি। অন্যদিকে বিপক্ষে স্বাক্ষর ছিলো ছত্রিশ হাজার! ভাবা যায়! ধর্মান্ধ, মৌলবাদ গোষ্ঠীর আক্রমণ তো ছিলোই, লেখক-শিল্পীরাও তাকে রেহাই দেননি। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বিদ্যাসাগর’কে আক্রমণ করে লেখেন, ‘’অগাধ সাগর বিদ্যাসাগর তরঙ্গ তায় রঙ্গ নানা, তাতে বিধবাদের কুলতরী অকূলেতে কূল পেল না”। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের একান্ত শিষ্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখেন, “ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবাবিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে?”

দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে, সমাজপতিদের বিপক্ষে গিয়ে কাদম্বিনীকে বিয়ে করেন এবং তাকে ডাক্তার বানান। প্রথম বাঙালী নারী ডাক্তার। দ্বারকানাথ ৫ সন্তানের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে কাদম্বিনী’কে একপ্রকার জোর করেই বিলেতে পাঠান উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য। তখনও লোকে ছি ছি করেছে। ‘অবলাবান্ধব’ নামক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বলে সারাজীবন ধরে লোকে তাকে ‘’অবলাবান্থব” বলে ব্যঙ্গ করে গেছে। সাধারণ মানুষ তো পরের কথা ব্রাহ্ম সমাজেরও অনেকে দ্বারকানাথের এইসকল বাড়াবাড়ির বিরোধিতা করেছিলেন। সেসময় ‘বঙ্গবাসী’ নামক একটি জনপ্রিয় পত্রিকায় কাদম্বিনীকে নিয়ে কার্টুন ছাপানো হয়েছিলো। সেখানে দেখানো হয়েছিলো, স্বামী দ্বারকানাথকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছেন কাদম্বিনী দেবী।

লালন ফকির, যার গান না শুনলে আজকাল এস্থেটিক হওয়া যায় না, তিনিও নারীবাদী ছিলেন। সতীদাহপ্রথার বিরোধিতা করেছেন জীবনভর। শোনা যায়, তিনি ও তাঁর শিষ্যরা মিলে সতীদাহের চিতা থেকে এক নারীকে বাঁচিয়ে নিয়ে যান। এছাড়া তিনি নারী’কে তাঁর সাধনার সঙ্গী হিসেবে চেয়েছিলেন সবসময়। লিখেছিলেন, “কুলের বৌ হয়ে মন আর কতদিন থাকবি ঘরে, ঘোমটা ফেলে চল না রে যাই সাধবাজারে”। তাঁর এইসব কর্মকাণ্ডের জন্য নারী সঙ্গীদের জড়িয়ে কতো নোংরা মন্তব্য যে করা হতো তাকে! বেহায়া, মাগিবাজ বলা হতো। আক্রমণেরও শিকার হতে হয়েছে তাঁর শিষ্যদের।

ভারতবর্ষে নারী অধিকারের যে আন্দোলন, তার পেছনে পুরুষদের ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না। প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন থেকে শুরু করে বিধবাবিবাহের প্রচলন শুরু করেন যিনি, তিনি একজন পুরুষ। বহুবিবাহ, সতীদাহ এবং বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রথমদিকে কথা বলেন যারা, তারা সকলেই পুরুষ। তখনকার দিনে সেইসমস্ত পুরুষের পুরুষত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হলেও বর্তমানে তাদেরকেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ হিসেবে প্রশংসিত করা হয়। পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজ আজ বিদ্যাসাগর’কেই মনে রেখেছে, ভুলে গেছে রাধাকান্ত দেবের নাম।

রাজা রামমোহন রায়, কাজী নজরুল ইসলাম, গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন কিংবা মদনমোহন তর্কালঙ্কার, এরা কেউই জীবিত অবস্থায় পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ভালোবাসা পাননি বরং নিন্দা কুড়িয়েছেন। এতোগুলো যুগ পেরিয়ে এসেও সমাজ আজও একইরকম রয়ে গেছে। সমাজ এখনও সেইসমস্ত পুরুষ’কে পুরুষ জাতির কলঙ্ক বলে চিহ্নিত করে, যারা সমতার কথা বলে, যারা নারীর বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করে।

যেসব পুরুষ স্ত্রীকে শাসন করে না বরং সমস্ত কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করে, তাকে বউপাগলা বলে ব্যঙ্গ করা হয়। যেই পুরুষ কর্মজীবী স্ত্রীর জন্য রান্না করে রাখে, সেই পুরুষ’কে নিয়ে হাসাহাসির শেষ থাকে না। ‘বউয়ের আচলের তলায় থাকে’ বলে বিদ্রুপ করা হয়। মানুষ আজও মনে করে বউয়ের আঁচলের তলায় থাকা পুরুষের জন্য খুব অপমানজনক, অথচ স্বামীর পায়ের নিচে থাকা নারীর জন্য সুখকর এবং স্বাভাবিক। আজও মানুষ মনে করে, নারীর উপর কর্তৃত্ব করতে না পারলে, নারীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে পুরুষের পুরুষত্ব থাকে না। পুরুষত্ব মানেই গায়ের জোর, পুরুষত্ব মানেই নারীকে দমিয়ে রাখা।

বর্তমান পৃথিবীর সেরা দশজন হ্যান্ডসাম পলিটিসিয়ানদের একজন হলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো! তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘’আমি উচ্চস্বরে এবং স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, আমি একজন নারীবাদী। এটা আকাশকে নীল এবং ঘাসকে সবুজ বলার মতোই সরল-স্বাভাবিক যে, আমি নারী পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করি”। আমি জানিনা, কোনো মেয়ের সাথে শোয়ার জন্য জাস্টিন ট্রুডো নারীবাদী হওয়ার ভান ধরেছে কি না, তবে এটুকু বলতে পারি এতে তার সৌন্দর্য কিছু কমেনি বরং বেড়েছে বহুগুণ।

‘নারীবাদী’ কোনো গালি না, হাস্যকর কিছু না। পিতৃতন্ত্র চিরকালই নারীবাদী পুরুষদের ছোট করার চেষ্টা করেছে। তারা নিজেরা ধর্ষক, নিপীড়ক, চরিত্রহীন হয়েও নারীবাদী পুরুষদের চরিত্র নিয়ে কাঁটাছেড়া করেছে। টেনে শুইয়ে দিতে চেয়েছে এর ওর সাথে। আপনি যদি সমতায় বিশ্বাস করেন, আপনি যদি ফেমিনিজম’কে ক্যান্সার মনে না করেন, তাহলে কোনরকম সঙ্কোচ ছাড়াই নিজেকে নারীবাদী হিসেবে পরিচয় দিন! স্পষ্ট করে বলুন, ‘আমি নারীবাদী’। পৃথিবীতে নারীবাদী পুরুষের সংখ্যা বাড়ুক। রোক্সান গে’র সুরে বলা যায়, যতো বেশি পুরুষ নিজেকে নারীবাদী বলবে, ততোই লোকে বুঝবে পুরুষের নারীবাদী হওয়াটা খারাপ কিছু না, অসম্মানের তো নয়ই!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.