এখানে বিষাদ

ফাহমিদা বারী:

ক্যাচক্যাচ করতে করতে একটা দোতলা বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো রিক্সাটা।
আরোহী মুজিবর এক ঝটকায় রিকশা থেকে নেমেই জোয়ান রিকশাওয়ালার গালে চপাত করে কষে এক থাপ্পড় লাগিয়ে দিল। রিকশাওয়ালা হতভম্ব। বেচারা দিকভ্রান্তের মতো এদিক সেদিকে তাকিয়ে কারণ বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো। দু’একবার অসহায় কাতর আর লজ্জামাখা চোখে রিক্সায় বসে থাকা আরোহিনীর দিকে তাকালো সে। একটা সুন্দরী মেয়ের সামনে এভাবে চড় খাওয়াটা খুবই অপমানজনক। তার নিজের গায়েও জোর কিছু কম নেই। একবার ইচ্ছে করলো, ঘাড় সোজা করে দাঁড়িয়ে নিজেও দু’ঘা লাগিয়ে দেয় আরোহীর গালে। বহু কষ্টে ইচ্ছেটাকে দমন করতে হলো। ঝামেলা বাড়িয়ে কাজ নেই। যে ধড়িবাজ লোক! রেগেমেগে হয়তো ভাড়াটাই দেবে না। এতোখানি পথ কষ্ট করে নিয়ে এসে ভাড়া না পেলে কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে করবে।
আর তাছাড়া মেয়েমানুষ বসে আছে রিকশায়। আশেপাশে লোকজন জমে গেলে সবাই ঐ মেয়ে মানুষের পক্ষই নেবে। ঘটনা আসলে কী, সেটা জানার চেষ্টা কেউ করবে না। মানুষের ধৈর্য ভীষণ কম আজকাল।

রিকশাওয়ালা চোখমুখের অসহায় রাগ চেপে রেখে বলে,
‘মাইরলেন ক্যা? কী করছি আমি!’
আরোহী মুজিবরের তখন অগ্নিমূর্তি। এই বাসাটার সামনে দাঁড়ালেই তার ভেতরের পৌরুষটা কোত্থেকে যেন জেগে ওঠে। কে যেন শার্টের কলারটাকে টান দিয়ে ধরে সটান দাঁড় করিয়ে দেয় তাকে। বিড়ালরূপী চোর চোর মানুষটা মরে গিয়ে গজরাতে ইচ্ছে করে ভেতরের সিংহটার। ওপরের ঝুল বারান্দাটার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে ইস্পাতের মতো গলায় মুজিবর বললো,
‘হারামজাদা, কী করছোস বুঝিস নাই শুয়োরের বাচ্চা! আরেট্টু হইলে খন্দের মইধ্যে ফেলতি! ভাঙ্গা রিকশায় চড়াইয়া মাজায় বিষ ধরাইয়া দিলি, আর তুই জানিসই না কী করছোস! তরে ঐ খন্দের পচা পানি খাওয়ায় দিলেই বুঝবার পারবি, কী করছোস!’
রিকশাওয়ালার বলতে ইচ্ছে করলো, ‘আপনে কি পচা পানি খাইছেননি যে আমারে খাওয়াইবেন?’ কিন্তু এই ত্যাড়া লোককে আর একটা কথাও বলতে ইচ্ছে করলো না তার। রাগটাকে সম্পূর্ণ গিলে ফেলে সে হাত বাড়িয়ে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। মনের মধ্যে ভয়, এই লোক ভাড়াটা দেবে তো ঠিকঠাক? তার সেই আশঙ্কা অবশ্য সত্যি হলো না। মুজিবর আরো বার কয়েক রিক্সাওয়ালার বাপ-মা তুলে গালি দিয়ে ভাড়াটা ঠিকমতোই মিটিয়ে দিলো। তারপর রিক্সায় বসা আরোহিনীকে উদ্দেশ্য করে খসখসে গলায় বললো,
‘বইসা আছো ক্যান? কোলে কইরা নামাইতে হইবো নাকি?’
আরোহিনী মেয়েটি তখনো রিকশায় গুটিসুটি মেরে বসেছিল। মুজিবর আর রিকশাওয়ালার বচসায় তার কান ছিল না। দুজন মানুষ বিষধর সাপের মতো একজন আরেকজনের দিকে ফণা তুলে দাঁড়িয়েছিল। একজনের ফণায় ফোঁসফোঁসানির আওয়াজ। আরেকজনের হাবভাব নিস্তেজ। শুধু চোখের আগুনটা বড় জ্বলজ্বলে। অস্বস্তিকর একটা দৃশ্য। আশেপাশের এই ঘৃণাভরা বিষবাষ্পে দম আটকে আসতে চায় মেয়েটার। তবু সে মনে মনে চাইছিল, এই বচসা আরও লম্বা হোক। আরও দীর্ঘ সময় যেন সে এভাবেই চুপ করে বসে থাকতে পারে। সময়টা যদি এখানেই থেমে যেত, সেটিও মন্দ হতো না।

কিন্তু সেটি হলো না। মুজিবরের রুক্ষ আওয়াজে তার সম্বিত ফিরলো। একবারের ওয়ার্নিংয়েও চুপ করে বসে আছে দেখে মুজিবর এবারে হুংকার ছাড়লো,
‘আরে…আরে ঐ ববিতা রাণী! কতা কি কানে ঢুকে না!’
ববিতা নামের মেয়েটি এবারে হন্তদন্ত হয়ে রিকশা থেকে নামতে গেল। আর তাতে কামিজের একটা পাশ ছিঁড়ে গেল তার। মুজিবরের গলা থেকে প্রচণ্ড বিরক্তিসূচক একটা শব্দ বেরিয়ে এলো। রাগতস্বরে বললো,
‘আহ হা! গর্দভ মেয়েমানুষ! ধীরেসুস্থে নামবার পারো না? ছিঁড়া ফ্যাললা তো জামাটা! এই ছেঁড়া জামা নিয়া এখন গিয়া দাঁড়াইবা ঐ বাসায়? ঐখানে মেয়েরা কেমুন ইস্মার্ট হইয়া থাকে জানো সেইটা? এইরকম ছেঁড়া জামা পরা মেয়ে নিয়া যাইতাছি দেখলে আমার উপরেই না রাগ হয়ে বসে! দূর! একটা ভালো কাজের শুরুতেই গণ্ডগোল!

…ঐ মিয়া তুমি এখনো এইখানে কী করো?’
শেষের বাক্যটা রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে। সে তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। তার ওপর থেকে ঝড়ঝাপ্টার ধাক্কাটা সরে গিয়ে এখন মেয়েটার ওপরে গিয়ে পড়েছে। এটাই সে অবাক হয়ে দেখছিল। এই দুজনের সম্পর্কটা আসলে কী, সেটাও মনে মনে যাচাই করে নিতে চাইছিল। ধমক খেয়ে হুঁশ জায়গামতো ফিরে এলো। রিকশার প্যাডেলে চাপ দিয়ে দ্রুত সটকে পড়লো সেই জায়গা থেকে। কিছুদূর গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মুজিবরের দিকে তাকালো। খ্যাক করে কেশে একদলা কফ ফেলে দিয়ে সশব্দে একটা গালি দিল,
‘হারামজাদা বাইনচোত!’

ভাগ্যি ভালো, মুজিবরের সেদিকে কান যায়নি। সে আর তখন সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করলো না। মেয়েটার হাত ধরে একরকম সবেগেই দোতলার দিকে পা বাড়ালো। এই জায়গায় এলে তার ভেতরে কোথা থেকে যেন দুনিয়ার স্ফূর্তি এসে জড়ো হয়। আর আজ বহুদিন বাদে একটা ভালো ‘মাল’ নিয়ে আসতে পেরেছে। অন্তত সেই অজুহাতেও তার আজকের সন্ধ্যা আর রাতটা মন্দ কাটবে না হয়তো। ভাবতেই মনের মধ্যে খুশির পায়রা কেমন বাকবাকুম জুড়ে দিল! আশার পিদিম বাতি জ্বলতে লাগলো বিরতিহীনভাবে।

ববিতার মুখটা পাংশুবর্ণা হয়ে আছে। বুকের ভেতরটা কাঁপছে। গতকাল রাত পর্যন্তও ভয়টা এমনভাবে গেঁড়ে বসেনি তার মনে। পাশের মানুষটাকে সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে ববিতা। তার বোনের বাসায় কাজ করতো। মুখচোরা, আলাভোলা ধরনের মানুষ ছিল। তার ভালোমানুষ দুলাভাইয়ের একান্ত সহচর ছিল এই লোক। মাথা নিচু করে সায় দিত সব কথাতেই।

ববিতার জীবনটাও তো আর এক ধাক্কাতেই এখানে এসে নামেনি! প্রথমে বোনের অস্বাভাবিক মৃত্যু, তারপর কয়েক বছর পরে দুলাভাইয়ের। আর এখন মায়ের। মা বেঁচে থাকতেও সব ঠিকঠাকই চলছিল। মায়ের মৃত্যুর পরেই আচমকা সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল! এই লোক তখন এসে দেখা করলো তার সাথে। ববিতা আশা করেছিল হয়তো কোনো কাজের সন্ধান দিতে এসেছে। লোকটাও এমনটাই বলেছিল। মাথার ঠাঁই হারিয়ে যাওয়ার পরে সবার আগে পেটের কথাই মনে পড়ে যায়। লোকটা গম্ভীর গলাতে বলেছিল,
‘সাতদিন পরে আসুম। এক জায়গায় লইয়া যাবো। আপনার দুলাভাই বাঁইচা থাকতে আমারে দায়িত্ব দিয়া গেছিলো। আপনার তো খাইয়া পইরা বাঁচতে হইবো, তাই না? কাজ লাগবো না?’
ঠিক তো! কাজ তো লাগবেই! কথার ধরনে অবাক হয়েছিল ববিতা। মুখচোরা লোকটা সেদিন অনেক কথা বলে ফেলেছিল হড়বড় করে। এতো কথা সে কবে থেকে বলতে শিখলো! মনে মনে ভেবেছিল ববিতা। আর আজ আসার পথে রিকশাওয়ালার সাথে এই বচসা! এমন মুখ খিস্তি! আপনি সম্বোধনটাও এক ঝটকায় নেমে এসেছে তুমিতে। যেন ববিতা তার সমশ্রেণীয়! এ কার সাথে এলো সে? কোথায় নিয়ে এলো লোকটা তাকে? কোনো বিপদ হবে না তো তার?

হুড়মুড়িয়ে দোতলায় উঠেই একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বার কয়েক শ্বাস নিল মুজিবর। প্যান্টের ঢিলেঢালা বেল্টটাকে চাপাচাপি করে জুতে নিয়ে এলো। কলিংবেলে চাপ দেওয়ার আগে ববিতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘আমি বলার আগে কিছু বলবা না, বুঝলা? একেবারে মুখ বন্ধ কইরা রাখবা!’
প্রচণ্ড শীত শীত একটা অনুভূতি হতে থাকে ববিতার। মনের ভেতরটা বলছে,
‘শুভ নয়, শুভ নয়… অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে তার জীবনে…’

দরজাটা খুট করে খুলে গেল। এতোক্ষণ ধরে আমাশয় রোগীর মতো করে রাখা মুজিবরের মুখটা একেবারে তেল চুকচুকে বোয়াল মাছের মুখ হয়ে গেল। তার পাশ দিয়ে ভয়ে ভয়ে ববিতা উঁকি দিল ভেতরে। ভয়াবহ কিছু অবশ্য দেখা গেল না। হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় তারই সমবয়সী মেয়েটার পাশে আরেকজন নারীকে দেখা গেল। ইনার বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের আশেপাশে। মুখভর্তি উগ্র মেকআপের আড়ালে আসল চেহারা প্রায় বোঝাই যায় না। তবু কেন যেন এই নারীকে একদম অচেনা মনে হচ্ছে না ববিতার। মুখভঙ্গিমা আর চোখ ভ্রুয়ের নাচন তার যেন অনেক দিনের চেনা। দুজনের ফাঁকফোকড় দিয়ে ঘরটার দিকেও এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিল ববিতা। মনটা কিছুতেই কেন যেন স্বস্তি পেতে দিচ্ছে না তাকে।

মুখভর্তি হাসি দিয়ে ওই নারী মুজিবরকে বললো,
‘এসে গেছিস! আরেব্বাহ! এটা কে রে? এতো বড় হয়ে গেছে ববিতা রাণী! সেই কোন ছোটবেলায় দেখেছিলাম! কী… মনে আছে আমার কথা? মনে থাকার অবশ্য কথা না! তখন আমি কত ইয়ং ছিলাম! কত চাহনেওয়ালা ছিল আমার! হায় রে… সেই দিন কি আর আছে? যাকগে…আমার কথা। তুমি আমাকে চিনতে পারলে না ববিতা রাণী? সেই যে দুলাভাইয়ের হাত ধরে এসেছিলা এই বাসায়…মনে নেই? লাল একটা ফ্রক পরে। দু’পাশে দুটো লম্বা বেণী। আমি তো দেখেই বলেছিলাম…এই মেয়েকে আমার চাই! এ থাকবে আমার খাস দেখভালে। দেখলে তো…পেয়েও গেলাম! যা চাই তাই কীভাবে কীভাবে যেন পেয়ে যাই! হা হা হা…’

ববিতার চোখের সামনে থেকে বিভ্রমের একটা পর্দা যেন আচমকাই সরে গেল। ধীরে ধীরে মনে পড়ে গেল সবকিছু। এই বাসা…এই পরিবেশ…আর সামনে দাঁড়ানো চটুলা এই নারী! এর সবই তো তার চেনা! হ্যাঁ, সত্যিই তো সে এসেছিল এই বাসায়! অনেক অনেকদিন আগে! তার প্রিয় দুলাভাইয়ের সাথে ঘুরতে ঘুরতে।
মাথাটা এখনো ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। দুলাভাই কেন আসতো এই বাসায়? ওকে কেন নিয়ে এসেছিল সেদিন? আর এই নারী ওকে কেন চেয়েছিল? কী দরকার তাকে এই নারীর?
অনেক প্রশ্ন ঘুরতে লাগলো মাথায়। প্রশ্নগুলোর উত্তরও ঘুরছে পাশে পাশে…একই সমান্তরালে!

******
সাধারণ পরিবারে বেড়ে উঠলেও অভাব ছিল না ববিতাদের সংসারে। মা আর ওরা দু’বোন। বাবা ওর ছোটবেলায় চলে গেলেও রেখে যাওয়া পেনশন আর বাড়িটার জন্য দুর্ভোগে পড়তে হয়নি তাদের। বোনের বিয়ের পরে তো মায়ের দায়িত্ব অনেকটাই কমে গেল। দুলাভাই হাসিখুশি ভালোমানুষ। প্রায়ই বোনকে নিয়ে হুটহাট এসে যেত ওদের বাসায়। আমুদে মানুষ, গল্প আর আড্ডায় মাতিয়ে রাখতো পুরো বিকেল, সন্ধ্যা। মা খুশি খুশি মনে রান্নাঘরে সপ্তব্যঞ্জন রান্না করতো। জামাইয়ের তৃপ্তি সহযোগে তার হাতের রান্না খাওয়াটা খুব উপভোগ করতো ওর মা। ববিতা তখন অনেক ছোট। সবে সিক্স সেভেনে পড়ে। মাঝে মাঝে সেও বোনের বাসায় গিয়ে থাকতো। বোন দুলাভাইয়ের সাজানো সংসারে কিছুদিন কাটিয়ে যেত।
দুলাভাই থাকতেন তার বাবার রেখে যাওয়া পৈতৃক বাড়িতে। বিশাল বাড়ি, সামনে পিছনে বিশাল বাগান। সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েই দিন কেটে যায়। মুজিবর সেই বাড়িরই পাকাপাকি ভৃত্য। অবশ্য সে ঠিক আর দশজন ভৃত্যের মতো ফাই ফরমাশ খাটতো না। কিছুটা বনেদী ধাঁচেরই ভৃত্য ছিল মুজিবর। কথা বলতো গুনে গুনে। সারাক্ষণ দুলাভাইয়ের সাথে সাথে থাকতো। মাঝে মাঝে এখানে ওখানে যেত। যেসব কাজ দুলাভাই নিজে করতে চাইতো না, সেগুলো মুজিবরকে দিয়ে করাতো। ব্যাংকে গিয়ে টাকা তোলা, বাসার কোনোকিছু নষ্ট হয়ে গেলে মিস্ত্রী ডেকে এনে সারানো, নতুন নতুন গাছ এনে বাগানে লাগানো…এসব টুকটাক কাজ মুজিবর করতো। তাই তার কাজের চাপ তেমন একটা ছিল না। তবু বাড়ির পুরনো লোক। দুলাভাই হয়তো সেজন্যই তাকে পরিবারের সদস্যের মতোই রেখে দিয়েছিল।

ববিতা বোনের বাসায় এলে দুলাভাই মাঝে মাঝে ওকে বেড়াতে নিয়ে যেত। নতুন জামা কিনে দিত। চুলের ক্লিপ, টিপ দেওয়া কানের দুল, চুড়ি…সস্নেহে কিনে দিত তাকে। ববিতার বোন সবিতাও ওদের সাথে থাকতো। একবার ওরা তিনজন মিলে পার্কে বেড়াতে গিয়েছিল। একপাশে চিড়িয়াখানা, আরেকপাশে পার্ক। সারাদিন হৈ হুল্লোড়ে কেটে গেল সারাটা দিন। সেইসব দিনগুলো স্মৃতি হয়ে গেল আচমকা। বিয়ের তিন বছরের মাথাতে একদিন সবিতা হুট করে বিষ খেয়ে নিল!
বিনামেঘে বজ্রপাত হলো যেন ওদের ওপরে। এতোদিনের দিনলিপিতে একবারের জন্যও কারও মনে হয়নি সবিতা কোনো কারণে অসুখী। কিংবা সে নিজেও কারও কাছে কোনো অভিযোগ জানিয়ে যায়নি। তবু বেঁচে থাকাতে কেন এতো গ্লানি এসে জমেছিল, তা কে বলতে পারে! ছোটবেলা থেকেই অভিমানী ছিল। কাউকে সহজে কিছু বলতে চাইতো না। ছোট ছোট মান অভিমান পুষে রেখে দিত। হয়তো সামান্য কোনো মান অভিমানেই জীবনের সাথে লেনাদেনা চুকিয়ে ফেলেছে!

বোনের মৃত্যুর পরে মা কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। শোকটা বইতে পারলো না বেশিদিন। তবুও যতদিন মা বেঁচে ছিল, মাথার ওপরে হাল্কা একটা ছায়া ছিল। দুলাভাই তাদের মা-মেয়েকে দেখতে আসতো মাঝে মাঝে। সাহস দিয়ে বলতো,
‘ববিতাকে নিয়ে ভাববেন না আম্মা। ওর পড়াশুনার মাথা ভালো। আমি ওকে পড়াবো।’
কথার নড়চড় করেনি দুলাভাই। ববিতার পড়ার খরচটা নিয়মিত এসে দিয়ে যেত। ভালোমন্দ খোঁজখবর নিত। আর কতদিন লাগবে শেষ হতে, সেই খবরটাও রাখতো। মাকে বারবার আশ্বাস দিত।
‘আম্মা, আপনার বড়মেয়ে আজ নাই বলে আমাকে পর ভাববেন না। আমি আজীবন আপনার ছেলে হয়েই থাকবো। আপনার ছোটমেয়ের যাবতীয় দেখভালের দায়-দায়িত্ব আমার। ওকে পড়িয়ে ভালো পাত্রের সাথে বিয়ে দিব। আপনি একটুও চিন্তা করবেন না আম্মা।’

দুঃখের মাঝেও মাথা তুলে বেঁচে উঠেছিল ওরা। কিন্তু এতো সুখ ভাগ্যে সইবে কেন? বোনের মৃত্যুর দুই বছর পরই হঠাৎ এক রোড এক্সিডেন্টে দুলাভাই মারা যায়। আর তার এক বছর পরে মাও চলে গেল। মাথার ওপরটা একেবারে ফকফকে সাদা হয়ে গেল। সেই সাদা ফাঁক দিয়ে আকাশটা অবলীলায় রোদ বৃষ্টি ঝড় ঝাপ্টা ঢেলে যেতে লাগলো। আর ববিতাও তা সইতে লাগলো মুখ বুঁজে।
এর মাঝেই আচমকা একদিন মুজিবরের প্রবেশ ওর জীবনে। এতোদিন টাকা পয়সার চিন্তা করেনি ববিতা। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পরে জানা গেল, বাজারে অনেক লেনা হয়ে গেছে। ওর পড়াশুনা আর সংসারের খরচপাতি চালাতে মায়ের গয়নাগুলোতে হাত পড়তে শুরু করেছিল। পেনশনের অল্প কিছু টাকাতে এই দামী বাজারে আর কদিন চলে? তাই মুজিবরের ‘কাজ খুঁজে দেওয়ার’ প্রস্তাবে না করেনি ববিতা। ওর তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ার চলছে মাত্র। পড়াশুনা আর চালাতে পারবে কীনা বুঝতে পারছিল না। বিনা দ্বিধায় চলে এসেছিল মুজিবরের সাথে। ভেবেছিল হয়তো দুলাভাই কিছু একটা ঠিক করে রেখে গিয়েছে ওর জন্য। দুলাভাই যা ভেবে রেখেছে তা খারাপ হতে পারে না কিছুতেই!

ভাবনার অতল সিন্ধু ঘুরে এসে আবার বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ালো ববিতা।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই চটুলা নারী তাকে কখন যেন ভেতরে নিয়ে এসেছে। হাত ধরে এনে বসিয়ে দিয়েছে একটা তক্তপোশে। নিজেও তার পাশে এসে বসেছে। একেবারে গায়ে গা ঘেঁষিয়ে। ভঙ্গিমাটা ভালো লাগছে না ববিতার। কেমন একটা অরুচিকর অনুভূতি মিশে আছে যেন পুরো ব্যাপারটাতেই। অল্পবয়সী মেয়েটা এর মধ্যে এক গ্লাস লাল রঙের কী একটা পানীয় বানিয়ে এনেছে। ববিতার হাতে সেটা জোর করে ধরিয়ে দিয়ে মেয়েটা হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে।
মধ্যবয়সী নারীটি পা থেকে মাথা অব্দি চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে ববিতাকে। যেন কী একটা দেখার বস্তু সে। অশুচি অনুভূতিটা বাড়তে থাকে ক্রমাগত। সারা শরীরে যেন বিষাক্ত বৃশ্চিক ধাঁই ধাঁই করে নেচে বেড়াতে থাকে। অশ্লীল একটা হাসি দিয়ে নারীটি বলে ওঠে এবার,
‘আহ হা…তুমি দেখি আমার চাউনিতেই শরম পাও! পুরুষের চোখের চাউনি সইতে পারবা? হি হি হি… কী রে মুজিবর, তুই এট্টুও বুঝাইয়া পড়াইয়া আনোশ নাই? ওর দুলাভাই বাঁইচা থাকতে তো ম্যালা মাল সাপ্লাই দিছোস! তর তো এমুন ভুল হওনের কতা না রে মুজিবর! আহারে! ববিতা রাণী তো এক্কেরে ভয়ে চিমড়াইয়া গ্যাছে রে!’

ববিতার বুকের ভেতরটা কাঁপতে থাকে।
এরা কীসের আলাপ করছে, এটা না বোঝার মতো বোকা সে নয়। এতো দেরিতে কেন বুঝলো, সেটাই ভাবছে এখন। ইচ্ছে করছে এক ছুটে বাইরে চলে যায়। মুজিবরের দিকে তাকিয়ে গলা শুকিয়ে যায়। সে তখন এক আরাম কেদারায় যুতমত বসেছে। তার মুখের ভাবসাবই বলে দিচ্ছে, আজ এই বাসা থেকে এতো সহজে সে উঠছে না। দুজন তরুণী মেয়ের সাথে সে ইটিস পিটিস করতে করতে কী যেন বলছে। আর মেয়ে দুটো হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে ঢলে পড়ছে। চটুলা নারীটির কথা তার কানে ঢুকলো বলে মনেই হলো না। হয়তো এখানে সে মাঝেমাঝেই আসে। ঐ যে, সাপ্লাই দিতে! সেটাও তো নারীটি নিজের মুখেই বললো।

ববিতার গলা শুকিয়ে আসছে। ইচ্ছে করছে হাতের পানীয়টা এক চুমুকে খেয়ে ফেলে ঢক ঢক করে। লাল রঙটার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন বিবমিষা জাগে। মনে হচ্ছে, কেউ বুঝি টকটকে লাল রক্ত মিশিয়ে দিয়েছে পানীয়তে। ববিতার সত্যি সত্যি বমি করতে ইচ্ছে করে। ওড়নার একটা অংশ দলা পাকিয়ে নিয়ে আসে মুখের কাছে। ওয়াক করে উঠতেই ওই নারী তাকে তাড়াতাড়ি বাথরুম দেখিয়ে দেয়।
সরে এসে দু’দণ্ড ভাবার অবসর পায় ববিতা।

সবিতার চলে যাওয়াটা তাহলে নিছক অভিমান ছিল না! দুলাভাই কীসের নাকি ব্যবসা করতো। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিত,
‘ব্যবসা কি একটা দুইটা আম্মা? চারদিকে চার কিসিমের ব্যবসা আমার! কয়টার কথা বলি বলেন তো?’
আসল ব্যবসা তাহলে এটাই ছিল! ওদের ভোলাভালা মা মনে করেছিল, বনেদী পরিবার। হয়তো ব্যবসাটাও সেরকম বনেদী কিছুই হবে! সবিতাকে বললেও তেমন কিছু জানা যেত না। মাঝে মাঝে শুধু বলতো,
‘সোনার পালঙ্কে ঘুমাই, রূপার বাসনে খাই। চারপাশে তাই অন্ধকার দেখি। কীসের ব্যবসা তা জেনে আমার কী!’

হেঁয়ালিভরা সেই কথার হেঁয়ালিটা ধরতে পারেনি ওরা মা-মেয়ে। অন্ধকারের উৎসটারও তাই সন্ধান করতে পারেনি। সবিতাও তাদেরকে অন্ধকারেই রেখে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে।
এতোদিন নানা অজুহাতে তাকেও এই অন্ধকারে এনে ফেলতে চেয়েছে তার দুলাভাই। ফেলতে পারেনি, হয়তো ভাগ্য ববিতার সহায় ছিল বলে। তবে ফাঁদ পেতে রেখেছিল ঠিকই। আর সেই পেতে রাখা ফাঁদে আজ সে নিজের ইচ্ছায় এসে আটকে গেছে।

বাথরুমের ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরের ঘনিয়ে আসা অন্ধকার দেখে ববিতা। ওর চারপাশের আলোটাকে বড় কৃত্রিম মনে হতে থাকে। বরাবরই সবিতা সাহসী ছিল। চাপা, লুকোনো সাহসী। কষ্টকে লুকিয়ে রেখে নিজেকে নিঃশেষিত করে ফেলার মতো দুর্দাম সাহসী!
আজ ববিতারও খুব সাহসী হতে ইচ্ছে করে। ভীষণ ইচ্ছে করে এই কৃত্রিম আলোকমালা ভেদ করে ঐ অকৃত্রিম অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ার।
বাথরুমের বাইরে পায়ের আওয়াজ ঘন হতে থাকে। খুব বেশি সময় নিয়ে নিচ্ছে ববিতা। এতোটা সময় কি কেউ কাউকে দেয়, কিছু একটাকে বেছে নেওয়ার জন্য?

 

লেখক পরিচিতি:

Executive Engineer
PWD
Dhaka
শেয়ার করুন: