হুমায়রা নাজিব নদী:
ইদানিং ফেসবুকে বিভিন্নজনের প্রোফাইলে একটা অভিযোগ মাখা পোস্ট প্রায়ই ঘুরাঘুরি করতে দেখি। সেটা হচ্ছে স্ত্রীরা পুরুষের জন্য অনেক স্যাক্রিফাইস করা সত্ত্বেও পুরুষরা ‘প্রিয় নারী’ বলতে সবসময় নিজের মায়ের কথা মেনশন করে। কোনো পুরুষ ´প্রিয় নারী´র ভূমিকায় স্ত্রীকে মেনশান করে না।
পোস্টটা যারা শেয়ার করেছে, আমার জানা মতে তাদের প্রায় সবাই নারী এবং তারা পুরুষদের তীব্র সমালোচনা করেই শেয়ার করেছে। আর এই সমালোচনার জবাবে কিছু পুরুষও প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে, ‘নারীদের মধ্যে কতজন ‘প্রিয় পুরুষ’ হিসেবে স্বামীর কথা উল্লেখ করেছে? ৯৯ শতাংশ নারীই ‘প্রিয় পুরুষ’ বলেছে তাঁর বাবাকে।
যেহেতু নারীরাই প্রথম এই ধরনের বিতর্কিত একটা পোস্ট ক্রিয়েট করেছে এবং সমানতালে শেয়ার দিয়েছে, তাই এইসব নারীদের কাছেই প্রথম জিজ্ঞাসাটা রাখছি। মায়ের সাথে স্ত্রীর এই তুলনাটা আসলে কতোটা যুক্তিযুক্ত?
উল্লেখিত পোস্টে বলা হয়েছে ছেলেরা প্রিয় নারী হিসেবে মাকে ছাড়াও অন্যান্য নারীদের কথা উল্লেখ করেছে। অথচ বৌয়ের কথা কেউ বলেনি। বউ হসপিটালে রাত জেগে সেবা করেছে, বাবার বাড়ির লাক্সারি ছেড়ে এসেছে.. আরো বহু কিছু। ধরে নিচ্ছি কথাগুলো সত্য। কিন্তু একবার হিসেব করে দেখেছেন কি, জীবনে কতবার আপনি আপনার স্বামীর জন্যে হসপিটালে রাত জেগে সেবা করেছেন, আর কতবার তাঁর মা তাঁর জন্য রাতের পর রাত জেগেছে? আপনারা যারা এই তুলনায় অংশ নিয়েছেন, তাদের অনেকেই মা। অনেকের এক বা একাধিক সন্তান। একজন মা তাঁর সন্তানদের জন্যে কীভাবে এবং কতটা স্যাক্রিফাইস করে, সেটা তো আপনাদের নতুন করে বোঝানোর কিছু নেই। তারপরও সব জেনেবুঝে এই ধরনের তুলনা প্রচণ্ড বিবেকহীন এবং হিংসুটে মানসিকতার পরিচয়।
যারা এই ধরনের পোস্টকে সাপোর্ট দিয়েছেন, তারা একবার নিজেকে প্রশ্ন করেন, যে সন্তানদের জন্য আপনারা নিজের রুপ যৌবন, শখ আহ্লাদ সব বিসর্জন দিয়ে রাতদিন অক্লান্ত খাটুনি দিয়ে যাচ্ছেন, সেই সন্তান যদি বিয়ের দুদিন পর বলে তাঁর প্রিয় নারী হচ্ছে বউ, একটুও কি ধাক্কা খাবেন না ভেতরে ভেতরে? আজকে স্বামী যখন বলছে প্রিয় নারী তাঁর মা, তখন আপনাদের খারাপ লাগছে, তুলনা চলে আসছে। একটু খতিয়ে দেখুন, যে মানুষটা দুদিন হলো আপনাকে পেয়ে মায়ের সাথে তাঁর জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধনকে অস্বীকার করছে না এবং মায়ের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে মাকে প্রিয় নারীর সর্বোচ্চ আসনে স্থান দিচ্ছে, আপনার কি মনে হয় না যে সে প্রচণ্ডরকম কৃতজ্ঞতা সম্পন্ন একজন মানুষ?
যে মানুষটার ভেতরে নিজের মায়ের প্রতি এই কৃতজ্ঞতাবোধ আছে, সেই মানুষটা আপনার অবদানকেও কোনোদিন অস্বীকার করবে না। সংসার বড় মায়ার স্থান। তাঁর জীবনে আপনার অবদান গুলো জমা হতে হতে ´প্রিয় নারী´ বলতে একদিন তাঁর মানসপটে মায়ের পাশাপশি আপনার মুখটাও ভেসে উঠবে। কিন্তু সেই মায়া তৈরি হওয়ার জন্যেও কিছু টাইম দেয়া প্রয়োজন।
নাড়ির সম্পর্কের যে উচ্চতা, সেখানে পৌঁছানো তো আর দুদিনের তরতরিকা না, মায়া মমতা আর বিশ্বাস দিয়ে তৈরি অনেকটা পথ। তবে সংসার করতে করতে নিশ্চিত যে সেই স্থানের কাছাকাছি একটা জায়গা আপনার জন্য থাকবে। আর সেই কারণেই অনেক পুরুষকে দেখা যায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার সময় তাঁর স্ত্রীর নামে কিনে থাকে। আর তার চাইতেও বড় কথা হচ্ছে হিসেব করে দেখলে দেখবেন একজন পুরুষ ক্যারিয়ার স্টার্ট করার পরে যখন বিয়ে করে, তারপর থেকে মায়ের চাইতে স্ত্রীর পেছনেই বেশি খরচ করে। তাই স্বামী যখন প্রিয় নারী ভূমিকায় মায়ের কথা বলে, তখন ঈর্ষান্বিত না হয়ে তাঁর কৃতজ্ঞতাবোধকে এ্যাপ্রিসিয়েট করা উচিৎ।
আজকে আপনার স্বামী তাঁর মায়ের কথা বলছেন, কালকে ওই মানুষটার সন্তান আপনার কথা বলবে। কারণ মায়ের প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ব, কৃতজ্ঞতাবোধ, এসব সন্তান তাঁর বাবার থেকেই শিখবে। আবার যখন আপনার পুরুষটি প্রিয় নারী বলতে তাঁর কন্যার নাম মেনশান করে, বুঝতে হবে কন্যার প্রতি একান্ত স্নেহ ভালোবাসার থেকেই সে এটা বলেছে। তাঁর কন্যা কিন্তু আপনারও সন্তান। সেখানেও কম্পেয়ারিজনটা নিতান্তই ছেলেমানুষি।
উক্ত পোস্টের কমেন্ট বক্সে নারীদের অনেককেই দেখলাম প্রিয় পুরুষ হিসেবে বাবার সাথে নিজ পুত্রের কথা বলেছে। তারা যদি পুত্রের কথা বলতে পারে, তাহলে পুরুষরা কেনো কন্যাকে প্রিয় নারী বলতে পারবে না? প্রশ্নগুলো একবার নিজেকে করবেন।
এবার আসছি সেইসব পুরুষদের প্রসঙ্গে, যারা নারীদের এই পোস্টে পাল্টা অভিযোগ করেছেন যে নারীরাও সবাই প্রিয় পুরুষ হিসেবে তাদের বাবা, নয়তো পুত্রকে মেনশান করেছে।
এইসকল পুরুষদের কাছে প্রশ্ন, কতদিন ধরে বউ পালছেন আপনারা, যে এক লাফে বাবার স্থানটা আশা করেন? আপনাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, যদিও এই যুগের একজন নারী তাঁর জীবনের লম্বা একটা সময় বাবার বাড়িতে কাটিয়ে এসে শ্বশুর বাড়ি বা স্বামীগৃহে প্রবেশ করে। তারপরেও এই বিতর্কে নারীরা পুরুষের চেয়ে একধাপ এগিয়ে, সেটা এই কারণে যে বেশ দু তিনজন নারীকেই কমেন্ট বক্সে উল্লেখ করতে দেখলাম যে তাঁর প্রিয় পুরুষ হচ্ছে স্বামী। যদিও সংখ্যাটা কম, কিন্তু জিরো না।
এমনকি আমিও আমার প্রিয় পুরুষের তালিকায় আমার স্বামীকেই রেখেছি। এখানে একটু ভেঙ্গে না বললেই নয়। আমার স্বামীর সাথে আমার এগারো বছরের বিবাহিত জীবন। ভালোমন্দ, সুখে-দুখে একসাথে এতোগুলো বছর কাটানোর পরে বলতে পারবো, যতো না আমাদের ঝগড়া করার স্মৃতি, তার চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসা আর খুঁনসুটি ভরা প্রিয় স্মৃতির ভাণ্ডার। তাই সে আমার প্রিয় পুরুষ। এবার কেউ যদি প্রশ্ন করেন, আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি কোন পুরুষকে, তাহলে বলবো আমি সবথেকে ভালোবাসি আমার বাবাকে। সবচেয়ে বেশি মায়া ফিল করি আমার বাবার জন্য। আমার বুকের ভেতর যে জায়গাটা জুড়ে আমার বাবা আছেন, ওই জায়গাটা পৃথিবীর কোন পুরুষ নিতে পারেনি, পারবেও না।
খুব সম্ভবত এই জায়গাটা থেকেই বেশিরভাগ নারী প্রিয় পুরুষ বলতে বাবা বা পুত্রকে বুঝিয়েছে। পুরুষরা যেমন মায়ের অবদান অস্বীকার করতে পারে না, মায়ের মমতা ভুলে থাকতে পারে না, কিংবা কন্যার প্রতি অতিমাত্রায় স্নেহ পরবশ থাকে, একজন নারীরও হৃদয়ে একই ফিলিংস থাকতে পারে তাঁর বাবা বা ছেলের জন্যে। এখানে একটার সাথে আরেকটা তুলনা করাটাই হাস্যকর রকমের ছেলেমানুষি। কী নারী অথবা পুরুষ, প্রত্যেকের ভাবনা, আবেগ কিংবা ভালোবাসার স্থান জুড়ে একেকটা সম্পর্ক একেকভাবে বিদ্যমান। মা, স্ত্রী কিংবা কন্যা, প্রতিটা পুরুষের জীবনের একেক অংশে এরা একেকটা ভূমিকায় অবদান রাখে। নারীদের জীবনেও তাই। আর সেই কারণেই এই ধরনের ছেলেমানুষি তুলনা কিংবা অসুস্থ প্রতিযোগী মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসা নারী পুরুষ উভয়ের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যই মঙ্গলজনক।