নারী তুলে ধরে সভ্যতার আকাশ

মাসকাওয়াথ আহসান:

কো এডুকেশন বা নারী-পুরুষ সহশিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে সহজ একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়, পারসন হিসেবে একে অপরকে দেখতে শেখে শিশুরা। আমাদের সমাজে কো এডুকেশন সর্বত্র না থাকায় নারী-পুরুষ মানসিক দূরত্ব থেকে একরকমের ভ্রান্ত প্রতিপক্ষতা তৈরি হয়েছে।
অথচ প্রতিটি পরিবারে মা থাকেন মায়ার কেন্দ্রবিন্দুতে, যিনি সবাইকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে একসঙ্গে রাখেন। বোন পরিবারে থাকে সেই মায়ার সম্প্রসারিত রুপ নিয়ে। যে পুরুষ মায়ের স্নেহ আর বোনের ভালোবাসা পেয়েছে; তার চেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ আর কে আছে!

কো এডুকেশনে পুরুষের যে নারীবন্ধু হয়, তারা আমৃত্যু বন্ধু থাকে। পুরুষ পরস্পরকে খানিকটা ঈর্ষা করলেও নারীর মধ্যে এই ঈর্ষা থাকে না।
অতীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কো এডুকেশন হলেও নারীর সঙ্গে কথা বললে পুরুষকে পঞ্চাশ পয়সা জরিমানা দিতে হতো। ফলে সেই অচেনা নারীকে পুরুষ কবিদের অনেকে ছলনাময়ী হিসেবে চিত্রিত করেছেন, অথচ নারীর চেয়ে স্ট্রেইট মানুষ হতেই পারে না।
পৃথিবীর প্রতিটি নারী ভালোবাসায় বিশ্বাসী; আর প্রতিটি পুরুষ পরিচালিত হয় জৈবিক প্রবণতার মাধ্যমে। নারী প্লেটোনিক ভালোবাসাকে গভীরভাবে চর্চা করতে সক্ষম। আর পুরুষের মাঝে “যে ডাকি আইরে, তার পিছে যাইরে” এমন মনস্তত্ব রয়েছে।

নারীর মধ্যে যে নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়; তা পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম-সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার হাজার বছরের শোষণ ও নিপীড়নের ফলাফল। নারীকে ভূমি ও সম্পদের অধিকার বঞ্চিত করে; ধর্মীয় ফিকশনের মাধ্যমে তাকে স্বামী, ভাই ও ছেলের ওপর নির্ভরশীল করে রাখার যে ফাঁদ পাতা হয়েছে; সেই পরনির্ভরতার অনিশ্চয়তা নারী মনস্তত্বে যে সংকীর্ণতা তৈরি করে; তা-ই বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব হিসেবে চিত্রিত। সমমেরুতে এই বিকর্ষণ ঘটিয়ে পুরুষ সমাজ খুব উপভোগ করে এই দ্বন্দ্ব। নারী যদি ভূমি ও সম্পদে সমান অধিকার পায়, তার যদি আত্মনির্ভর জীবন কৌশল থাকে; তাহলে বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্বের মিথ বলে আর কিছু থাকবে না।

নারীকে নানাভাবে এক্সপ্লয়েট করা হয়। ভণ্ড সাধু- ভণ্ড পীর-চরিত্রহীন আমসিপারা শিক্ষক থেকে ভণ্ড অফিসের বস, পার্টির ভণ্ড বড় ভাই, চরিত্রহীন গানের শিক্ষক, কাস্টিং কাউচের নোংরা চলচ্চিত্রকার, বিকৃত পেইন্টার, বিজ্ঞাপন নির্মাতা, আইটেম নাম্বারের ডান্স ডিরেক্টর; এরকম একটি সিন্ডিকেট নারীর সরলতা ও চাইল্ডলাইক মনের সুযোগ নিয়েছে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে।

পৃথিবীর স্থায়ীতম উপনিবেশ হচ্ছে পুরুষের উপনিবেশ; যেখানে নারী ভিক্টিম। পুরুষের জৈবিক প্রবৃত্তি নির্ভর জীবনে যৌনকর্মীর পেশাটি তাদেরই তৈরি। নারী এখানে তার ভোগ্যপণ্য। নারীর দারিদ্র্য, শরণার্থী জীবনের অনিশ্চয়তা, প্রেমিকের ফাঁদে ফেলে যৌন কর্মীদের এই ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। যদি ভাত-কাপড়ের সংস্থান থাকে; তাহলে কোন নারী এই পেশায় যেতে রাজি হবে না। যে দারিদ্র্যে বিশীর্ণ নারী বিলাসি জীবন দেখেনি তাকে বিলাসি জীবনের লোভ দেখিয়ে কলগার্ল বা হুকারের জীবনে নিয়ে আসে পুরুষদের অপরাধী সিন্ডিকেট।
প্রতিটি ধর্মের প্রফেট পুরুষ; ফলে সেই সুযোগ নিয়ে ধর্মের পুরুষ ঠিকাদারেরা গোটা পৃথিবীতে নারী নির্যাতন করেছে একথা বলে যে, নারী পুরুষের অধীনস্ত, তাকে পুরুষের সব কথা শুনে চলতে হবে। প্রতিটি ধর্মের কল্পনার ঈশ্বর পুরুষ। ঈশ্বর যদি নারী হতেন; তাহলে হয়তো পৃথিবীতে নারীর এই নিঃগৃহীত জীবন হতো না।
রাষ্ট্রেও ফার্স্ট লেডি, মন্ত্রী ভাবী, আর্মি চিফ ভাবী, সচিব ভাবী, ডিসি ভাবী, এসপি ভাবী; এসব আলংকরিক পদ মর্যাদা হচ্ছে; নারীকে ক্ষমতা কাঠামোর শোভা শো পিস করে রাখার ষড়যন্ত্র।

অনগ্রসর সমাজগুলোতে কোন নারী পুরুষের ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করলেই অমনি তাকে “বেশ্যা” বলে গালি দেয়া পুরুষ সমাজের নিজের দুর্বলতা ঢাকতে গোবর ছুঁড়ে মারা। একটা স্ক্যান্ডাল দিয়ে দিতে পারা নারীকে দমিয়ে রাখার অপকৌশল।
গোটা পৃথিবীর সভ্যতার আকাশকে ওপরে তুলে ধরে রেখেছে নারী; অথচ সভ্যতা এগিয়ে নিয়ে যেতে তার এই অবদান থ্যাংকলেস জব হয়ে আছে।
সেই দিনের ছেলে গালে দুটো দাড়ি গজালে টিভি টকশোতে এসে বলে, নারী গৃহে থাকাই ভালো। সেই দিনের ছেলে কপালে তিলক এঁকে ভ্যালেটাইন্স ডেতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের ধরে; নারীকে কলংক দেয়।

প্রতিশ্রুতিশীল নারীদের অল্পবয়সে গাছের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে অসংখ্য মাদাম কুরি, ভ্যালেন্টিনা টেরেসকোভা, ভার্জিনিয়া উলফ, মার্গারেট থ্যাচার কিংবা আঙ্গেলা ম্যারকেলকে জীবন্ত কবর দেয়া হয় দক্ষিণ এশিয়ায়। আর রাজনীতিকের এতিম কন্যা অথবা বিধবা স্ত্রীকে রাজনীতির মাজারে গদিনশীন করে দেশলুন্ঠন করে ইঁদুর পুরুষ সমাজ।

পুরুষ সমাজের সমস্ত দুঃশ্চিন্তা, যদি স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়; তাই সে স্ত্রীকে ভয় ভীতি দেখিয়ে, ধর্মের অজুহাত দিয়ে, সন্তানের দিব্যি দিয়ে দাস-জীবনে আটকে রাখতে চায়। অথচ পুরুষের আত্মবিশ্বাসী হবার কথা ছিলো, যে যায় সে যায়। কারো সঙ্গে এডজাস্টমেন্ট না হলে ভদ্রভাবে আলাদা হয়ে যাওয়া ভালো। তা না করে জীবন ব্যাপী কলতলার কাইজ্জা করে সবকিছুকে তেতো করার এই সংস্কৃতি। রাজনীতিক বারাক ওবামার মা-বাবা মতবিরোধের কারণে ভদ্রভাবে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের ছেলেটি এমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছে ও নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। আর দেখেন গিয়ে সারাজীবন বাবা-মায়ের ঝগড়া শুনতে শুনতে অর্ধোন্মাদ হয়ে গেছে ওবামার মতো সম্ভাবনাময় দক্ষিণ এশীয় ছেলে-মেয়েরা।

প্রাচ্যের মায়ার নামে হিপোক্রেসির লীলাভূমি এই দক্ষিণ এশিয়া। অথচ পুরুষ সমাজ একটু কনফিডেন্ট হলে, সারা জীবন নারী নারী করে তেজপাতা না হয়ে গেলে; নারী সমাজ তার শ্রমের শৈলীতে কল্যাণরাষ্ট্র গড়তে নেতৃত্ব দিতে পারতো। ইউরোপে নারী সমাজ স্বাধীনভাবে শ্রম দেবার সুযোগ পেয়েছে বলে দেশগুলো কল্যাণরাষ্ট্র হয়েছে।

আমাদের গ্রামের লোকের ধারণা ঘোমটা না দেয়া মানেই বিকিনি পরে ঘোরা। এইজন্য ইউরোপে গিয়ে স্কার্ট পরা মেয়ে দেখে প্রগলভ হয়ে তাকে কু প্রস্তাব দিয়ে চড় খাওয়ার সর্বোচ্চ রেকর্ড করেছে দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামের লোকেরা। ইউরোপের রেনেসাঁর আলোয় উদ্ভাসিত মেয়েরা কক্ষণো দাড়ি টুপিওয়ালা লোক দেখলে তাকে ছাগু বলে না, মুখ টিপে হাসে না। আমাদের গ্রামীণ সমাজে মেয়েরা একটু রবীন্দ্র প্রিভিলেজড কোহর্ট হলেই দাড়ি টুপি নিয়ে হাসাহাসি করে। এসব গ্রাম্য আচরণ তারা শিখেছে টিপে টিপে কথা বলা লোলুপ সংস্কৃতি মামাদের কাছ থেকে। নারীর মাঝে যে কোন নেতি দেখলেই খুঁজে দেখবেন এর পেছনে কোন খল পুরুষের হাত আছে কিনা।

সহজ সরল একটি দম্পতির সম্পর্কে চিড় ধরায় সংস্কৃতি মামা। একজন সহজ সরল পুরুষ অতো নাটক করে কথা বলতে পারে না। জটিল সংস্কৃতি মামা মানেই প্রেম নিবেদনের অপার ক্ষমতা। ওর জীবনে তো আর কোন কাজই নাই; প্রেম করে বেড়ানো আর ভিক্টিম মেয়েদের হানি ট্র্যাপের ট্রেনিং দিয়ে প্রণয় নিকেতনের জোগালদার হিসেবে কাজ করা।

কাজেই নারীর সঙ্গে মানসিক দূরত্ব না রেখে কথা বলুন। তাকে বিকশিত হতে দিন। মেল শভিনিজম কখনো কোন পুরুষকে সুখি করেনি। নারীকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করতে দিন; কর্মক্ষেত্রে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ করে দিন; পথে ঘাটে গণপরিবহনে তার চলাচলকে নিরাপদ করুন; সমাজ অর্থনীতিতে মিরাকল ঘটে যাবে। কল্যাণ রাষ্ট্র তখন কল্পনা থেকে এসে ধরা দেবে আমাদের বাস্তবের উদার জমিনে।

মাসকাওয়াথ আহসান: রম্যলেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট

শেয়ার করুন: