রজ:চক্র ও নারী স্বাধীনতা

জাকিয়া সুলতানা মুক্তা:

নারীর ক্ষমতায়ন নির্ভর করে নারীর নিজের মাঝে থাকা সুতীব্র বাসনা আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এ ব্যাপারে সহনশীল আন্তরিকতার উপর। নারীকে তো প্রতিনিয়ত পুরুষতান্ত্রিক নানান অনতিক্রম্য বাধার মাঝে পড়তেই হয়, সেইসাথে তাকে প্রকৃতিগত কিছু অবশ্যসম্ভাবী জটিলতাকেও প্রত্যহ সামলাতে হয়।

নারীর জীবন তার শারীরিক যে অভ্যন্তরীণ জটিল কাঠামো, তার মতনই জটিল ও সংবেদনশীল। অবস্থার দৃষ্টিতে স্বীকার করতেই হয় যে, বহুদিন যাবৎ নারীর স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন একটি দুষ্টচক্রের মাঝে আটকে আছে। আর তা হলো নারীর সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতার সাথে জড়িত দু’টো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: একটি নারীর জীবনে রজ:চক্রের মাসিক প্রক্রিয়াটি এবং আরেকটি হলো যৌন সঙ্গমের ফলাফলে নারীর সন্তানবতী হওয়ার প্রকৃতিপ্রদত্ত সক্ষমতা।
এসবকে দুষ্টচক্র বলে উল্লেখ করার কারণ হলো, এই দু’টো বিষয়কে নারীর দুর্বলতার জায়গা হিসেবে, পুরাণভক্তিতে ও প্রাত্যহিক জীবনচর্চায় সমাজ ও ব্যক্তিমানসে নিত্যই দেখে আসা হচ্ছে।

জাকিয়া সুলতানা মুক্তা

একটা সময়ে যখন সম্পত্তির উপরে ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠিত ছিলো না, তখন সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে লোকের মাথাব্যাথা ছিলো না। তাই অন্তত পুরাকালে এক্ষেত্রে নারীর জীবনটা ছিলো স্বাধীন। যার নমুনা ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। চাইলে এক বইয়ের আকর ধরে না রেখে, বরং জ্ঞানবিজ্ঞানের বহুধারায় সেসব ইতিহাস খুঁজলে যে কারোর পক্ষে এই সত্যের নির্মোহ নির্যাস খুঁজে বের করা সম্ভব।

ইতিহাস আলোচনা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়, বাস্তব অনুশীলন নিয়ে আলোচনা করাই এই লেখার মূল আগ্রহ। তাই এ বিষয়ে এতটুকু সারসংক্ষেপ টেনেই বলা যায় যে নারী বর্তমান সভ্যতা বিনির্মাণে তার সন্তানবতী হওয়ার সময়ে বুদ্ধিদীপ্ত জ্ঞান প্রয়োগ করে, খাদ্য উৎপাদনের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলো। যদিও সেই আবিষ্কার উলটো বরং তাকেই শৃঙ্খলবন্দী করেছে, অন্তরীণ জীবনে বাধ্য করেছে। তার জীবনকে করেছে সঙ্গীন ও পরনির্ভরশীল। তবুও আধুনিক বিশ্ব নারীর জীবনকে যে আবিষ্কারের মাধ্যমে, কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে তা হলো জন্মনিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে লিঙ্গ আবরণী বা কনডমের ব্যবহার আবিষ্কার করে। এছাড়াও জন্মনিয়ন্ত্রণের অন্যান্য অপরাপর অত্যাধুনিক পদ্ধতির আবিষ্কার ও সন্তান জন্মের বিষয়ে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতিও নারীকে অনেক স্বস্তির জীবন এনে দিয়েছে।

নারী ও নারীর পরিবার-সমাজের যদি আন্তরিকতা থাকে, তবে এখন অপ্রত্যাশিতভাবে নারীর সন্তানবতী হওয়া রোধ করা যায়। এটা নারীর ও বৈশ্বিক অপরাপর জীবনের জন্য এক স্বস্তিদায়ক ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আজকের বিশ্বে নারীর বিশ্বব্যাপী যে স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নের চর্চা, তার অন্যতম প্রভাবক নারী-পুরুষের যৌনসঙ্গমে এই লিঙ্গ আবরণীর ব্যবহার তথা সন্তানবতী হওয়া রোধের অন্যান্য পদ্ধতিগুলোর বৈপ্লবিক ভূমিকা। এটি নারীকে অযাচিত অনেক দায়িত্ব থেকেও মুক্তি দিয়েছে। নারী এখন চাইলেই যখন-তখন তার সন্তানবতী হওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কিংবা সন্তানবতী হয়ে পড়লেও, মাতৃত্বের মতন গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের প্রারম্ভিক যে জীবনঝুঁকির ভীতি তাকে পার হতে হয়, সেই ভীতিজনক অবস্থার প্রেক্ষিতটি খানিকটা পাল্টেছে বলে নির্ভার বোধও করতে পারে।

কিন্তু নারীজীবনে এই স্বস্তির জায়গাটা অর্জন কেবল নারীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয়, এর সাথে বৈশ্বিক-রাষ্ট্রীয়-সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-পারিবারিক কিছু পুরুষতান্ত্রিক স্বার্থও জড়িত। বর্তমান বিশ্বে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ একটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ বিবেচ্য বিষয়। অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বিশ্বের জন্য অশনিসংকেত। তাই পুরুষতান্ত্রিক বিশ্ব চেয়েছে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং তাতে নারী মুফতেই খানিক স্বস্তি পেয়েছে। এতে নারীরা অখুশি নয়, বরং খুশিই।

তবে হ্যাঁ! এসব উদ্ভাবন নারীর জীবনকে অনেকখানি নির্ভার করে দিলেও, নারীকে সন্তানবতী হওয়ার প্রকৃতিপ্রদত্ত ভূমিকা নেওয়াতে যে বিষয়টিকে প্রতি মাসে অন্তত সহ্য করে নিতে হয়; তার ঝুটঝামেলা কিন্তু নেহায়েতই কম নয়। নারীকে প্রতি মাসেই তার রজ:চক্র চলার সময়ে যে পরিমাণ কষ্ট সহ্য করতে হয়, তা অবর্ণনীয় কষ্টের।

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় তো এখন জানা যাচ্ছে যে, রজ:চক্রের সময়ে বহু নারীর রজ:কালীন ব্যথা এতোটাই হয়ে থাকে যা একাধিক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধের ব্যথার মতন হতে পারে। এ ব্যাপারে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক John Guilleaud-এর মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি উল্লেখ করেছেন, “menstrual cramping can be as bad as having a heart attack.” সুতরাং বলা যায় যে নারীর জীবনে এই রজ:চক্রের সময়টা প্রতি মাসেই একটি ভীতির কারণ হিসেবে এসে দাঁড়ায়। তবুও সভ্যতার বিনির্মাণে নারীকে এই কষ্ট সহ্য করে নিতে হয় বা প্রাকৃতিকভাবেই তা নিতে হবে এই যেন নিয়তি।

বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে নারীর এরূপ সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় নিয়েও আলোচনা-গবেষণা বর্তমান সময়ে চলছে। একারণে বর্তমানে নারীর ঋতুকালীন সময়ে স্বস্তি প্রদানের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী স্যানিটারি ন্যাপকিনের বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে জনপ্রিয় এই বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে বহু প্রাচীনপন্থী অবৈজ্ঞানিক চর্চাকারীগণ বরাবর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তবুও স্যানিটারি ন্যাপকিনের ক্ষেত্রে যতটা অভ্যস্ততা নারীর জীবনে এসেছে, তাতে এটা বলা যায় যে, এর ব্যবহার যৌন সঙ্গমে লিঙ্গ আবরণীর ব্যবহার বা জন্মনিয়ন্ত্রণের অপরাপর পদ্ধতিগুলোর অনুসরণের মতনই নারীকে অনেক স্বস্তি এনে দিয়েছে। এর ব্যবহারে নারী আগের চেয়ে অনেকখানি স্বাধীন হয়েছে।

কিন্তু রজ:চক্র চলার সময়ে এর চেয়েও ভালো পদ্ধতির আবিষ্কার ইতিমধ্যেই হয়েছে এবং আধুনিক নারীরা তা ইতিমধ্যেই গ্রহণ করতে শুরু করেছে। তার সেই পদ্ধতিটি হলো রজ:চক্র চলার সময়ে ‘মেন্সট্রুয়াল কাপ’-এর ব্যবহার। এই মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারে নারী আর দশটা সাধারণ দিনের মতনই রজ:চক্র চলা কালেও স্বাধীন ও স্বাভাবিক দিন কাটাতে পারে। এতে কোনরকম অস্বস্তি হওয়া কিংবা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব হওয়া অথবা ভেজাভেজা-দুর্গন্ধময় অনুভূতির সম্মুখীন হতে হয় না। যা এতোদিন যাবৎ নারীকে তার রজ:চক্র চলার সময়ে কাপড় বা স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সম্মুখীন হতে হতো।

তাই এবারের নারী দিবসে বাংলাদেশের নারীর জন্য রজ:চক্রকালীন মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের উৎসাহ প্রদান ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখাকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচ্য হওয়া কাম্য। নারী যেহেতু সন্তানবতী হওয়ায় সক্ষম এবং সভ্যতারও যেহেতু অগনিত সন্তানের প্রয়োজন, তাই সন্তানবতী নারীর সন্তান জন্মের জন্য অনুঘটক রজ:চক্রকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।

এরই প্রেক্ষিতে রজ:চক্রকালীন নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার্থে যথাযথ আরামদানে ও সমর্থনে সর্বাধুনিক প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করায় মনোযোগ দেয়া দরকার। আসছে নারী দিবসে এই লক্ষ্যে প্রচার-প্রচারণা ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে আসুন আমরা সবাই এগিয়ে আসি। জনস্বার্থে নারীর রজ:চক্রকালীন স্যানিটারি ন্যাপকিন, সম্ভব হলে মেন্সট্রুয়াল ক্যাপের ব্যবহার বৃদ্ধিতে সচেতনতা বাড়ানো এবং তার সাথে সাথে এসবের সহজলভ্যতায় রাষ্ট্রীয় প্রণোদনায় (শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান, ভেন্ডিং মেশিনের ব্যবহার বাড়ানো, জাতীয় বাজেটে ভর্তুকির ব্যবস্থা প্রবর্তন ইত্যাদি) বরাদ্দ বাড়ানোর দাবিতে সোচ্চার হই।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.