সত্য ঘটনা -১

রীমা দাস:

ঘটনা ১: এক ছেলে, এক মেয়ে আর বর নিয়ে গোছানো ছোট্ট সংসার আমার। ভালোভাবে জীবন যাপনের জন্য নিজেদের বাড়ি বর্ধিত করছি। চারতলার কাজে হাত দিয়েছি, ঘরে রং হচ্ছে। বাড়িতে উৎসবের আমেজ। চোখ ভরে সেই আনন্দ দেখছি।
রোজার সারাদিন আমি ব্যস্ত থাকি রান্না ঘরে। মেয়ে কী খেতে পছন্দ করে, ছেলের বায়না কীসে আর আছে ছেলেমেয়ের বাবার পছন্দ– সব মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা। তবুও আমি ভীষণ সুখি। দিনশেষে ওদের মুখের হাসি আমাকে তৃপ্তি দেয়। নিজেকে ভালো স্ত্রী, ভালো মায়ের কাতারে দাঁড় করাতে পারি।
আমি কি সত্যি ভালো মা? গত পরশুদিন বিকেলে আমি রান্না ঘরে ব্যস্ত ইফতার তৈরিতে। হঠাৎ আমার আট বছর বয়সী মেয়ে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আমি কি একটু কেঁপে উঠেছিলাম? হ্যাঁ, কেঁপে উঠেছিলাম অজানা আতঙ্কে। ছোট্ট মেয়েটার শরীর কাঁপছে, চোখ ছলছল, হৃদপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুত, মুখ লাল ও থমথমে।
আমার ছোট্ট সোনাটার  এই অবস্থা দেখে মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো। আমি দ্রুত মেয়েকে কোলে নিলাম। আমার ছোট্ট সোনা, তার কচি হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে রাখলো। আমি টের পেলাম আমার মেয়ের হৃদস্পন্দনের দ্রুতগতি। আমার কেন যেনো মনে হলো মেয়েকে আমি আমার উদরের নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে দেই। কত সময় কাটলো এভাবে রান্না ঘরে জানি না। দুজন মানুষ মা আর মেয়ে, দুজন মানুষ পরম নির্ভরতার, শুধু তারাই জানে মা মেয়েকে আগলে রাখবে, মেয়ের বিপদে মা’ই আসবে।
মেয়ের মুখে পানি দিলাম, জানতে চাইলাম –” কী হয়েছ সোনা?” 
মেয়ে– ঐ আঙ্কেল আমাকে জোর করে পাশের ঘরে নিয়ে গেলো। আমি আর ভাই দাঁড়িয়ে দেখছিলাম তারা কিভাবে কাজ করছে। ভাইকে চারতলায় পাঠিয়ে আঙ্কেল আমাকে ডেকে নিলো। আমি তো কোনো জিনিস ধরিনি, তবু আমাকে আঙ্কেল এরকম করলো কেন মা? আমাকে কতো শক্ত করে ধরলো, আমি খুব ব্যথা পেয়েছি মা। আমাকে ব্যথা দিচ্ছে সেজন্য আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে তোমার কাছে চলে এসেছি। 
আমার চোখ বেয়ে জল ঝরছে। কী শুনছি আমি!! আমার ছোট্ট বাচ্চা, যার পৃথিবী সম্পর্কে এখনও ধারণা জন্মেনি তাকেও হয়রানির শিকার হতে হলো! খবরে পড়েছি এসব ঘটনা, আজ তা নিজের ঘরে! তবে কি নিজের ঘরও নিরাপদ নয়? কী উত্তর দেবো নিজেকে? কী সান্ত্বনা? চারপাশ দুলে উঠছে, অন্ধকার লাগছে সব। মা মেয়ে জড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ এভাবেই।
আমার ছোট্ট পাখি সোনার কিচিরমিচির বন্ধ হয়ে গেছে। সে মা’ র কাছ থেকে নড়ছেই না। ওর বাবা এলো, কিন্তু সে গেলো না। মেয়ের থমথমে মুখ দেখে বাবা ওকে হাসাতে চাইলো, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। ভাই এসে বোনকে নিয়ে খেলতে চাইলো, মেয়ে মা’কে রেখে কোথাও যাবে না। আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। আল্লাহকে হাজার শুকরিয়া আমার মেয়ের কিছু হয়নি। আমি ঐ শয়তানটাকে চিনতে পারলাম, যার মুখে সর্বক্ষণ আল্লাহর নাম। আমাকে সে বুবু বলে ডাকে। সন্ধ্যায় আমার থেকে বিদায় নিয়ে গেলো আর আমার মেয়েকে সে বাই আঙ্কেল বলে গেলো। ঘৃণায় আমার শরীর কেঁপে উঠলো। হয়তো আমার মেয়েরও এরকম হলো। 
আমার মেয়ে পেঁয়াজু খেতে পছন্দ করে, আমি আজ মচমচা করে পেঁয়াজু ভাজলাম। ইফতারিতে সেগুলো তাকে দিলাম।সে ছুঁয়েও দেখলো না। আমি জোর করে খাইয়ে দিলাম। সন্ধ্যায়ই আমার পাখির জ্বর এলো। সে জ্বরে প্রলাপ বকলো, কাঁদলো, কেঁপে কেঁপে উঠলো। শুধু আমি আর আমার মেয়ে জানি ঐদিনের ঘটনা। আর কাউকে বলিনি। বলিনি কারণ জানা জানি হয়ে গেলে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবো না। জানা-জানি হয়ে গেলে মেয়ের বাবা ঐ লোককে পিটাবেন, আইনের হাতে তুলে দেবেন। আর আমার ছোট্ট পাখিটা অনেক আজেবাজে কথা শুনবে। জানাজানি হলে সবাই আমাকে দোষ দেবে। বলবে, মেয়েকে দেখে রাখতে পারিনি।
হ্যাঁ সব দোষ তো আমারই। আমি কেন মেয়ে জন্ম দিলাম? আমি কেন জন্মের পর থেকে তাকে মেয়ে ভাবলাম না? কেন আমার ৮ বছরের মেয়েকে আমি বাচ্চা/ছোট বলে মনে করলাম?  কেন আমি আমার ছোট্ট পাখির সমস্ত শরির ঢেকে রাখলাম না?? এত এত এত প্রশ্ন আমার ছোট্ট মাথায় গিজগিজ করতে লাগলো।
আমি আমার মেয়ের হাত দুটো শক্ত করে ধরে রাখলাম, তাকে সাহস দিলাম, তার সাথে সময় কাটালাম এই দুটো দিন। এই দুটো দিন আমি আমার মেয়েকে আবার গর্ভে নিলাম, তাকে অভয় দিলাম, নাড়ীর বন্ধনে আবার বাঁধলাম। আমার ছোট্ট পাখিটা ধীরে ধীরে আবার কিচির মিচির করা শুরু করলো।
এখন আমি তাকে চিনতে শেখাবো পশু মানুষদের। এখন আমি তাকে পরিচয় করিয়ে দেবো প্রকৃতির ভয়ংকর রূপের সাথে। এখন আমি তাকে আত্মরক্ষার কৌশল শেখাবো। আমার মেয়ে, আমার বাচ্চা পাখি সোনাটা বয়সের আগেই মেয়ে হয়ে গেলো! আমি তাকে মানুষ বানাবো। মেয়ে মানুষ নয়,  মানুষ বানাবো, মানুষ। 
আজ সকালে বন্ধুর জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখা। সব মায়েরা তাদের মেয়েকে রক্ষা করার উপায় শেখান, পাশে থাকুন। বাবারাও পাশে থাকুন। আমাদের সমাজ যে ভয়ংকর দিকে যাচ্ছে তাতে সামনের পথ অন্ধকারাচ্ছন্ন। ভালো মানুষের আড়ালে এরা লুকিয়ে আছে এই আমার আপনার আশেপাশে।
শেয়ার করুন: