দায়িত্ব এবং অধিকার দুটোই সমানভাবে নিতে জানতে হবে

ফারজানা নীলা:

জীবন এক:

সে আর্থিকভাবে স্বাধীন। সে তার এবং তার পরিবারের সকল দায়িত্ব এবং খরচ বহন করতে সক্ষম। তার বাবা নেই , বড় ভাই নেই। বড় ভাই থাকলে বাবার অবর্তমানে সে দায়িত্ব নেওয়ার কথা, সেই দায়িত্বই এই মেয়ে নিয়েছে। কিন্তু তাকে নিয়ে তার মা গর্ব করার সময় বলে, “মেয়ে আমার ছেলের কাজই করছে” মানে সংসারের দায়িত্ব নেওয়া মেয়ের কাজ না, ছেলের কাজ।

জীবন দুই:

সেও আর্থিকভাবে স্বাধীন। ভালো বেতনের চাকরি করে। বিয়ের পর স্বামীর সাথে সুখের সংসার। নিজের উপার্জিত টাকা প্রায় পুরোটাই জমা করে হাত খরচের টাকা স্বামী থেকে নিয়ে বলে, “এটা আমার অধিকার, আমি যতই উপার্জন করি না কেন, স্বামীর টাকা খরচ করা আমার অধিকার”

তাকে যদি প্রশ্ন করা হয় স্ত্রীর টাকা খরচ করার অধিকার কি স্বামীর নেই? সে উত্তর দেয়, “মেয়েদের কিছু না কিছু আয় করতে হয় নিজের জন্য রাখার জন্য। স্বামী নিজের এবং স্ত্রী দুজনের জন্যই আয় করবে, এটাই হওয়া উচিত”।

দ্বিতীয় জীবন নিয়ে অনেকেই বলবে, “এই দেখো তোমাদের নারীবাদ, নারীরা অধিকার চায় দায়িত্ব নিতে চায় না”।

নারীবাদকে আক্রমণ করার জন্য উপরের লাইনটি খুবই প্রচলিত। এবং আমি অস্বীকারও করতে পারবো না এমন নারীর সংখ্যা কম নয় যারা তাদের পাই পাই উসুল করতে খুব সচেষ্ট, কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার বেলায় পিছপা হয়। আশেপাশে এমন অনেক শিক্ষিত স্বাবলম্বী নারী আছে যাদের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নিজের উপার্জিত অর্থ সংসারে বা পরিবারে ছেলেদের সমানুপাতিক খরচ করতে চায় না।

কেন চায় না? এর দু ধরনের উত্তর পাওয়া যায়। দুটোই পুরুষতান্ত্রিক।

এক- এসব মেয়েরা মনে করে ছেলেদের সমান খরচ করলে ছেলেদের মধ্যে দায়িত্ব নেওয়ার বোধ কমে যাবে, অর্থাৎ মেয়েদের অর্থ খরচ হবে বেশি। ভবিষ্যতের জন্য জমা তাতে কম হবে। এই ধারণা পুরুষতান্ত্রিক কেন? এই জন্য পুরুষতান্ত্রিক কারণ এখানে মেয়েদের মাথায় ধারণা ঢুকানো হয়েছে যে মেয়েরা ছেলেদের সমান দায়িত্ব নিতে অক্ষম। বা নেওয়া উচিত না তাতে ছেলেদের ইগো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সমান দায়িত্ব নিলে সমান মতামতও দিবে। সিদ্ধান্তও নিবে। যেটা পুরুষদের হজম করতে সমস্যা হয়।সমান দায়িত্ব নেওয়া পরিবারে নারীদের নিজেদের মতামত দিতে আর সিদ্ধান্ত নিতেও পুরুষের সম্মতি নেওয়ার প্রয়োজন হয় । দায়িত্বের সাথে অধিকার কিন্তু সমান্তরাল ভাবে আসে না।

এখন অনেক পুরুষরা তেড়ে আসবেন এই বলে “আমরা মোটেও এমন না, মেয়েরাই দায়িত্ব নিতে চায় না”। যদি ১০০ জনের মধ্যে ৫ জন এমন না হন তাহলে দুঃখিত, আপনারা উদাহরণ হতে পারছেন না এখনো। সুতরাং কথাটা আপনারা গায়ে নিবেন না।

তবে সমান দায়িত্ব নিলে ছেলেরা কী করবে কী করবে না সেটার উপর ভিত্তি করে মেয়েদের দায়িত্ব না নেওয়ার ব্যাপারটা মোটেও সমর্থনযোগ্য না। অধিকার আদায়ের বেলায় যদি তীব্র চেষ্টা থাকে তবে দেওয়ার বেলায়ও প্রবল আগ্রহ থাকতে হবে। কারণ অধিকার যদি ন্যায্য হয় তবে দায়িত্ব পালন হচ্ছে যোগ্যতার প্রমাণ। দায়িত্ব পালন, দায়িত্ব নেওয়া বলতে বুঝায় নিজের সক্ষমতা, নিজের অর্জন, নিজের গৌরব।

এবার আসি প্রথম ঘটনায়। সেখানে মেয়েটি যে দায়িত্ব পালন করছে, সেটির জন্য তাকে মেয়ে হিসেবে বাহবা দেওয়ার চেয়ে “ছেলের কাজ” করছে বলে প্রশংসা করছে। কেন ছেলের সাথে তুলনা করেই প্রশংসা করতে হবে? ছেলেরাই দায়িত্ব নেয় তাই? বাবা মা পরিবারর দায়িত্ব নেওয়া ছেলেদের কাজ মেয়েদের না?

বংশের বাতি ছেলেরা হয়? বুড়ো বয়সে হাল ধরে ছেলেরা? মেয়েরা পরের ঘরে চলে যায় তাই?

কে বানিয়েছে এই নিয়ম যে দায়িত্ব নিবে ছেলেরা? পুরুষতান্ত্রিক সমাজই তো বানিয়েছে। এই নিয়ম বানিয়ে আবার “মেয়েরা দায়িত্ব নিতে পারেনা বা চায় না” বলার অধিকার কে দিলো?

“দায়িত্ব নিতে হয়” এই বোধ পরিবার ছেলেদের মাথায় ঢুকায় বা এভাবেই তাদের বড় করা হয়। বা সে দেখে আসছে পরিবারের দায়িত্ব বাবা নিচ্ছে। সিদ্ধান্ত বাবা নিচ্ছে। মা তার চাকরিজীবী হলেও কর্তা কিন্তু বাবাই। এই কর্তার দায়িত্ব ভবিষ্যতে সেও নিবে, তার বোন নয়।

এখানে শেখানো হয় না তুমি ছেলে হও বা মেয়ে, সংসারের দায়িত্ব ,বাবা মার দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে। একা এই দায়িত্ব শুধু ছেলেদের না। সমানভাবে মেয়েদের। ঠিক যেমনভাবে সমান পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অধিকার ছেলেমেয়ে দুজনেরই সমান।

এই শিক্ষা না দিয়ে শেখাই আমরা; মেয়ে স্বাবলম্বী হলে ভালো, দায়িত্ব নিলেও ভালো। তবে ছেলেকেই সবকিছুর দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ এটা ছেলেরই কাজ। এই কাজ ছেলের অবর্তমানে মেয়ে নিলে তাকে আমরা ছেলের সাথে তুলনা করি। তাদের নিয়ে আমরা মেয়ে হিসেবে গর্ব করি না। অথচ দায়িত্ব নেওয়া সন্তানের কাজ, দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তাকে ছোটবেলা থেকে সেভাবেই গড়ে তোলা বাবা মায়ের কর্তব্য। ছেলের কাজ এক মেয়ের কাজ আরেক বলে শিক্ষা দেওয়া অশিক্ষার সামিল।

এই অশিক্ষার ফল উপরোক্ত দ্বিতীয় জীবনের ঘটনা।

“মেয়েরা খালি অধিকার খুঁজে, দায়িত্ব নেয় না” তাচ্ছিল্য করে বলার আগে একটা প্রশ্নের জবাব দিবেন, অধিকার খুঁজে মানে কী? কারো জন্মগত অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে তাকে সেটা দান করার আপনারা কারা?

মেয়েরা অধিকার খুঁজে না,অধিকার দাবি করে কারণ এটা তাদের জন্মগত পাওয়া। যেটা এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিজের বাপদাদার সম্পত্তি মনে করে সিন্দুকে পুরে রেখেছে।

একজন পুরুষ হিসেবে আপনি পড়ালেখা, কর্মসংস্থানে, পরিবারে, সমাজে যা যা সুবিধা ভোগ করেন ঠিক সেই সেই সুবিধা ভোগ করার অধিকার একজন নারীরও আছে। আপনি দেওয়া বা না দেওয়ার কেউ না হয়েও তাকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন। করে আসছেন যুগ যুগ ধরে। তাকে ঘরে আটকে রাখতে চেয়েছেন তৃতীয় ক্যাটাগরি নাগরিকের মত। তার মাথায় মননে মগজে বিকাশ ঘটিয়েছেন, আমি নারী, আমি দুর্বল, আমার দায়িত্ব কেউ নিবে, আমি কারো দায়িত্ব নেবো কীভাবে?”

মননে বিকালঙ্গ করে রেখে তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করার দুঃসাহস পুরুষ বই আর কারো হওয়ার কথা না। তাই নারীবাদ যখন মেয়েদের অধিকার এবং দায়িত্ব দুটো নিয়েই কথা বলে, তখন পুরুষরা যুক্তি বাদ দিয়ে ব্যঙ্গতা নিয়ে হাজির হয়।

মনে রাখা উচিত, মেয়েদের অধিকার পুরুষরা এই সমাজে জব্দ করে রেখেছে বলে অধিকার অর্জনের প্রশ্ন আসে। অন্যের জন্মগত অধিকার নিজেরা অন্যায়ভাবে হরণ করে “অধিকার চাইছে” বলতেও লজ্জা লাগা উচিত।

“আমরা কর্তা, আমরা ডিসিশন মেকার, আমরা দায়িত্ববান” বলে নিজেদের এতটা উপরে না তুলে যদি সমানভাবে দায়িত্ব এবং অধিকারের শিক্ষাটা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতx বাল্যকাল থেকেই, তবে প্রতিটা ঘরেই এমন মেয়ে থাকতx যে দায়িত্ব পালন এবং দায়িত্ব গ্রহণকে সবার আগে গুরুত্ব দেয়।

শেয়ার করুন: