জীবনের ভাঁজে যখন অন্য জীবন

আয়েশা অনু:

জরুরি প্রয়োজন। জানি তুমি হাত লাগালেই কাজটা হয়ে যাবে, ফোন দিলাম। জানালে বৈশাখী চ্যানেলে তুমি। বুঝলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই আবারও ভাইরাল হতে যাচ্ছো। ফোন রেখে দিলাম।

তোমার সংবাদটা নিউজ আকারে সামনে দেখে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। দেশের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার খবর পাঠক তাসনুভা আনান।

তাসনুভা আনান

চকচকে মেকআপে নিউজ প্রেজেন্টারের সাজে তোমাকে দেখে কতকিছু মনে পড়ে গেল! ২০১৯ সাল, ঈদের ক’দিন আগে আমাকে ফোন করে বললে অনু, ঈদ কোথায় করবে? রাজশাহী যাবে? তোমার কণ্ঠ শুনেই বুঝলাম তুমি কী চাচ্ছো! বুঝলাম তোমার ঈদে বাড়ি যাওয়া বলতে কিছু নেই। তুমি হয়তো চাচ্ছো ঈদে একটা বাড়িতে যেতে, একটা পরিবারের সাথে ঈদ করতে। বুঝলাম, তোমার স্বপ্নও বাড়ি যেতে চায়।
সাহস করে তোমাকে সাথে নিয়ে রাজশাহী চলে আসলাম। ভয়ঙ্কর টেনশনের ছিল সেবারের ঈদে বাড়িতে থাকা আমার দিনগুলো। টেনশনের কারণ আমি বাসায় মিথ্যা বলেছিলাম। বলেছিলাম তুমি মেয়ে, আমার বান্ধবী, রাজশাহীর ঈদ দেখাতে তোমাকে জোর করে সাথে এনেছি। তোমাকে আমার পোশাক পরালাম, যে পোশাকে বেশি মেয়ে মেয়ে লাগে। সারাক্ষণ ঘরের দরজা বন্ধ রাখতাম, পর্দা টেনে রাখতাম। তুমি ঘরের বাইরে গেলেই গলায় ওড়না চাপিয়ে দিতাম। ওড়না খুলতে চাইলেই ধমক দিতাম। তোমার কাপড়-চোপড় সাবধানে লুকিয়ে রাখতাম। যেন কোনোভাবেই বাসায় কেউ টের না পায় যে তুমি ট্রান্সজেন্ডার। রাতে ঘুমের মধ্যে আতঙ্কে উঠে বসে পাশে ঘুমিয়ে থাকা তোমার কাপড় ঠিক করে দিতাম, জানালার পর্দা টেনে দিতাম। যে সম্মানে তোমাকে বাসায় এনেছি, চাচ্ছিলাম সে সম্মান নিয়েই যেন তুমি যেতে পারো। চাচ্ছিলাম আমার বাবা-মা যেন কষ্ট না পায়, যেন কোনোভাবেই না ভাবে যে আমাকে বিশ্বাস করে তারা ভুল করেছে। আমি কোনোদিন কাউকে দুঃখ দিতে চাইনি।

ঈদের আগে বাসার সবার জন্য শপিং করলে তুমি। ঈদের সকালে গোসল করে সবাইকে সালাম করে শাড়ি পরে আমার ড্রেসিং টেবিল তছনছ করে মেকআপ করতে বসলে। আমি একফাঁকে দেখি মেকআপের ওপর দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে তোমার গাল বেয়ে। পানি মুছে আবার পাউডার লাগাচ্ছো, আবারও গড়িয়ে নামছে পানি। পাউডারে কি আর চোখের পানি ঢাকা যায়! আমি ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। হয়ত সাজতে সাজতে বাড়ির কথা মনে পড়েছিল তোমার, মায়ের হাতে তৈরি ঘন দুধে এলাচ দেয়া সেমাইয়ের কথা মনে পড়েছিল তোমার, হয়তো সবুজ আঁচলে ঘোমটা দেয়া মায়ের মুখ মনে পড়েছিল, জানি না। বিশ্বাস করো, সেই মর্মান্তিক দৃশ্য ভুলতে আমার অনেকদিন লেগেছে। নিজের অসহায়ত্ব, বন্ধুর জন্য কিছু করতে না পারার অক্ষমতা মেনে নিতে অনেক সময় লেগেছে আমার। আজ ক্যামেরার সামনে তোমার মেকআপ করা মুখ দেখে আমার চোখ ভিজে গেল। মনে হলো, তোমার মা কি খবর দেখেন? মনে হলো, আমার বাবা-মা তোমাকে টিভিতে দেখে আমাকে প্রশ্ন করলে এখন কি সত্যটা বলতে পারবো? সম্ভবত পারবো।

নিউজটা দেখে মনে পড়ল, একবার এক বন্ধুর গাড়ি আমাকে পিক করতে এসেছিল গুলশানে। সাথে তুমি ছিলে, তোমাকে নিয়েই উঠলাম গাড়িতে। তোমাকে দেখে বন্ধুর মুখ ভারী হয়ে গেল, কথা বন্ধ হয়ে গেল। মোহাম্মদপুরে নেমে তুমি ফ্রেশরুমে গেলে, আর অনেক্ষণ ধরে দরজা লাগিয়ে রাখলে, বের হলে না। আমি বুঝলাম বের হলেই দেখবো তোমার চোখ ফোলা। তবু দরজায় টোকা দিইনি। জানি, কাঁদলে কষ্ট কমে। সবাই কাঁদতে পারে না, তুমি পারো। তোমাকে সেই অপমান আসলে আমিই করেছিলাম। আজকের নিউজ দেখে ভাবলাম, বন্ধুটি কি নিউজটা দেখেছে?
দেখেছে।
সে কিছুক্ষণ পরেই ফোন করে জানালো।

আমার গ্রিনরোডের সেই প্রগতিশীল বাড়িওয়ালি পর্যন্ত আমাকে বাড়ি ছাড়ার আলটিমেটাম দিয়েছিল। অপরাধ, আমার বাসায় ট্রান্সজেন্ডার আসে, তুমি আসো। তোমাকে বলতে পারিনি, আর এসো না। বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেই ভদ্রমহিলা কি নিউজটা দেখেছেন? জানি না।

তাসনুভা, তুমি জিতে গেছো আজ। তুমি শোককে শক্তিতে পরিণত করতে পেরেছো। তুমি ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছো। সমস্ত অপমানের জবাব দিতে পেরেছো আজ। আমি পারিনি কোনোদিন। তুমি প্রমাণ করেছো, সবার স্বপ্ন ভাঙে না। প্রমাণ করে দিয়েছো, সব স্বপ্নই জোড়া দেয়া যায়। অথচ আমি তোমার মতো হতে চেয়েছিলাম, তোমার মতো শক্তিশালী, অটল! পারিনি তাসনুভা। আমি একজন দুর্বল মানুষ। আমার জীবনের অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনার সাক্ষী তুমি। সামনে অনেক যুদ্ধ, তুমি আমার সবচেয়ে বড় সৈনিক, আজ সাহস পাচ্ছি। কী অদ্ভুত!

তোমাকে নিয়ে আর একটা স্বপ্ন বাকি। তোমার বিয়েতে আমি ডুলিবিবি হয়ে যেতে চাই। বরপক্ষ নতুন শাড়ি দেয় তাতে। তোমার বরকে বলো, আমাকে একটা বেগুনি জামদানী যেন কিনে দেয়। বেগুনি জামদানী পরে তোমার সাথে তোলা ছবিই যেন হয় শাড়ি পরা আমার শেষ ছবি। কী আশ্চর্য দেখো! সবই আনন্দের কথা, আশার কথা, তবুও চোখ ভিজে যাচ্ছে বারবার। কে যেন বলেছিল, সবচেয়ে আনন্দের দিনগুলোই আসলে আমাদের সবচেয়ে বেদনার দিন।

আর একটা কথা। ফেসবুকে মেমোরিয়ালাইজেশন সেটিং বলে একটা ব্যাপার আছে। আমার মেমোরিয়ালাইজেশনে তোমার নাম দেয়া আছে। মৃত্যুর পর আমার ফেসবুকের মালিকানা তোমার কাছে চলে যাবে। বলা হয়নি কখনও। যদি তোমার আগে আমি মারা যাই, দুটো লাইন লিখে দিও। লিখ, তোমার বন্ধু অনু তোমার মতোই সাহসী ছিল, যোদ্ধা ছিল। বন্ধুর জন্য দু’লাইন মিথ্যা নিশ্চয় লেখাই যায়, তাই না?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.