মাদ্রাসাগুলোতে হস্তক্ষেপের এখনই উপযুক্ত সময়

আলী আদনান:

ঘটনা- ১

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের এক ছাত্রীকে ‘ধর্ম মেয়ে’ বানিয়ে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছে মাদ্রাসা শিক্ষক! পরে ঘটনা জানাজানি হলে নড়েচড়ে বসে আইন-শৃংখলা বাহিনী। কিন্তু তার আগেই স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপে পড়ে ঐ মেয়ে ও তার পরিবারকে এলাকা ছাড়তে হয়েছে। দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার সূত্র অনুযায়ী মঙ্গলবার মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে তার ঘরে তালা ঝুলছে।

আপনাদের কি ফেনীর নুসরাত ও মাদ্রাসা অধ্যক্ষ লম্পট সিরাজউদ্দৌলা’র কথা মনে আছে? দেশবাসী হয়তো এরকম আরেকজন সিরাজউদ্দৌলার সাথে পরিচিত হতে যাচ্ছেন। আসুন, ঘটনার ভেতরে যাওয়া যাক।

এখানেও ঘটনার খলনায়ক আরেকজন মাদ্রাসা প্রধান। তার নাম আবুল মনসুর। বয়স পঞ্চান্ন। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে আবুল মনসুর সাধারণ মানুষদের কাছে ‘হুজুর’ বলেই পরিচিত। আবুল মনসুর একই জেলার গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের কান্দুলিয়া গ্রামের বছির উদ্দিনের ছেলে। বছর দশেক আগে আবুল মনসুর উচাখিলা বাজারে জমি ক্রয় করে একটি বাসাবাড়ি করেন এবং বাসার সামনেই গড়ে তোলেন মাদ্রাসা। এখানে কোরআন শিক্ষার পাশাপাশি বেশ কয়েকজন শিক্ষক রেখে শুরু করেন কোচিং ব্যবসা। স্থানীয় শতাধিক শিক্ষার্থী এই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে৷ ধর্মকে পুঁজি করে তরতর করে এগিয়ে যাওয়া আবুল মনসুর এলাকাতে দুটি বিয়ে করেন।

এরই মধ্যে পাশের গ্রামের এক কিশোরীকে ‘ধর্ম মেয়ে’ বানিয়ে ঐ বাড়িতে নিয়মিত আশা যাওয়া শুরু করেন। মেয়েটি একবারেই হতদরিদ্র পরিবারের হওয়ায় তাদের মন জয় করা সহজ হয়। নিজ খরচে মেয়েটির পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়ে মেয়েটির বাবা-মাকে বুঝিয়ে মেয়েটিকে নিজ মাদ্রাসায় নিয়ে আসেন। কিন্তু তথাকথিত এই মাওলানার ছদ্মবেশ বুঝতে কিশোরী মেয়েটির বেশি সময় লাগে না। সে ফিরে যায় নিজ বাড়িতে। মেয়েটির মায়ের ভাষ্য অনুযায়ী, তার মেয়ে মাদ্রাসায় যাবেনা বলে মন খারাপ করে থাকে। আর কিছুই বলে না।

এই অবস্থায় হুজুর একদিন এসে হাদিসের নানা ব্যাখ্যা দিয়ে মেয়েটিকে আবার নিয়ে যায়। মাসখানেক পর মেয়ে আবার বাড়িতে ফিরে আসে৷ এসে তার মাকে জানায়, হুজুর তার সাথে স্বামী স্ত্রীর মতো আচরণ করছে। এরপর শুরু হয় হৈচৈ। ঘটনাটি জানানো হয় স্থানীয় চেয়ারম্যান মোতাব্বিরুল ইসলামকে। চেয়ারম্যানের সামনে ঐ কথিত ভণ্ড মাওলানার উপস্থিতিতে মেয়েটি তাকে দিনের পর দিন ধর্ষণের লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়। মেয়েটির পরিবার এ সময় চেয়ারম্যানকে একটি সাদা স্ট্যাম্প দেখায় যেখানে যেখানে ঐ ভণ্ড মাওলানার ও মেয়েটির স্বাক্ষর রয়েছে, চেয়ারম্যান পরিবারটিকে থানায় আশ্রয় নিতে পরামর্শ দেয়।

কিন্তু থানায় আশ্রয় নেওয়ার আগেই মেয়ে ও তার পরিবারকে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে এমন অভিযোগ উঠেছে। দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অভিযুক্তের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে পরিবারটিকে গ্রাম ছাড়া করেছে এলাকার প্রভাবশালীরা। লাপাত্তা হয়েছে সেই ভণ্ড মাওলানাও। মেয়েটির ঘরে তালা ঝুলতে দেখা গেছে।

ঘটনা- ২

বগুড়ার ধুনট উপজেলায় দাদা-দাদীর সাথে ওয়াজ মাহফিল শুনতে যাওয়া আট বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। শিশুটির বাবা-মা দু’জনেই ঢাকায় পোশাক শ্রমিক হিসেবে কর্মরত৷ শিশুটি তার দাদা দাদীর সাথে রাতে ওয়াজ শুনতে গিয়েছিল। এক সময় শিশুটি প্যান্ডেলের বাইরে চিপস কিনতে যায়। আর ফিরে আসেনি। মঙ্গলবার সকালে বাঁশঝাড়ের পাশে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। তাতে ধর্ষণের আলামত মিলেছে।

ফেনীর সিরাজউদ্দৌলা বা ময়মনসিংহের আবুল মনসুর- এরকম একজন দু’জন নয়। মাদ্রাসাগুলোতে ধর্ষণ – বলাৎকার এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। শুধুমাত্র ২০২০ সালেই মাদ্রাসায় শিক্ষকের দ্বারা বলাৎকার ও ধর্ষণ নিয়ে কয়েকশ সংবাদ আমরা পড়েছি। এরমধ্যে বেশকিছু সিরিয়াল ধর্ষক আমরা পেয়েছি যারা নানা লোভ ও ভয়ভীতি দেখিয়ে একের পর এক ধর্ষণ করে গেছে। যারা এর শিকার হয়েছে বেশিরভাগই নিরীহ ও হতদরিদ্র পরিবারের শিশু।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ধর্মভীরু। এদের মধ্যে বড় একটা অংশ ধর্ম মানে ধর্মকে না পড়ে ও না বুঝে। সিরাজউদ্দৌলা বা আবুল মনসুরের মত তথাকথিত এরকম মাওলানা দেশের প্রায় প্রতিটা গ্রামেই আছে। যাদের আয়ের অন্যতম উৎস এতিমখানা ও ছোট বড় মাদ্রাসা। মসজিদকে কেন্দ্র করে, মাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এসব মাদ্রাসা তাদের আয়ের নিরিবিলি উৎস। পুঁজি একটাই, তাহলো সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা ও অন্ধত্ব।

এখানে একটা বিষয় আমরা নিশ্চয় খেয়াল করেছি। ময়মনসিংহের মেয়েটি যাকে তথাকথিত মাওলানা ‘ধর্ম মেয়ে’ বানিয়ে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছে- এই মেয়েটির বাবা মায়ের মন জয় করার জন্য এই লম্পট আশ্রয় নিয়েছে ধর্মের। নানা ধরনের ভুলভাল কথা বলে, মনগড়া হাদিস শুনিয়ে তাদের বিশ্বাস স্থাপন করেছে। এরপর তার দুটি স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও এক কিশোরী মেয়ের উপর দিনের পর দিন চালিয়েছে পাশবিক নির্যাতন।

তবে এই কিশোরী মেয়েটি একদিকে ভাগ্যবান। কারণ মেয়েটির অভিযোগ মেয়েটির পরিবার বিশ্বাস করেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবার সমাজ মেয়ের উপরেই দোষ চাপায়।

এদেশে গ্রামে অল্প শিক্ষিত অনেক নারী-পুরুষ আছেন যারা এমন মাওলানাদের নিজের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করে। যে মাওলানার পদপদবী যতো ভারী সে মাওলানার প্রভাব প্রতিপত্তি ততো বেশি শুধুমাত্র মসজিদের ইমাম হলে সিরাজউদ্দৌলা বা আবুল মনসুরদের দাপট এতো বেশি হয় না। কিন্তু একটি মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা বা প্রধানের দায়িত্ব পালন করার কৃতিত্ব যখন এদের সিভিতে যোগ হয় তখন সে ঐলাকার নীতিনির্ধারকদের তালিকায় এসে যায়। সকলের অগোচরেই তিনি হয়ে উঠেন ঐ এলাকার রাজনীতিতে ফ্যাক্টর, সামাজিক জীবনে ফ্যাক্টর।

আমরা ফেনীর ঘটনায় খেয়াল করেছি, স্থানীয় রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সিরাজউদ্দৌলার পক্ষ নিয়েছিল। সেখানে তার পক্ষে মানববন্ধন ও মিছিল হয়েছিল। তার সমর্থকরাই নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ একই ঘটনার পুনরাবৃতি আমরা এখন দেখছি ময়মনসিংহের ঘটনায়। এখানেও স্থানীয় প্রভাবশালীরা লম্পট আবুল মনসুরের পক্ষ নিচ্ছে। তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঐ মেয়েটি ও তার পরিবারকে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। আবুল মনসুর বা সিরাজউদ্দৌলাদের খুঁটি এখানে ‘মাদ্রাসা’। এই মাদ্রাসা শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। এই মাদ্রাসা এখানে একটা রাজনীতি, এই মাদ্রাসা এখানে একটা শক্তিশালী সাইনবোর্ড, এই মাদ্রাসা এখানে ভোট, এই মাদ্রাসার আড়ালে লুকিয়ে রাখা যায় হাজারো অপকর্ম।

এখানে একটা বিষয় স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগছে। আবুল মনসুর দুটি বিয়ে করেছেন। যেহেতু মেয়েটিকে আবুল মনসুর নিজের গৃহে এনে দিনের পর দিন ধর্ষন করেছে সেহেতু কোনভাবেই বিষয়টি তার স্ত্রীদের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। কেন তার স্ত্রীরা এমন অপকর্মে বাধা দেননি? কেন তারা মুখ বুজে সহ্য করেছেন? এর থেকে কী প্রমাণ হয়? এর থেকে প্রমাণ হয় কয়েকটি বিষয়। এক. তার স্ত্রীরা মন থেকে বিশ্বাস করে পুরুষ মানুষ একটু আধটু এমনটি করতেই পারে। মাওলানা সাহেব ও পুরুষ মানুষ। দুই. আল্লাহর আলেমরা যা করে তা সঠিক। মাওলানা সাহেব যা করছেন তা মেয়েটির ভালর জন্য করছেন। বাধা দেওয়া ঠিক হবে না৷ তিন. হতে পারে তার স্ত্রীরা এতোটা অসহায় যেখানে তারা কোন প্রকার প্রতিবাদ বা নাক গলানোর ক্ষমতা রাখেন না।

আমার প্রশ্ন হলো আবুল মনসুরের অপকর্ম এটাই যে প্রথম তা আমরা কীভাবে বিশ্বাস করব? এই মেয়েটি মুখ খুলেছে বলেই আমরা জানলাম৷ কুকুরের যে লেজটি আজকে বাঁকা তা আগেও বাঁকা ছিল। আগেও যে সে অনেক মেয়েকে একই ফাঁদে ফেলেনি তা কীভাবে বিশ্বাস করি? আগে যারা আবুল মনসুরের ফাঁদে পড়েছে তারা নানা ভয় ভীতিতে চুপ করে গেছে- এমনটাই কী প্রমাণিত হয়না?

চোর, ডাকাত, গুন্ডা, বদমাশ, লুইচ্চা সবাই নিজ নিজ অপকর্ম ঢাকা দেওয়ার জন্য মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করবে বা মাদ্রাসা সাইনবোর্ড ব্যবহার করবে- এটা আমরা আর কতোকাল মেনে নেব। মাদ্রাসা অপকর্মের আখড়া হওয়া মানে আমাদের ছোট্ট শিশুদের জীবনটাকে নারকীয় যন্ত্রনার দিকে ঠেলে দেওয়া। একজন অভিভাবকের কোমল মন কীভাবে নিচ্ছে এমন ঘটনাগুলো?

রাজনীতিবিদরা এসব ঘটনায় মাদ্রাসার দোষ দেখবেন না। কারণ, মাদ্রাসায় রাজনীতি আছে। জনপ্রতিনিধিরা মাথা ঘামাবেন না। কারণ, এখানে ভোট আছে। ধর্মভীরু গোঁয়াররা প্রতিবাদ করবে না। কারণ, তারা এসব ভন্ড মাওলানাদের আড়ালে বেহেশত দেখে। পুরুষতন্ত্র চুপ থাকবে। কারণ, তারা বিশ্বাস করে পুরুষ মানুষ একটু আধটু এরকম করতেই পারে। বরং তারা এমন ঘটনায় আবুল মনসুরকে মহৎ করার চেষ্টা করবে। আবুল মনসুর মেয়েটির পড়াশোনার খরচ দিচ্ছে সেই যুক্তিতে। কিন্তু সুন্দর একটি প্রজন্মকে নিজের মনের খায়েস মিটাতে গিয়ে পিষ্ট করে মারা হচ্ছে- লেখক, সংবাদকর্মী, প্রগতিশীল সাহিত্যকর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী, আন্দোলনকর্মী হিসেবে আমরা এমন অন্যায় মেনে নিতে পারিনা। তাদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য আমাদের আন্দোলন চলছে, চলবে।
সরকার কচুরিপানার মত যত্রতত্র গজিয়ে উঠা এসব মাদ্রাসাগুলোতে নজরদারী বাড়াবে, নির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা ও কাঠামোর আওতায় আনবে আমরা সেটাই চাই। আর কোন মেয়েকে যেন নুসরাতের পরিণতি গ্রহণ করতে না হয়।

(লেখক: আলী আদনান, লেখক, সাংবাদিক।
মেইল- [email protected])

শেয়ার করুন: