স্তন ক্যান্সার: লক্ষণ এবং রোগ নির্ণয়

মনিকা বেগ:

স্তন ক্যান্সার হলে বেশ কয়েকটি লক্ষণ থাকতে পারে। কোন রোগীর লক্ষণ কী হবে, সেটি নির্ভর করে তার স্তন ক্যান্সারের ধরন, কতদিন ধরে তার স্তন ক্যান্সার আছে, ইত্যাদির উপরে।

আবার কারও কারও কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে।

চলুন তবে আমরা জেনে নেই, স্তন ক্যান্সার হলে সাধারণত কী কী লক্ষণ থাকতে পারে:

১) স্তনের ভেতরে, বগলের নিচে অথবা গলার হাড়ের (Collarbone) উপরে বা নিচে ছোট গোটা বা চাকার (Lump/Tumor) মতো অনুভূত হতে পারে।

২) হঠাৎ করেই স্তনের চেহারায় এবং আকার ও আয়তনে পরিবর্তন আসতে পারে।

৩) স্তনের চামড়ায় টোল পড়ার মতো হতে পারে।

৪) স্তনের চামড়া রুক্ষ এবং মাছের আঁশের মতো হয়ে উঠে আসতে পারে।

৫) স্তনের চামড়া লাল হয়ে যেতে পারে অথবা চামড়াতে কমলালেবুর খোসার মতো সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম গর্ত দেখা দিতে পারে।

৬) স্তনের বোঁটা ভেতরের দিকে ঢুকে যেতে পারে।

৭) স্তনের বোঁটা থেকে রক্ত বা অন্য কোনো তরল পদার্থ (বুকের দুধ বাদে) বের হতে পারে।

৮) স্তনের যে কোনো অংশে ব্যথা হতে পারে।

উপরের এই লক্ষণগুলোর একটি থাকলেও সাথে সাথে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

তবে মনে রাখবেন, এই লক্ষণগুলোর কোনো একটি থাকা মানেই যে আপনার স্তন ক্যান্সার হয়েছে, তা কিন্তু নয়।

স্তন ক্যান্সার ছাড়া, অন্য অনেক কারণেও এই লক্ষণগুলো হতে পারে।


স্তন ক্যান্সার: রোগ নির্ণয়

একজন রোগী যখন পূর্বে উল্লিখিত কোনো লক্ষণ নিয়ে ডাক্তারের কাছে যান, তখন সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য, ডাক্তার বেশ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন। যেমন:

১) স্তনের ক্লিনিক্যাল (Clinical) পরীক্ষা: ডাক্তার নিজে তার হাত দিয়ে দুই স্তনে, বগলের নিচে এবং গলার হাড়ের (Collarbone) উপরে এবং নীচে পরীক্ষা করে দেখবেন, কোথাও কোনো গোটা বা চাকা (Lump/Tumor) আছে কিনা।

২) ম্যামোগ্রাফি (Mammography): এটি একটি বিশেষ এক্সরে (X-ray) যা দিয়ে স্তনে কোন গোটা বা চাকা থাকলে, সেটির ধরন সম্বন্ধে একটি প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। আবার যাদের কোনো লক্ষণ-উপসর্গ নেই, তাদের জন্য ম্যামোগ্রাফি একটি ‘স্ক্রিনিং টেস্ট’ (Screening test) হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

৩) আলট্রাসনোগ্রাফি (Ultrasonography): এই পদ্ধতিতে স্তনের গভীরে এক ধরনের শব্দ তরঙ্গ পাঠিয়ে নির্ণয় করা যায় যে, স্তনের ভিতরে অবস্থিত গোটা বা চাকাটি শক্ত (solid), নাকি তরল পদার্থে পূর্ণ (Cyst)।

স্তনের সিস্ট (Cyst) সাধারণত নির্দোষ (Benign) হয়, এবং এর কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। অনেক সময় মাসিকের হরমোন চক্রের সাথে মিলিয়ে, সিস্টের আবির্ভাব হতে পারে, আবার নিজে নিজেই সেটি মিলিয়েও যেতে পারে।

৪) এম আর আই (MRI): এই পদ্ধতিতে চৌম্বক ক্ষেত্র এবং রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে চুল-চেরা বিশ্লেষণ করে, স্তনের ভিতরের অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার একটি চিত্র পাওয়া যায়। সিটি স্ক্যান (CT scan) এবং ম্যামোগ্রাফির চেয়ে এমআরআই নিরাপদ, যেহেতু এটি কোনো রেডিয়েশন (Radiation) ব্যবহার করে না।

এছাড়াও এম আর আই এর আরও কয়েকটি ইতিবাচক দিক রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – এমআরআই এর মাধ্যমে অনেক ছোট টিউমারও শনাক্ত করা সম্ভব, যেটি হয়তো ম্যামোগ্রাফি এবং আলট্রাসনোগ্রাফিতে অনেক সময় সম্ভব হয় না; স্তন ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার পরে, এমআরআই এর মাধ্যমে টিউমারের সঠিক আকার এবং পজিশন (position) নির্ণয় করা যায়; এমনকি কেমোথেরাপি (Chemotherapy) চলার সময়ে কেমোথেরাপি কাজ করছে কিনা, অর্থাৎ টিউমারের আকার ছোট হয়ে আসছে কিনা, সেটি বুঝতেও এমআরআই ব্যবহার করা হয়।

৫) বায়োপসি (Biopsy): এটিই এক মাত্র পন্থা, যেটি নিশ্চিত করতে পারে স্তনের ভেতরে অবস্থিত গোটা বা চাকাটি ক্যান্সার, নাকি ক্যান্সার নয়। বায়োপসি করার জন্য স্তনের সেই সন্দেহজনক জায়গাটি থেকে টিস্যু (tissue) সংগ্রহ করতে হয়।

আলট্রাসনোগ্রাফি বা এক্সরের সাহায্যে দেখে স্তনের চামড়াতে অল্প একটু – প্রায় ১/৪ ইঞ্চি – কাটা হয়। তার ভিতর দিয়ে একটি বিশেষ ধরনের সুঁই (core needle) ঢুকিয়ে, এই টিস্যু স্যাম্পল (sample) গুলো সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত ৫ টি স্যাম্পল নেয়া হয়।

টিস্যু স্যাম্পল নেয়া শেষ হলে রোগীর অনুমতি সাপেক্ষে স্তনের ভেতরে যেখান থেকে স্যাম্পল নেয়া হয়েছে, ঠিক সেই জায়গাটিতে একটি ক্ষুদ্র ধাতব মার্কার (metal marker/clip) বসিয়ে দেয়া হয়। কেন? যাতে পরবর্তিতে অন্য কোনো ইমেজিং টেস্ট (imaging test) বা স্তন অপারেশন করার সময় সন্দেহজনক বা ক্যান্সার আক্রান্ত জায়গাটিকে সহজেই শনাক্ত করা যায়।

এর পরে সংগৃহিত টিস্যু স্যাম্পলগুলোকে পরীক্ষা করার জন্য হিস্টো-প্যাথলজি (Histopathology) ল্যাবরেটরিতে পাঠানো। সেখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন: স্যাম্পলগুলোতে আদৌ কোনো ক্যান্সার কোষ (cell) আছে কিনা? থাকলে ক্যান্সার কোষগুলো কী ধরনের? ক্যান্সার কোষগুলো কতখানি আক্রমণাত্মক (aggressive)? ক্যান্সার কোষগুলো কি এস্ট্রোজেন (estrogen) এবং প্রোজেস্টেরন (progesterone) হরমোন সংবেদনশীল? ক্যান্সার কোষগুলোতে কি Human epidermal growth factor receptor 2 (HER2) নামের একটি প্রোটিন আছে?

এই প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর পরবর্তীতে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের সাহায্য করবে, স্তন ক্যান্সারের কোন রোগীকে কোন ধরনের চিকিৎসার দিতে হবে, সেটি ঠিক করতে।

একবার যখন সুনির্দিষ্ট ভাবে স্তন ক্যান্সার নির্ণয় হয়ে যায়, তখন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা, স্তন ক্যান্সারের স্টেজ (stage) নির্ধারণ করার জন্য আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন – যেমন শরীরের অন্যান্য অংশের সিটি স্ক্যান, ব্রেইন (Brain) এর এম আর আই, হাড়ের (Bone) স্ক্যান, এবং পুরো শরীরের পি ই টি (PET) স্ক্যান।

অবশেষে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে, এবং রোগীদের সাথে খোলামেলা আলাপ আলোচনার পর, স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসার ব্যাপারে, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেন।

কিন্তু স্তন ক্যান্সারের এই পরীক্ষাগুলো বেশ ব্যয়বহুল। আশার কথা হচ্ছে, সব রোগীর সব পরীক্ষা নাও লাগতে পারে। কোন রোগীর জন্য কোন পরীক্ষা অপরিহার্য, কোন পরীক্ষা এই পর্যায়ে না করলেও চলে, কোন পরীক্ষা একেবারেই দরকার নেই, রোগীদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে এই সিদ্ধান্তগুলোও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরাই নেবেন।

(চলবে)

ডাক্তার মনিকা বেগ,
প্রধান এবং বৈশ্বিক সমন্বয়ক (অবসরপ্রাপ্ত),
এইচআইভি/এইডস সেকশন,
জাতিসংঘ সদর দপ্তর,
ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া।

শেয়ার করুন: