হিজরারা কেন এতো বঞ্চনার শিকার?

সাজেদা আক্তার জেরিন:

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে লৈঙ্গিক পরিচয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি অধিকার বঞ্চিত যারা তারা হচ্ছে হিজরা সম্প্রদায়। নারীর অধিকার নিয়ে এখন চারিদিক বেশ সরব হয়ে উঠেছে কিন্তু লৈঙ্গিক রাজনীতির ফলে নারীর চেয়ে অধিক শোচনীয় জীবন ভোগ করতে হয় হিজরা সম্প্রদায়কে।

একজন পুরুষের সাথে একজন নারীর পার্থক্য বস্তুত একটি মাত্র সেক্স ক্রমোজোমের পার্থক্য। বায়োলজিক্যালি একজন হিজরার সাথে নারী বা পুরুষের পার্থক্যও একটি মাত্র ক্রমোজোমে। একটি ক্রমোজোমের পার্থক্যের কারণে যেমন পুরুষ প্রভু হয়ে উঠতে পারে না, নারী তার সম্ভোগসামগ্রী হয়ে যেতে পারে না তেমনি কাউকে সভ্য সমাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলাটাও পাশবিক অন্যায়। নারীরা কখনো কখনো পুরুষ হয়ে জন্ম না নেবার জন্য আফসোস করে, একজন হিজরা সম্ভবত আফসোস করে কুকুর বেড়াল হয়ে জন্ম না নেবার জন্য।

হিজরা শব্দটির উৎপত্তি আরবি হিজরত বা হিজরি শব্দ থেকে যার আভিধানিক অর্থ পরিবর্তন। এছাড়া ভদ্র সমাজে তাদের বৃহন্নলা, তৃতীয় লিঙ্গ এসব শব্দও সম্বোধন করতে ব্যবহৃত হয়। ইংরেজিতে কখনো বলা হয় কমন জেন্ডার। কমন জেন্ডার নামটিকেই আমার কাছে বৈজ্ঞানিক মনে হয়। অন্যান্য নামের সাথে লেপ্টে আছে ঘৃণা এবং বৈষম্যের রাজনীতি।

মাতৃগর্ভে ভ্রুণ নিষিক্তকরণ এবং বিভাজনের সময় জেনেটিক্সের কারণে অথবা সেক্স ক্রমোজোমের কার্য ত্রুটির কারণে X-X-Y এবং X-Y-Y সেক্স ক্রমোজোম সৃষ্টি হয় যার ফলে হিজরা শিশু জন্ম নেয়। তাদের যৌন অনুভূতি নারী-পুরুষের মতোই, তবে তারা সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম। এটাই তাদের সমাজ থেকে বিতাড়িত হবার প্রধান একটি কারণ। তারা অন্য যেকোনো শারীরিক প্রতিবন্ধীদের থেকে শারীরিকভাবে অনেক ভালো। তারা সুযোগ পেলে আমাদের মতোই যেকোনো কাজ করে দেখাতে পারে। এতো সামাজিক নিগ্রহের পরও অনেকের নানাবিধ প্রতিভা দেখা যায়; তথাকথিত ভদ্র সমাজে যা গ্রহণযোগ্য হয় না।
পুঁজিবাদী সমাজ এগিয়েছে নারীকে সন্তান জন্মদানের যন্ত্র হিসেবে পুঁজি করে; হিজরাদেরকে সম্ভবত এই ব্যবস্থারই বলির পাঠা হতে হয়েছে।

হিজরাদের জন্মের সময় পুরুষ এবং জীবনের পরবর্তী সময়ে নারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বয়ঃসন্ধিকালে যখন তাদের শারীরিক ও মানসিক লিঙ্গের পার্থক্য প্রকট হয়ে উঠতে থাকে সমাজ তখন তাদের হিজরা পল্লিতে নির্বাসিত করে। সব হিজরাদেরকেই মেয়েদের পোশাক পরতে দেখা যায়। তারা বিয়ে বাড়িতে নাচ গান করে বা চাঁদা তুলে জীবন নির্বাহ করে। হিজরাদের মধ্যে বেশ কিছু প্রকারভেদ আছে, সবাইই শারীরিকভাবে পুরুষ আর মানসিকভাবে নারী নয়। অনেকে শারীরিকভাবে নারী কিন্তু মানসিকভাবে পুরুষ; তবে তাদের নারী জননাঙ্গ সন্তান ধারণের উপযুক্ত হয় না। যতোই প্রকারভেদ থাকুক না কেনো সবাইকেই সাজ নিতে হয় কিন্তু নারীর। কারণ পৌরুষ খুবই মূল্যবান বস্তু, কোনো যৌন প্রতিবন্ধীর পুরুষের বেশভূষায় চলাফেরাটা পুরুষ সমাজ মেনে নিতে পারে না। সে নারী হিসেবে, অবলা হিসেবে চলাফেরার অনুমতি পায়। পুরুষ সন্তান জন্মদানে অক্ষম হলেও তার কোনো সমস্যা হয় না; সে খুব সুন্দরভাবে স্ত্রীর উপর দোষ চাপিয়ে নতুন আরেকটি বিয়ে করে। সমস্যা হিজরার বেলায় কারণ পুরুষাঙ্গ থাকা সত্ত্বেও সে নিজেকে নারী ভাবে। পুরুষতন্ত্রের প্রতি এর চেয়ে বড়ো অপমান আর কী হতে পারে!

সভ্য দেশগুলোতে হিজরা বা কমন জেন্ডার মূলধারার সাথে মিশে গেলেও বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোতে তাদের মানুষ বলেও গ্রাহ্য করা হয় না। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ঘ) ধারায় হিজরাদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে যার অস্তিত্ব সংবিধান ছাড়া আর কোথাও নেই। প্রচলিত ফৌজদারি আইনের ৩৭৭ ধারা অনুসারে হিজরাদের বিয়ে এবং যৌনকর্ম নিষিদ্ধ করা আছে। যৌনতা একজন মানুষের শারীরিক অধিকার। রাষ্ট্র কখনোই সেটাতে বিধিনিষেধ জারি করার অধিকার রাখে না। হিজরার শরীর পুরুষতন্ত্র ভোগ্যবস্তু মনে না করলেও নিষিদ্ধ করেছে তার নিজের শরীরকে উপভোগ করাকে। কেননা যৌনতা পুরুষের একান্ত বিনোদন হিসেবে পরিচিত।

হিজরাদেরকে কবর দেয়া হয় একটি বিশেষ পদ্ধতিতে। লাশের সাথে লবণ ও ফুল দেয়া হয়। তারা বিশ্বাস করে এভাবে কবর দিলে পরের জন্মে তারা পূর্ণাঙ্গ লিঙ্গ নিয়ে জন্মাতে পারবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হিজরাদের দেখে মূলত অপবিত্র নারী হিসেবে, যে মহামূল্যবান পৌরুষত্বকে অপমান করতে পুরুষের শরীর নিয়ে জন্মেছে।

হিজরা সম্প্রদায়ের অধিকারও নারীবাদী আন্দোলনের একটি অংশ হোক। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীতে কোন সমাজ কতটুকু সভ্য সেটা বোঝা যায় ঐ সমাজের একজন নারীর জীবন উন্মোচন করলে। নারীরা না হয় অভিনয় করে বাঁচতে পারে; হিজরারা তো জন্মের দোষেই নরকে নিক্ষিপ্ত হয়!

লেখক: শিক্ষার্থী

শেয়ার করুন: