শান্তা মারিয়া:
প্রথমেই একটি কুইজ অনুষ্ঠানে অংশ নেই চলুন। বলুন তো, বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় অপরাধ কোনটি?
-কী বললেন? খুন?
-আরে দূর মিয়া, খুন কোনো ব্যাপার? মশা, ছারপোকা মারার চেয়েও খুন করা সহজ ও সুবিধাজনক। মশা মারলেও হাতে রক্তের দাগটাগ থাকতে পারে। যে হারে আমরা হ্যান্ডওয়াশ ব্যবহার করছি তাতে খুন করে হাত ধুয়ে ফেলা কোন ব্যাপারই না।
-ধর্ষণ?
-কী বলেন? ধর্ষণ কোন অপরাধ নাকি? এটা তো বিনুদুন। ইচ্ছা হইলো আর দুই চারটা ধর্ষণ কইরা ফালাইলেন তবে না ব্যাডা একখান।
-মাদক চোরাচালান?
-আরে, কী যে কন। মাদক আবার চোরাচালান করা লাগে নাকি? এইডা তো বাণিজ্য। ব্যবসাপাতি না করলে দ্যাশের উন্নতি হইব কেমনে? শোনেন নাই বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী?
-ক্রসফায়ারে হত্যা?
-আরে, ঢিলাঢিলির মতো গুলি চালাচালি হইছে, একটা, দুইটা মইরা গেছে গা। এইডা লইয়া ফাউ প্যাঁচাল আর কত করবেন?
-শোনেন, আপনে পারবেন না। সবচেয়ে বড় অপরাধ কী এটা বলতে বললে আপনি এরপর চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, নির্যাতন, হ্যান, ত্যান এইসব নিয়া বলবেন।
এই দেশে ফেসবুকধারী পুরুষের দণ্ডবিধি অনুযায়ী সবচেয়ে বড় অপরাধ হইলো ‘নারী হইয়া জন্মানো’। তার চেয়ে বড় অপরাধ হইলো নারী হইয়া হাফপ্যান্ট পিন্ধন, মদের গ্লাস হাতে নেয়া, বিড়ি সিগারেট খাওয়া, বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে নাচা। এরচেয়ে বড় আপরাধ আর কিছু নাই। আরে এগুলি হলো রসের আলাপ। ক্রসফায়ার, ওসি প্রদীপ, লিয়াকত, ইলিয়াস কোবরা, সিনহা সাহেবের মৃত্যু, মাদক চোরাচালান, ওসির সাক্ষাৎকার এগুলো হলো জটিল বিষয়। এসব শুষ্ক কাঠের মতো ঠনঠনা বিষয় নিয়ে আলাপ করতে করতে গলা শুকিয়ে যায়। তখন দরকার হয় রসের আলাপের। কানু বিনা গীত নাই আর নারী মানে ‘মাইয়ালোক’ ছাড়া রসের আলাপে আরাম নাই। তার উপর সেই নারী যদি হয় তরুণী, প্যান্ট পরা, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, নতুন কিছু করতে চাওয়া মানুষ। শিপ্রার সম্প্রদায়গত পরিচয় নিয়ে না হয় নাই বললাম। কারণ সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ হয়ে যাবে।(তারপরেও বলি, শিপ্রার সম্প্রদায়গত পরিচয় নিয়েও অনেকের জ্বলুনি কম নয়)।
মূল কথা হলো, আরে তুই মেয়ে। তুই থাকবি ঘরের ভিতর। তোর এতো বনে বাদাড়ে ঘোরাঘুরি কেন? তোর এতো পুরুষের লগে ঢলাঢলি কেন? তোর আবার ফিল্ম বানানোর বদখেয়াল কেন? তার উপর তোরে ধরছে পুলিশে। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। তুই তো এখন বেওয়ারিশ মাল। তোরে নিয়া আলাপের মতো সুখ আর কীসে আছে? এখন কি আর সিনহার মৃত্যু, ক্রসফায়ার, মাদক ব্যবসা এসব ফাউ প্যাঁচালের সময় আছে রে পাগলা?
এখন আমরা আসল বিষয় পেয়ে গেছি। এখন সাবজেক্ট একটাই। নারীর চরিত্র হনন। এবার এই চরিত্র হনন গেমের মালমশলা সাপ্লাই দিয়েছে আইনের সুবোধ সেবকরা। এখন আমরা এটা নিয়ে মাতবো। সেই অবসরে পাবলিক সেন্টিমেন্ট যদি ঘুরাইয়া দেয়া যায়, যদি একবার বলানো যায়, সিনহা একটা যা তা লোক ছিল। ও মেয়েলোক নিয়ে ফূর্তি করতো। ওরে মারছে তো কী হইসে। ব্যস কেল্লা ফতে। আর কিছুর দরকার নাই। ফেসবুকধারী পুরুষকুল তাদের প্রাণের আরাম যে জিনিসে, তা পেয়ে গেছে। এই নেশার কাছে ইয়াবা তুচ্ছ।
কোন সিরিয়াস ক্রাইমের মধ্যে, কোন রাজনৈতিক এমনকি আন্তর্জাতিক ইস্যুর মধ্যেও যদি একবার কোনক্রমে নারীর চরিত্র হননের কোন উপাদান পাওয়া যায়। তো আর রক্ষা নাই। তখন নুরেমবুর্গ ট্রায়ালের চেয়েও, হিটলার, হিমলার, গোয়েবলস, গোয়েরিংয়ের বিচারের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়াবে নারীর কিচ্ছা। তার স্ক্যান্ডাল।
আমার জানতে ইচ্ছা করে, হাফপ্যান্ট পরা, মদের বোতল হাতে নিয়ে ছবি তোলা, ধূমপান পেনাল কোডের কত নম্বর ধারায় কত বড় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত? একজন নারী যদি পাশ্চাত্যের পোশাক পরে, যদি মদের বোতল নিয়ে ছবি তোলে, সিগারেট খায়, একজন পুরুষকে তুমি বলে ডাকে কিংবা কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ফিল্ম বানায়, কিংবা ধরলাম বেড়াতেই যায়, তাহলেই কি সে খারাপ চরিত্রের নারী হয়ে গেল? এটা কোথায় কোন সংবিধানে, আইনের কত নম্বর ধারায় লেখা আছে? আর তার ব্যক্তিগত ল্যাপটপের বা মোবাইলের থেকে ছবি নিয়ে সেই ছবি ভাইরাল করা কি সাইবার অপরাধ নয়?
এটা কোন ধরনের মানসিকতা? একজন নারীর হাতে সিগারেট থাকলেই সে খারাপ চরিত্রের এবং তখন তাকে নিয়ে যা খুশি তা বলা যায় এটা কোন দেশি আইন? এই কুৎসিত ট্রেন্ডের প্রতিবাদ করতে হবে প্রত্যেককে। নইলে যে কোন সময় যে কোন মানুষ নারী পুরুষ নির্বিশেষে পাবলিকলি সম্মানহানির শিকার হবেন এটা বলে রাখছি। শিপ্রাকে নিয়ে এই আলোচনা শুরুর উদ্দেশ্য হলো মূল অপরাধ থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানো। একথা বুঝেও কেন এই রসের আলাপটা চলছে?
শুধু শিপ্রা নয়। যে কোনো ঘটনায় যদি একবার কোন নারীর লাইফ স্টাইল পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক পেনাল কোড অনুযায়ী মনের মতো না হয় তাহলেই সব আলোচনা বন্ধ হয়ে শুরু হবে ওই নারীটির চরিত্র ও পোশাক নিয়ে আলোচনা। তখন সব বড় বড় অপরাধও গৌণ হয়ে যাবে। যেমন কিছুদিন আগে আমরা দেখেছি ডা. সাবরিনার বেলায়। সাবরিনার যে অপরাধগুলো ছিল সেগুলো নিয়ে কথা না বলে, বলা হয়েছে তার শরীরের গঠন, তার ছবি তোলা, তার ফ্যাশন ইত্যাদি নিয়ে। সাবরিনা অপরাধী। কিন্তু তার অপরাধ নিয়ে কথা না বলে এমন বিষয় নিয়ে আলাপ চালানো হয়েছে যেটা অপরাধের মধ্যে পড়ে না।
অন্যদিকে শিপ্রা অপরাধীও নয়। তার বক্তব্যে যদি কারও সন্দেহ জাগে তাহলে সেটা চিহ্নিত করা উচিত। কিন্তু সে কি পোশাক পরে, কেমনে কথা বলে, কাকে তুমি বলে, কাকে আপনি বলে সেসব নিয়ে তো কারও রসের আলাপের দরকার ছিল না। নারীর পোশাক, নারী কি খায়, কি মাথায় দেয় সেটা নিয়ে আলাপের, নারীর চরিত্র হননের খেলায় এত মজা কোত্থেকে আসে?
সাংবাদিকতা করতে গিয়ে দেখেছি কোনো নিউজে যদি কোন নারীর খোঁজ পাওয়া যায় ব্যস তার বিষয়ে আলাপ, তার বিষয়ে ফালতু প্যাচালের, গসিপের তখন আর শেষ থাকে না। বলা হয়, হোয়্যার ইজ দ্য ওম্যান? ধরুন, মোটর দুর্ঘটনায় তিন আরোহী নিহত হযেছে। যদি চালকের পাশে কোন নারী থেকে থাকে এবং সেই নারী যদি তার স্ত্রী, মা, বোন বা কন্যা না হয়ে থাকে তাহলেই চিত্তির। তখন দুর্ঘটনার পুরো বিষয় মুছে গিয়ে পাবলিক গসিপের খোরাক হবে ওই নারী ও চালকের সম্পর্ক। সেই নারী যদি আবার প্যান্ট শার্ট পরা হয়ে থাকে তাহলে আর কোন কথাই নেই।
যে কোন নিউজে যদি নারী থাকে তাহলে ফেসবুক পেজে সেই নারী সম্পর্কিত এমন সব মন্তব্য চোখে পড়ে যে মনে হয় এরা মুখে মুখেই নারীর সঙ্গে যৌনমিলন করে ফেলছে।
সমগ্র মহাভারতে তাদের সবচেয়ে পছন্দের বিষয় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ।
বাংলাদেশে অসংখ্য পুরুষ যৌন বিকৃতিতে ভুগছে। তাদের অবদমিত ইচ্ছা প্রতিফলিত হচ্ছে নারীর চরিত্র হননের আলাপে। যে কোন নারীর উপর রাগ হলেই পুরুষের সেই রাগের প্রকাশ ঘটে তাকে ধর্ষণ করার ইচ্ছার মধ্য দিয়ে। এরা কিন্তু পোটেনশিয়াল ধর্ষক। পরিবেশ, পরিস্থিতি ও সুযোগের অভাবে হয়তো চুপ করে আছে। কিন্তু সময় সুযোগ পেলে এই ক্রাইম করতে এদের বাধবে না।
এই যে ভয়ংকর মনোবৃত্তি, এর সমাধান কি? একদম শৈশব থেকে জেন্ডার সচেতন শিক্ষা।সমাজ পরিবর্তন। সমাজ থেকে জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ।
বলতে চেয়েছিলাম আইনের কঠোর প্রয়োগ। কিন্তু সর্ষের মধ্যে যখন ভূত থাকে তখন ভূতের বড় বড় ওঝারাও নিরুপায় হতে বাধ্য।