নারীর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার দায় কার?

ইসরাত জাহান তানজু:

রুপা আর আবির জমজ ভাই-বোন। ছোটবেলা থেকে একই আদরে মানুষ হয়েছে তারা। ছেলে বা মেয়ে বলে দু’জনকে কখনোই ভিন্ন চোখে দেখেনি পরিবারের কেউ। বৈষম্য তো দূরের কথা!!

একই স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করেছে দুজন। তাদের বয়স এখন ২০ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে তারা। রুপা পড়ছে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে আর আবির পড়ছে ফাইন্যান্স বিভাগে।দ্বিতীয় বর্ষ পেড়িয়ে তৃতীয় বর্ষে উঠে গেছে তারা। এতোদিন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই যাচ্ছিল। কোনো কিছু নিয়েই দুজনের কোনো অভিযোগ ছিল না।

হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেল সারা পৃথিবীব্যাপী করোনা সংক্রমণ। বাদ রইলো না বাংলাদেশও। করোনার কারণে অচল হয়ে পড়েছে দেশের সচল অর্থনীতির চাকা। সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার একের পর এক বন্ধ করে দিল মন্ত্রণালয়গুলো। জীবন বাঁচাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেদের গুটিয়ে নিল। বাদ রইলো না শিক্ষামন্ত্রণালয়ও। মার্চ মাসের শেষের দিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় সকল ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

করোনা ভাইরাস গৃহবন্দী করে ফেললো দেশের সকল জাতি, ধর্ম, শ্রেণী, পেশা আর সব জেন্ডারের মানুষকে। বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় নারীকে যেখানে সারা বছর চার দেয়ালে আবদ্ধ হয়ে দিন কাটাতে হতো, এবার করোনা পুরুষকেও সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে নারীর অবস্থা উপলব্ধি করতে বাধ্য করলো।

নারীবাদের ঢেউ ইউরোপ-আমেরিকার গণ্ডি পেরিয়ে যখন ভারতীয় উপমহাদেশে এসে আছড়ে পড়ে তখন বিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে চলমান একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলাদেশে যেসকল আধুনিকমনা, শিক্ষিত সমাজ গড়ে উঠেছে, তারা আর চুপ করে থাকতে পারলো না। যখনই জেন্ডার বৈষম্য দেখছে, তখনই প্রতিবাদ করছে।যদিও সেটার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

কিন্তু উল্লেখিত সময়কালের পূর্ববর্তী সমাজের অধিকাংশ মানুষের মনে মগজে এখনও জঘন্যভাবে থেকে গিয়েছে পুরুষতন্ত্রের প্রতি অন্ধ শ্রদ্ধাবোধ-ভক্তি-আনুগত্য,আর নারীবাদের প্রতি অজানা বিদ্বেষ। মূলত পূজিবাদের করাল গ্রাস আর ধর্মের অপব্যাখ্যাকে কাজে লাগিয়ে এধরনের মানসিকতাকে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। এই ধারায় কেবল পুরুষরাই নয়, নারীরাও অন্তর্ভুক্ত।পুরুষ যেখানে আধিপত্য কায়েমের জন্য পুরুষতান্ত্রিক হচ্ছে নারী সেখানে পুরুষতান্ত্রিক হচ্ছে নিজের নিরাপত্তার জন্য। এই নিরাপত্তা অন্য কোনো কিছু থেকে নয়, পুরুষতন্ত্রের হিংসাত্মক থাবা থেকে নিজেকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা।

রুপা এবং আবির একবিংশ শতাব্দীর এই শিক্ষিত, আধুনিকমনা,সচেতন শ্রণীর প্রতিনিধি। সমাজবাস্তবতার এই পার্থক্যগুলো তাদের পরিষ্কার চোখে নিখুঁতভাবে ধরা পরে।এতদিন পর্যন্ত অন্যের জীবনের বৈষম্যগুলো তারা বিশ্লেষণ করে আসলেও এবার বৈষম্য ধরা পড়েছে তাদের নিজের জীবনে।

করোনার এইসময়ে হল ছেড়ে বাসায় চলে আসে রুপা আর আবির। আবির প্রায়ই বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। রাত করে বাসায় ফেরে।গৃহস্থালির কোনো কাজই তাকে করতে হয় না। অন্যদিকে রুপাকে পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যেতে।বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা না দিতে। তাকে প্রত্যেকদিনই মায়ের গৃহস্থালির কাজে সাহায্য করতে হয়। বাসায় এসে আবির চা খেতে চাইলে মা রুপাকে বানিয়ে দিতে বলেন। মায়ের আচরণ রুপার চোখে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। বিষয়টা চোখে লাগে আবিরেরও। একদিন বিকেল বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রুপা ভাবতে থাকে বিষয়টি নিয়ে। নিজেকেই সে প্রশ্ন করে -ইদানিং মায়ের আচরণগুলো এমন কেন??

ভাবতে ভাবতে রুপা নিজে নিজেই কারণগুলো খুঁজে বের করে।

প্রথমত, রুপাকে বাইরে গিয়ে আড্ডা দিতে দেওয়া হয় না তার নিরাপত্তাহীনতার কারণে। আজকে আমরা টেলিভিশন অন করলেই দেখি ধর্ষণের খবর।পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখি নারী নির্যাতনের খবর। আবার রেডিও অন করলেও শুনি সহিংসতার খবর। কোথাও নিরাপত্তা নেই নারীর। নারীর একান্ত বিশ্বস্ত মানুষগুলোও সুযোগ পেলেও তার সৎ ব্যবহার করতে ছাড়ে না। কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না তারা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও সহপাঠিদের দ্বারা যৌন হয়রানি, আত্মীয়-স্বজনদের দ্বারা নির্যাতন,কর্মস্থলে সহকর্মীদের দ্বারা হেনস্তার পথে-ঘাটে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে নারী সবসময় এক অনিশ্চিত জীবন-যাপন করছে। আর এসবকিছুই হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের কালো-দূষিত-দুর্গন্ধযুক্ত বাতাস যাদের ফুসফুসে দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সার নামক ভয়ানকন ব্যাধি বাধিয়েছে তাদের লালসা চরিতার্থ করার জন্য। কিন্তু একই বিষয় পুরুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। পুরুষরা এসব বিষয়ে অনেক বেশি নির্বিঘ্ন ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করছে।

এমন অনিশ্চিত সময়ে চারপাশের পরিস্থিতি অবলোকন করেই আবিরকে বাইরে গিয়ে আড্ডা দিতে দিলেও রুপাকে নিরাপত্তার জন্যই তার মা এমনটি করতে বারণ করেছেন। কিন্তু আজকে যদি সমাজে নারীর নিরাপত্তা থাকতো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক -সহপাঠীদের দ্বারা সহিংসতার ঘটনা না ঘটতো, কাছের মানুষদের দ্বারা তারা যৌন নিপীড়নের শিকার না হতো, কর্মস্থলে শান্তিতে-নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারতো, তাহলে কোনো রুপাকেই তাদের মা বাইরে গিয়ে আড্ডা দিতে বারণ করতো না।

দ্বিতীয়ত, রাতের বেলা রুপাকে বাইরে যেতে না দেওয়ার কারণও পুরুষতন্ত্রের ভয়। কারণ সহিংসতার ঘটনাগুলো রাতের বেলায়ই সবচেয়ে বেশি ঘটে। দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে এসময় অধিকাংশ মানুষ নিজ ঘরে ফিরে যায়। সারাদিনের গ্লানি শেষে আপন ঠিকানায় একটু শান্তির নিঃশ্বাস নিতে চায়। আমাদের সমাজ এখনো রাতে নারীর চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

রাতেরবেলা নারীকে চলাচল যদি করতেও হয়, পাহারাদার হিসেবে রাখতে হয় পুরুষকে। কারণ বহুকাল পূর্বে থেকে নারীর মনে-মস্তিষ্কে এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে-নারী আসলে শক্তি আর বুদ্ধিমত্তায় পুরুষের তুলনায় দুর্বল।নারীর পক্ষে পুরুষতন্ত্রের মোকাবেলা করা কখনোই সম্ভব না। পুরুষতন্ত্রের নির্মমতা থেকে বাঁচতে তার সাথে থাকা চাই পুরুষ সহচর। যদিও নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া পুরুষতান্ত্রের এই দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভাঙ্গা সম্ভব না, কিন্তু এই প্রথা নারীকে এতোটাই বিকল করেছে যে নারী পুরুষ সহায়তা ছাড়া রাতে একা একা চলতে পারে না কেবল পুরুষের ভয়েই। আর এর কারণ পুরুষতন্ত্রের কাছে নারীর অসহায়ত্ব। এই ভয়েই রুপাকে তার মা রাতের বেলা বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন।

তৃতীয়ত, রান্না করাকে মনে করা হয় এটি একমাত্র নারীদের কাজ। যদিও ইদানিংকালে এই ধারণার কিছু পরিবর্তন আমরা কদাচিৎ দেখতে পাই। কিন্তু জীবনধারণের জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রান্না শেখা দরকার হলেও এটিকে প্রথাগতভাবে নারী-কর্ম বলে মনে করা হয়। প্রাচীন ধারণা অনুসারে নারীর একমাত্র নেশা আর পেশা হবে সংসার সামলানো, রান্না আর সন্তান লালন করা।

আধুনিককালে উপার্জনমূলক কাজে নারীকে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেলেও পুরুষতন্ত্র সেখানে শর্ত জুড়ে দিয়েছে। নারী যতই শিক্ষিত হোক না কেন আর অর্থোপার্জন করুক না কেন সংসারের কর্তা পুরুষই।নারীকে তার রান্না আর সন্তান প্রতিপালনের চিরাচরিত দায়িত্ব পালন করতেই হবে। বহুকাল ধরে সমাজে যেহেতু পুরুষতন্ত্রের জয়জয়কার, তাই পুরুষতন্ত্রই সমাজে নারীর দায়িত্বগুুলো ঠিক করেছে।কোনো সচেতন বিবেক এমনটা মনে করবে না যে- নারী আসলে ইচ্ছে করে সংসার-সন্তান সামলানো, সকল কিছুর জন্য পুরুষনির্ভরশীলতাকে নিজের জীবন-যাপনের উপায় করে নিয়েছে।পুরুষতন্ত্রই নারীকে বাধ্য করেছে এমনটি করতে। আর কোনো নারী যদি এই নিয়ম মানতে অস্বীকার করে, পরিবার, কর্মক্ষেত্রে সমান নিরাপত্তা-অধিকার-নেতৃত্বের দাবি করে, সমাজ তাকে কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে কপালে অপরাধীর টীকা লাগিয়ে দেয়। এভাবেই বলির শিকার হয়েছে অনেক নারী।

রুপার মা উল্লেখিত সমাজ বাস্তবতার মানুষ ।নিজেকে বাঁচাতেই তিনি পুরুষতন্ত্রের অধীনতা মেনে নিয়েছেন। নিজের মনকে গড়ে তুলেছেন পুরুষতন্ত্রের আদলে। এদিক থেকে আপাতভাবে তাকেও পুরুষতান্ত্রিক বলা যায়। তিনি জানেন এই সমাজে পুরুষতন্ত্রকে না মানলে রুপার জীবনে কী কী দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যে কারণে এতোদিন না করলেও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া রুপাকে তিনি সমাজের তথাকথিত নিয়মগুলো শেখাচ্ছেন। যার দরুণ রুপা আর আবিরের প্রতি মায়ের আচরণ ভিন্ন হয়ে গেছে। তিনি চাইলেও আর মিল বজায় রাখতে পারছেন না। কিন্তু তিনি সুযোগ পেলেই এর জোয়াল নিজের কাঁধ থেকে নামিয়ে দিবেন। কারণ সহজাতভাবেই কোনো মানুষ পরনির্ভরশীল আর শিকলবন্দী হয়ে থাকতে চায় না।

আমাদের সমাজে বিভিন্ন সময় পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য নারীকেও দায়ী করা হয়। বলা হয় নারীও এর ধারক-বাহক, যুগ যুগ ধরে তারাও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ধারণ করে আসছে। কিন্তু আরেকটু এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করা হয় না-নারী পুরুষতান্ত্রিক কেন হলো? কীভাবে হলো? এর ঐতিহাসিক কারণ কী? সে কি ইচ্ছে করেই পুরুষতান্ত্রিক হয়েছে? নাকি নিজের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ থেকে তাকে এমনটি করতে হয়েছে? নাকি পুরুষতন্ত্র তাকে বাধ্য করেছে পুরুষতান্ত্রিক হতে??

আসলে উল্লেখিত সবগুলো বিষয়ই এর জন্য দায়ী। তবে নারী কখনো স্বেচ্ছায় পুরুষতন্ত্রের বেড়ি পায়ে জড়ায়নি। আজকে পুরুষতন্ত্রের কারণে কেবল নারীই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না,পুরুষের জীবনও হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। পরিবার আর সমাজের অসহনীয় অর্থনৈতিক বোঝা, নেতৃত্বের দুরতিক্রম্য চাপ তাদের জীবনকে করে দিয়েছে বৈচিত্র্যহীন। অনেক সময় দায়িত্বের ভারে পুরুষকে আত্মহত্যাও করতেও দেখা যায়। যে পুরুষতন্ত্র স্বয়ং পুরুষকেই দেয়নি স্বাধীনতা, জীবনকে উপভোগ করার এতোটুকু সুযোগ, বরং সমাজে তৈরি করেছে বিভেদ রেখা, তাহলে কী প্রয়োজন আছে সেই পুরুষতন্ত্রে?? তাই নারী-পুরুষ উভয়ের মঙ্গলের জন্যই সমাজকে হতে হবে জেন্ডার বৈষম্যহীন। সম্মিলিতভাবে সমাজ থেকে শোষণমূলক হাতিয়ার পুরুষতন্ত্রের মূলোৎপাটন করা না গেলে শান্তি কখনোই আসবে না।

শিক্ষার্থী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন: