রোকসানা বিন্তী:
একজন বাঙালি স্বামীর দৈনন্দিন কার্যাবলী কী কী বলুন তো?
হ্যাঁ, তিনি জীবিকা নির্বাহের জন্য চাকুরী বা ব্যবসা কিছু একটা করেন।
এর বাইরে?
গৃহস্থালি কাজকর্ম?
অন্তত ষাট থেকে সত্তর ভাগ বাঙালী পুরুষ তাদের স্ত্রী থাকা অবস্থায় ঘরের কাজে কোনো সাহায্য করেন না। এর চেয়েও ভয়ংকর সত্য হলো, এদের মাঝে অনেকে গৃহস্থালি কাজকর্মকে একজন পুরুষের জন্য অপমানজনক মনে করেন। তারা ভাবেন, মেয়েদের কাজ করে সময় নষ্ট করার কোন দরকার নেই। এগুলো কাজ তাদের জন্য নয়। তারা কষ্ট করে বিয়ে করেছেন কি ঘর ঝাড়ু দেয়ার জন্য? এইজন্য তো বউ আছেই! তার চাইতে রিমোট অথবা মোবাইল ফোন অথবা দুটো একসাথে নিয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে আরাম করাটাই অনেক বেশি উত্তম!
আরও অজুহাত দেখান যে, এসব কাজ তিনি কখনও করেননি তাই পারেন না।
স্ত্রী কর্মজীবী হোক বা গৃহিণী হোক, স্বামীকে দিয়ে কাজ করাতে ব্যর্থ বেশির ভাগ সময়ই!
এই সমস্যার মূল অনেক গভীর।
পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের যেকোনো সংসারে পুত্র সন্তানের মূল্য অনেক!
সেই তুলনায় কন্যা সন্তান অনেকটাই সস্তা। পুত্র সন্তানের উপর ভর করে সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা যায়! তাই তাকে রাখা হয় পরম আদরে! যে কাজগুলো ছেলেকে দিয়ে করানো উচিৎ সেগুলো মা নিজেই করে ফেলেন বা অন্য কারো উপর গছিয়ে দেন। ফলে পুত্রটি গৃহস্থালি কাজের প্রতি উদাসীন থাকে এবং ধরেই নেয় এসব তার কাজ নয়, এগুলো কাজ কেবল মেয়েরাই করে থাকে। দিনে দিনে একজন পূর্ণাঙ্গ মানব সন্তানের পরিবর্তে পুত্রটি পরিণত হয় অর্ধমানবে।
কালের পরিক্রমায় পুত্র একসময় স্বামী পরিচয় ধারণ করেন, কিন্তু পুরনো অভ্যাস সব রয়ে যায় তার মাঝে। তিনি যেকোনো গৃহস্থালি কাজকর্ম যেমন – ঘর মোছা, রান্নাবান্না, বাসন মাজা কিংবা কাপড় ধোয়ার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড পরিমাণ অনীহা দেখান!
এমনকি অনেকে সন্তান পালনের মতো অবশ্য কর্তব্যকেও স্ত্রীর কাঁধে চাপিয়ে দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। স্ত্রীটি যখন ঘর-সংসার, রান্না-বান্না, বাচ্চা, বাজার – সদাই ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থায় দিন যাপন করেন, তখন তার স্বামী প্রবর নিজের উচ্চ আসন নিশ্চিত করতে “তরকারিতে লবণ কেন কম হলো, ভাত কেন নরম হলো, বাচ্চা কেন ব্যথা পেল, লুংগিটা কেন ধোয়া হয়নি” এইসব প্রশ্ন করে স্ত্রীকে বিব্রত এবং অনেক ক্ষেত্রে লাঞ্ছিত করতে পেছপা হন না।
প্রকৃতপক্ষে বেশিরভাগ বাঙালি স্বামী চোখ থাকতে অন্ধ, কান থাকতে বধির, হাত পা থাকতে পঙ্গু এবং বুদ্ধি থাকতেও মানসিক প্রতিবন্ধী।
তারা সুন্দরী তন্বী স্ত্রীর দিকে নয়ন ভরে তাকালেও রান্নাঘরের গরমে ঘামে ভেজা স্ত্রীর দিকে তাদের চোখ যায় না! বালতি ভরা কাপড় ধুয়ে যখন স্ত্রী হাঁপাতে থাকে তখন পাশে দাঁড়িয়েও স্বামী তা শুনতে পান না! কোন একটা কাজের জন্য স্ত্রী যদি অনুরোধও করেন তা স্বামীর কান পর্যন্ত যেতে সময় লাগে কয়েক ঘন্টা, অনেকক্ষেত্রে কয়েকদিন বা কয়েক মাস!
সারাদিন শুয়ে বসে কাটিয়ে দিয়েও স্বামীর এক গ্লাস পানি বা ভাত বেড়ে খেতে খুব কষ্ট হয়! তিনি সারাদিন কর্মক্ষেত্রে অনেক পরিশ্রম করেন, কিন্তু স্ত্রী যে বাসায় শুয়ে বসে কাটিয়ে দেন না এটা বোঝার জন্য অক্ষম! তারা চোখ বন্ধ করে থাকতেই বেশি পছন্দ করেন। কারণ চোখ খুললেই রান্নাবান্না বা ঘর মোছার মতো অসম্মানজনক কাজ তাকে করতে হবে।
ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, যারা স্ত্রীর সাথে ঘরের কাজকর্মে হাত লাগান, কিন্তু বেশির ভাগ সংসারেই অর্ধমানব স্বামী নিয়ে স্ত্রীরা সংসার করেন! এ নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলেই চিৎকার – চেঁচামেচি, অশান্তির আগুন। তাই সংসারে শান্তি রক্ষার্থে স্ত্রীরা নাক মুখ বন্ধ করে কাজ করে যান আর নিজেকে নিয়তির উপর ছেড়ে দেন। আসলে এ ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই।
জেগে থাকা মানুষকে কি আর ঘুম থেকে উঠানো যায়?
বাঙালি স্বামীরা যে জেগে থেকেও ঘুমিয়ে থাকেন!
লেখক:
উপ পরিচালক
বাংলাদেশ ব্যাংক