গোপা মল্লিক:
নাকফুল বা নোলক নারী সমাজের মধ্যে একটি অতি প্রচলিত গহনা। এবং জীবনে কোনো সময় না হলেও বিয়ের দিন বা বিয়ের পরে এটি অতি আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। আমাদের মা ঠাকুমারা এটা পরে আসছে। তাই আমরাও পরি। এটা যতটা না দেখতে সুন্দর লাগার জন্য, তার চেয়ে বেশি একটা প্রচলিত ধারণা থেকে আমরা নাকফুল পরি। এবং আমি নিশ্চিত, এই প্রচলিত কথাটা আমরা সবাই কমবেশি শুনেছি, স্ত্রীর নাকের বাতাস/দীর্ঘশ্বাস যাতে স্বামীর গায়ে না লাগে তার জন্য এই নাকফুল বা নোলক পরা হয়।
ঠাকুমা- দিদা, অন্যান্য মুরুব্বিদের কাছে প্রশ্ন করেছি- “আচ্ছা, পুরুষজাতির গায়ে নারীজাতির নাকের বাতাস/দীর্ঘশ্বাস লাগলে কী হয়?
“তারা বলতেন -“অমঙ্গল হয়।”
দুর্ভাগ্যক্রমে আমার ঠাকুমা এবং দিদা দুজনই বিধবা ছিলেন। এবং অনেক নাকফুল পরিহিতা কাকীমা মাসিমাদের স্বামীকেও আমি অসুস্থ হতে দেখেছি, অকাল বিধবা হতে দেখেছি।
শুধুমাত্র নাকফুল পরে যদি কারো অমঙ্গল বা মৃত্যু আটকানো যেতো, তবে কোনো মেয়েই আর বিধবা হতো না। কারও সংসারে কোনো অভাব অভিযোগ, অমঙ্গল ঘটতো না। মানুষের লাইফস্টাইল ও তার খাদ্যাভ্যাসের উপর তার সুস্থতা নির্ভর করে। আর মৃত্যু তো উপরওয়ালার হাতে। এই উপমহাদেশের স্বামী-স্ত্রীদের বয়সের মধ্যে ন্যুনতম ৫, ঊর্ধ্বে ১০ থেকে ১৫ বছরের পার্থক্য থাকে। সেজন্য স্বামীরা স্ত্রীদের আগে মারা যাবে এটাই স্বাভাবিক। (বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র বাদে)। সেক্ষেত্রে সামান্য নাকফুল বা নোলক কী করে কারো মঙ্গল-অমঙ্গল বা আয়ু বৃদ্ধির কবচ হতে পারে?
আমরা মেয়েরা যারা নিজেদের মুখের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নাকে ছিদ্র করি বা নাকফুল পরি, সেটা অন্য কথা। কিন্তু নারীজাতিকে ছোট করা এইসব বস্তাপচা যুক্তির জন্য নাক ফোটানোর কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে আমি মনে করি না। মেয়েরা সংসারের লক্ষ্মী। যে সংসারে কোনো নারী থাকে না সেই সংসারের দিকে তাকালেই বোঝা যায় সংসারে একজন নারীর গুরুত্ব কতখানি। তাহলে কেন নারীর নিঃশ্বাস নিয়ে এই সর্বনাশ বা অমঙ্গলের কথা আসে?আর সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো মহিলারাই এগুলো নিয়ে বেশি সমালোচনা করে থাকেন। নিজে নারী হয়ে কিভাবে তারা এই ধারনা পোষন করতে পারেন যে- স্ত্রীর নিঃশ্বাস/দীর্ঘশ্বাস গায়ে লাগলে স্বামীদের অমঙ্গল হয়?
নিজেকে যে সম্মান করতে জানে না, নিজেদের সম্পর্কে যারা এমন নিচু ধারণা পোষণ করে, তারা সারাজীবন মেয়েমানুষ হয়েই বেঁচে থাকবে। মানুষ হতে পারবে না। কোনো মেয়ে/নারীর নাকে নাকফুল আছে কি নেই দেখে আমরা সহজেই ধারণা করতে পারি তার স্বামী জীবিত আছে নাকি নেই! কিন্তু পুরুষের কোন চিহ্নতে আমরা বুঝতে পারি যে সে অবিবাহিত, বিবাহিত নাকি বিপত্নীক?
আমরা মেয়েরা সার্টিফিকেটে শিক্ষিত হয়েছি বটে, কিন্তু অবচেতন মনে হাজার বছরের পুরানো কুসংস্কার আঁকড়ে ধরেই রয়েছি। তাই এগুলো থেকে বের হয়ে আসুন। আমি আবারও বলছি, নিজেদের মুখের সৌন্দর্য্য বাড়ানোর জন্য অলঙ্কার হিসেবে নাকফুল/নোলক/নথকে আমি অস্বীকার করছি না বা খারাপও বলছি না। শুধু নিজের ইচ্ছা রা রুচির বিরুদ্ধে গিয়ে সমাজের কটু কথায় নিজের মর্যাদাকে বিকিয়ে দেবেন না।
আত্মমর্যাদা জিনিসটা খুব দামী। আপনার নাকফুলের চেয়েও।