পুরুষতান্ত্রিক নারী-পুরুষ সবাই নারীকে ‘ভোগ্যপণ্যই’ ভাবে!

শামীম আরা নীপা:

অনেক বড় লেখা কেউ আগ্রহী না পড়তে, কারণ অত সময় আমাদের নাই, আচ্ছা যান না পড়েন, কিন্তু মোদ্দা কথা তো বুঝছেন, সচেতনতা ছড়ান, আপনাদের প্রতিবাদ জারি রাখেন, প্রতিরোধ গড়তে নিজ নিজ এলাকায়, নিজ নিজ সার্কেলে কাজ করেন প্লিজ।

ধর্ষণের পেছনের কারণগুলো নিয়ে ভাবছিলাম, যতোটা এই মুহূর্তে মনে হলো সেইটাই বলছি এখন, আগেও বহুবার বলেছি।

একজন শিশু আমাদের সমাজে যেভাবে বেড়ে উঠে, তাতে করে সে চারপাশ থেকে শিখে যে কন্যা শিশু অবহেলা উপেক্ষার যোগ্য, কন্যা শিশু প্যাসিভ, নিজের পরিবার থেকে পুত্র শিশু নিজেকে সুপিরিওর এবং তার বোনকে কিংবা যেকোনো কন্যা শিশুকে ইনফিরিওর ট্রিটমেন্ট পেতে দেখে, আমাদের শিশুরা ঘরে এবং বাহিরে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কন্যা কিংবা নারীকে তার প্রাপ্য সম্মানজনক অবস্থানে খুঁজে পায় না, শুধু বৈষম্যই দেখতে পায় নারীর প্রতি এবং নিজেকে পায় সুপিরিওর অবস্থানে, নারী দ্বিতীয় লিঙ্গ এবং পাত্তা দেয়ার মতো কিছু না, এমন মনোভাব নিয়ে বড় হতে থাকে। পরিবার ও সমাজ কন্যা শিশুদেরকেও দ্বিতীয় লিঙ্গ অবলা অথর্ব হিসেবেই বড় করতে থাকে।

যেই নারী নিজে খেটে খায় সে পর্যন্ত তার সন্তানের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করে। কন্যা শিশু/নারীকে পুরুষ কিংবা পুত্র কেউই তো সম্মানজনক অবস্থানে পায় না পরিবার ও সমাজে, সমঅধিকারী হিসেবে কোনো জায়গাতেই পায় না উল্টা নিজেকে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত দেখতে পায়! একটা শিশু ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত যাদেরকে নিচু অবস্থানে দেখে এবং নিজের জাতকে সুপিরিওর অবস্থানে দেখে এবং বুঝতে শিখে, সে কীভাবে একজন নারীকে আজন্ম সম্মান করবে?

একমাত্র সম্ভব যদি কোনো পুরুষ স্বশিক্ষিত হতে পারে তবেই সে নারীকে সম্মান করতে পারে, সমঅধিকারের ভাবতে পারে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের ছত্রছায়ায় থেকে, সেই চর্চা করে নারীর প্রতি নির্যাতন এবং সহিংসতাকে পুরুষ নিজের অধিকার মনে করে, যেকোনো নারীকে পুরুষ পৈতৃক সম্পত্তি মনে করে, নারীর প্রতি অসৌজন্যকে পুরুষ পৌরুষ বলে দাবি করে।

সম্পত্তির বন্টনও একটা বড় ইস্যু। এখানে কথা বলতে গেলে ধর্মের ইস্যু চলে আসবে। সম্পত্তির বন্টন মূলত ধর্মীয় প্রভাবে প্রভাবিত। ১৪০০ বছর আগে ধর্ম মতে নারী বাপের সম্পত্তির অংশ এবং স্বামীর সম্পত্তির অংশ পাবে বলে ঠিক হয় যেখানে পুরুষের ভাগ্যে বাধ্যতামূলকভাবে বৌ এর সম্পত্তি প্রাপ্তির কোন দলিল নাই, সেইক্ষেত্রে কারো সাথে সম্পত্তি নিয়ে যেন বৈষম্য না হয় তাই সেই নিয়ম চালু হয়েছিলো।

নারী যেহেতু উভয় পক্ষ থেকে সম্পত্তি পাবে তাই নারী বাপের সম্পত্তির কম অংশ পাবে তার ভাইদের থেকে। আদতে কী হয়ে আসছে নারীর ভাগ্যে তা তো রিসার্চের বিষয় আসলে, কতটা সম্পত্তি কিংবা অধিকার তারা পায় বা পেয়েছে এবং তা চরিতার্থ করতে পেরেছে- আমরা সমাজে থেকে, ইতিহাস ঘেঁটে কিছু আভাস পাই তার। এই বিষয়ে বিষদ আলোচনার সুযোগ আছে – এখন সেই আলোচনায় যাবো না।

এখনকার অনেক স্বশিক্ষিত মা বাবা তাদের সন্তানদেরকে সম্পত্তি সমান ভাগে ভাগ করে দিয়ে যায় কিংবা লিখে দেয়। সবকিছুর পেছনেই কারণ ও পরিস্থিতি কাজ করে। ১৪০০ বছর আগের পরিস্থিতি এবং তৎপরবর্তি পরিস্থিতি হুবহু এক না, হওয়ার কথা না। পরিবারের ছেলেটা যখন দেখে তার বোন তার থেকে কম সম্পত্তির অধিকারী, তখনই তো সে বুঝে নেয় যে নারী কত নগণ্য, নারীকে অধিকার বঞ্চিত করার পাঠ তো সেইখান থেকেই শিখে নেয়।

শিশু কন্যাকে খেলার জন্য আপনারা পুতুল আর হাঁড়ি-পাতিল ধরায়া দেন, কান্নাকাটি শিখান, গাছ-জঙ্গল বাইতে দেন না, ডাংগুলি, ক্রিকেট, ফুটবল খেলতে পাঠান না, কম খাইতে দেন পুত্রের চেয়ে, শিক্ষায় বৈষম্য করেন, খালি চাপতে থাকেন কন্যা শিশুকে – একটা পুত্র শিশু এখান থেকেই শিখে, কন্যা শিশু তথা নারীকে চিপার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হবে, উন্নত কোনকিছুই নারীর জন্য না, বরং উন্নত উন্মুক্ত সবকিছুই পুরুষের জন্য!

নারী কেন ঘরের বাইরে থাকবে, ঘরের বিনা পয়সায় চাকরানিগিরি বাদ দিয়ে কেন পুরুষের মতো অফিস-আদালতে কাজ করবে দিনরাত ভুলে, কেন নারী উঁচু গলায় কথা বলবে, কেন নারী বোরকা ছাড়া ঘুরবে, কেন নারীকে সম্পত্তির সম অধিকার দিবে, কেন নারী সন্তান জন্ম দিবে না, কেন নারী পুরুষের ইচ্ছামতো যৌনতায় বিনা বাক্য ব্যয়ে লিপ্ত হবে না, কেন নারীকে ভোগ্যপণ্য মনে করবে না ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক প্রশ্ন চলে আসে পুরুষের মনে! ছেলেকে শিখান এই ছেলেরা কাঁদে না, পিঙ্ক রঙ পরে না, হাঁড়িপাতিল পুতুল খেলে না, ছেলেকে শক্ত হতে হয়, ফুটবল ক্রিকেট হাডুডু খেলতে হয়, বুদ্ধির খেলা দাবা খেলতে হয়, মেয়েরা লুডু খেলুক, দাবার খেলোয়াড় মেয়েরা নয় – এমন কত শত জঘন্য কথা শেখাই আমরা আমাদের পুত্র কন্যাদেরকে! মেয়েরা এটা পারবে না, ওটা পারবে না – এই পারবে না পারবে না এর ভেতর কন্যা কিংবা নারীকে আবদ্ধ করে পরিবার সমাজ রাষ্ট্র সকলে পিষতে থাকে যেন কন্যা কিংবা নারী যাঁতাকলে পিষারই বস্তু!

শিশুকাল থেকেই ছেলেরা এটা শিখতে শিখতে বড় হয় যে শারীরিক গঠন ও মেটাবলিজম ছাড়াও নারী-পুরুষ ভিন্ন এবং সেই ভিন্নতায় পুরুষ উচ্চপদের এবং নারী সর্বনিম্ন পদের! দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার – এখানে নারীকে দুর্বল ভাবা হয়, অথচ তার কোনো ভিত্তি নাই এবং পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদ পুরুষকে করেছে মহান, আর নারীকে দিয়েছে দাসত্ব!

নারী-পুরুষ সবাই মিলেই আমরা পুরুষতন্ত্রের পূজা করি, আবার স্বশিক্ষিত মানুষগুলো নারী-পুরুষ উভয়ের সম-অধিকারের লড়াইয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায়, ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে সব থেকে বেশি হেয় অপমান অপদস্থ ও বঞ্চিত করা হয়, কিন্তু যারা স্কলার, তারা জানে, কোনো ধর্মই নারীর উপর পুরুষকে অবস্থান দেয় নাই! অনেক বিকৃত মানুষ এভাবে বলে – নারী তো তলায়ই থাকে, মানে ইন্টারকোর্সের সময় নারীকে তলায় থাকতে হয় বলেও নারীর অবস্থান তলে। কী মহান যুক্তি!

এমন জঘণ্য কথা যারা বলে – তাদের মুখে আমার পেচ্ছাপ করতেও ঘেন্না হয়। ইন্টারকোর্সের বর্ণনা পুরুষ ছেলেরাই বেশি ভালো জানে এবং তারা এও জানে যে নারীর অবস্থান বিন্যাস কতখানি, সেইখানে তারপরও এই জঘন্য কথাটা অনেক বিকৃত মানুষকে বলতে শোনা যায়। এই তলা শুনে, তলা বলে বলেই পুরুষের মনস্তত্ত্বের একটা বড় অংশ প্রতিবন্ধকতা ও আবদ্ধতার ভেতরই ঘূর্ণায়মান – সেখান থেকে তারা স্বার্থের কারণেই বের হয়ে আসে না, আসতে চায় না, আসতে পারে না।

আগে ছেলেরা রগরগে চটি বই কিনে পড়তো ফুটপাথ থেকে, তাদের মাস্টারবেশনে খুব সুবিধা হতো তাতে। তারপর আসলো ভিডিও প্লেয়ার/ভিসিআর এ এক্স/2 এক্স/3 এক্স রেটেড ব্লু ফিল্ম, যা দেখার প্রতুলতা খুব কম ছিলো ছেলেদের, সেইটাও তাদের মাস্টারবেশনকে আরো একটু চমকপ্রদ করলো – যা শুধু কল্পনাতে সীমাবদ্ধ ছিলো, তা লাইভ দেখতে পেরে তাদের চমকের কোন শেষ ছিলো না। আসলো ইন্টারনেট, আসলো সাইবার ক্যাফে – দারুণ সুবিধা হলো ছেলেদের। যাদের নিজের পার্সোনাল পিসি এবং ইন্টারনেট কানেকশন ছিলো, তাদের তো পোয়া বারো। তারপরও একটা রেস্ট্রিকশন ছিলো যে চাইলেই যখন তখন ইন্টারনেট টিপে পর্নোগ্রাফি দেখা সম্ভব হতো না ডাটার উঁচু মূল্য এবং ঘরের পারিবারিক একটা পরিবেশ সব মিলিয়ে। আসলো মোবাইল ফোন, স্মার্ট ফোন আর ইন্টারনেট কানেকশনের সুলভ বাজার – আর কোথায় যাবা…!

ছেলেমেয়েরা পকেট মানি দিয়েই গিগাবাইটের পর গিগাবাইট কিনে নিজেদের ইচ্ছামতো ফ্যান্টাসির রাজ্যে ঘুরে বেড়াতে পারে, আর ছেলে যুবক পুরুষের বেহেস্তি হুর তো এখন প্রতিটা স্মার্ট ফোনে…! আমি কি একবিন্দুও ভুল কিংবা মিথ্যা বলছি?

শিক্ষিত- অশিক্ষিত, সুস্থ- অসুস্থ- বিকৃত নির্বিশেষে সকলেই মোবাইলে পর্নোগ্রাফি দেখতে পারে যখন-তখন এবং তাদের মাল মাথায় চেপে থাকে। মোবাইল কিংবা ইন্টারনেট কানেকশন না শুধু, বরং পর্নোগ্রাফিও এখন মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। যার প্রেক্ষিতে বিকৃত পশুগুলো মাথায় মাল নিয়ে শিশু থেকে বৃদ্ধ – সব বয়সী নারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

পোষাক কোন ব্যাপার না, ফিগার কোন ব্যাপার না, তাদের শুধু রক্ত মাংসের একটা ‘ফুটা’ চাই, বোরকা হিজাব পরে ঘুরো কিংবা ব্রা-প্যান্টি –তাদের মাথার মাল কোনকিছুরই মুখাপেক্ষি না। বিকৃত পশুগুলো যে শুধু পর্নোগ্রাফির মুখাপেক্ষি, তাও না, বিকৃতদের বিকৃতি নানারকম সামাজিক অবক্ষয় কুশিক্ষা এবং কুচর্চার মাধ্যমে লালিত-পালিত হয় এবং তারা নারীকে ভোগের পণ্য মনে করেই, বাপের সম্পত্তি মনে করেই ধর্ষণ করে, খুন করে নিপীড়ন নির্যাতন করে এবং পর্নোগ্রাফিময় দুনিয়া তাদের বিকৃতিকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।

আমাদের সমাজ, আমাদের সামাজিক ধার্মিক চর্চা, কোনটাই মানব বান্ধব নয়, বরং তার সবই দানববান্ধব, অ-মানুষবান্ধব। নারীদেরকে, কন্যা শিশুদেরকে এই সমাজের পুরুষ এবং পুরুষতান্ত্রিক নারীকুল কেবলই যৌন সামগ্রী এবং ভোগ্যপণ্য ভাবে – নারীকে মানুষ ভাবতে পারার মতো পরিবেশ, সমাজ, রাষ্ট্র – কোনটাই এখনো আমাদের দেশে গড়ে উঠেনি। ধর্ষণের পেছনে আরও অনেক কারণ আছে, যা নিয়ে এখন আর বলতে পারছি না- হয়তো আবারও বলবো পরে তথ্য উপাত্ত সহ।

#StopRape
#StopViolenceAgainstHuman
#StopViolenceAgainstWomen

শেয়ার করুন: