জিন্নাতুন নেছা:
প্রায় চার মাস হতে চললো করোনার সাথে আমাদের সংসার। একটা নিউজে দেখছিলাম কম করে হলেও ৪-৫ বছর আমাদের এই করোনার সাথেই জীবনযাপন করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক বার্তায় এমনই খবর পাওয়া গেছে। তাই হয়তো বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশও এই করোনাকে নিয়েই বাঁচার চেষ্টা করছে। অনেকটা প্রাত্যহিক জীবনের চলাফেরায় করোনাকে স্থান দেয়ার মতো ব্যাপার। আর আপনি কীভাবে স্থান দেবেন তা কেবল আপনিই ঠিক করবেন। বোধকরি এই অভ্যাসগত পরিবর্তন আনার জন্য সকল পর্যায় থেকেই কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবচিত্র বলে অন্য কথা।
গত চার মাসে পরিবর্তন তো হয়নি, বরং সকাল কিংবা বিকেল চায়ের দোকানে আড্ডা কিংবা রাস্তায় লোকাল বাসের ভিড় ঠেলে পথিকের পথ চলায় প্রমাণ করে আমরা কতটা সতেচন হতে পেরেছি! তবে হ্যাঁ যদি আপনি কৌশলী হোন, সচেতন হোন, সতর্ক হোন, তাহলে আপনি বেঁচে থাকবেন। আর যদি তার ব্যত্যয় ঘটে তাহলে মৃত্যুর রাজনীতির বলি হবেন আপনি! কারণ রাষ্ট্রের কাছে আপনি একজন প্রাণী মাত্র। কিন্তু পরিবারের কাছে আপনি বাবা, ভাই, মা, বোন, সন্তান কিংবা আরো কত কী?
কোভিড-১৯ প্যানডেমিক এ বাংলাদেশ সরকারের একের পর এক কৌশলী পথা চলা, কিংবা ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো সিদ্ধান্তই আমি মনে করি আমাদের আজ এই অত্যন্ত ভয়াবহ অবস্থার জন্য দায়ী। ফেইসবুকের সুবাদে এক নিউজেই জানলাম এক ঢাকায় প্রায় ৪-৫ লক্ষ মানুষ করোনা আক্রান্ত।সারাদেশে হিসেব করলে তা কত লক্ষ হবে তার কোন ইয়ত্তা নাই।
সরকারি হিসেব অনুযায়ী আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ৭৪ হাজার ৮৬৫ জন। মৃত্যু আজ হাজার (১০১২) ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু ঘরে ঘরে মৃত্যুর মিছিল। চারিদিকে পরিচিত জন, আপনজনদের আক্রান্ত আর মৃত্যুর খবর অনেক বেশি ভারাক্রান্ত করে তুলছে মনটাকে। দিন দিন নিজেকে বিকারগ্রস্ত মনে হচ্ছে।
ভাবতে পারছি না কোনদিকে চলেছি আমরা?
কিছুটা পিছন ফিরে তাকালে বুঝতে পারা যায়, বিদেশ থেকে ভাইরাস এদেশে প্রবেশেরই আগে রোধ করতে পারতো, সরকার তা করেনি! মেনে নিলাম।এরপর কঠোর লকডাউন না দিয়ে দিলো সাধারণ ছুটি। মেনে নিলাম। ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়া যাবে না, কিন্তু ব্যক্তিগত গাড়িতে যাওয়া যাবে। শুরু হলো টাকাওয়ালাদের প্রাইভেট কার, নোহাওয়ালাদের রমরমা ব্যবসা, মেনে নিলাম। লকডাউন তুলে নেয়া হলো, কিন্তু আবার সেটা দেয়া হলো লাল, হলুদ সবুজের আলোকে। সত্যিই আমার ক্ষুদ্র ব্রেনে কাজ করছে না এর কার্যকারিতা কী? জোনভিত্তিক লকডাউন দিয়ে কী করে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন কমানো যায়, ভাইরাস সংক্রমণ এড়ানো যায়, আমি অন্তত বুঝতে পারছি না! এক জোনে আজ লকডাউন চলছে, ধরলাম ৫ দিন চলবে, ৫ দিন পর কি তারা অন্য এলাকায় যাবে না? তাদের মধ্যে যদি ভাইরাস থেকে থাকে, তাহলে কি এর মধ্যেই ভালো হয়ে যাবে?
সরকার তার কৌশল একের পর এক এভাবে পাল্টিয়েই চলছে। ঘোড়াবুঝ দিয়েই চলেছে বাংগালী জাতিকে।
দীর্ঘ প্রায় ৪ মাস নানান নাটকীয়তা করতে করতে আজ আমরা করোনাকে প্রায় নিজের ঘরেই জায়গা করে দিয়েছি। কিন্তু এসব না করে যদি ৩০ দিন কঠোর লকডাউন পালন করা হতো, কিংবা ১৪৪ ধারা জারি হতো, সবকিছু বন্ধ থাকতো, তাহলে কি আজ বাংলাদেশ যে জায়গায় পৌঁছেছে সেই জায়গায় যেতো? আমি মনে করি যে যেতো না। আবার এতে করে আজ বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে যে অবস্থানে আছে, আমার মনে হয় তার চাইতে তফাৎ খুব বেশিও হতো না। আরে ভাই, জীবন বেঁচে থাকলে টাকা আসবে, আপনার অর্থনীতি বাঁচবে, কিন্তু জীবন যদি না বাঁচে, তাহলে টাকা দিয়ে কী করবেন? বোধ করি ভুলে গেছেন অর্থনীতিবিদরা যে জনশক্তিই অর্থনীতির মূল নিয়ামক। যদি জনশক্তিই না থাকে তাহলে অর্থনীতি দিয়ে কী হবে?
কিন্তু মাঝ থেকে আমাদের করোনা নিয়ে বসবাস করতে হতো না। এতো মানসিক চাপ আমাদের নিতে হতো না। প্রতিনিয়ত মারা যাবার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে অফিস করতে হতো না! বাইরে বের হতে হতো না! প্রতিদিন সকালে মাকে, বাবাকে, ছেলেকে বলতে হতো না দোয়া করো, যেন সন্ধ্যায় ঘরে ফিরতে পারি ঠিকমতো। এই মানসিক যন্ত্রণা যে কতটা বিশাল, তা কী করে বুঝবে সরকার?
ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর একটি টার্ম খুব মনে পড়ছে। তা হলো জৈব রাজনীতি। অর্থাৎ নাগরিকের দেহের উপর, জীবন-মৃত্যুর উপর রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা বিদ্যমান। জৈব রাজনীতি হলো, মানুষের শরীরের উপর নানা প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র ক্ষমতা বিস্তার করে। যেমন আমরা দেখে এসেছি নারী শরীরের উপর বিভিন্ন ধরনের জন্মনিরোধক ব্যবহারের মাধ্যমে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ করেছে রাষ্ট্র। তেমনি বর্তমানে কোভিড-১৯ অবস্থানেও নানান কৌশল অব্যাহত রেখেছে সরকার। যার পরিণতি হলো মৃত্যুর দীর্ঘ মিছিল।
সারাদেশে হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে, কিন্তু সরকার বলছে, আমরা এতো জন টেস্ট করেছি, তার মধ্যে এতো আক্রান্ত আর এতো মৃত। আর বোকাসোকা বাংগালী তা মেনে নিয়ে ভাবছে, আহা! ইতালি, আমেরিকার চাইতে আমরা ভালোই আছি। আমাদের দেশে তো আর একদিনে ৭০০ জন মারা যাচ্ছে না! হ্যাঁ, আমাদের দেশেও একদিনে ৭০০ জন মারা যাচ্ছে, বোধকরি তার চাইতে বেশি মারা যাচ্ছে। তার চাইতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু ঐ যে প্রতিদিন প্রেস ব্রিফিং হয় যেখানে সাজানো কিছু বক্তব্য থাকে। এতো টেস্ট, এতো আক্রান্ত, এতো মৃত। কিন্তু যাদের টেস্ট হয় না, কিন্তু করোনা সাস্পেক্টেড উপসর্গ নিয়ে মারা যায়, তাদের কী হবে? তারা এই দেশের নাগরিক নয়? তাদের সেবা পাবার অধিকার নাই?
একটা পরিসংখ্যান বলি, গত ৪ জুন সারাদেশে মোট টেস্ট হয়েছে ১২৬৯৪, ৫ জুন হয়েছে ১৪০৮৮, ৬ জুন হয়েছে ১২৪৮৬, ৭ জুন হয়েছে ১৩১৩৬, ৮ জুন ১২৯৪৪, ৯ জুন হয়েছে ১৪৬৬৪, ১০ জুন টেস্ট হয়েছে ১৫৭৩৩ (তথ্যসূত্র: DGHS website)। সারাদেশে টেস্টের সংখ্যার এই ওঠানামা আসলে কী বোঝায়? এমনকি প্রতি জেলা থেকে বর্তমানে টেস্ট করানোর সংখ্যাও কমিয়ে আনা হচ্ছে পর্যায়ক্রমে। তাহলে কি আবারো ‘নো টেস্ট’ ‘নো করোনা’ নীতির আলোকেই করোনাকে বিদায় জানানোর কৌশল শুরু হতে চলেছে!