মহুয়া ভট্টাচার্য:
বিক্রম সিং খাঙ্গুরা নামে এক অকাল প্রয়াত গায়কের কন্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনছিলাম- “নয়ন তোমারে পায়না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে”। রবীন্দ্রনাথ বরাবরই কাঁদায় আমাকে। শুনতে শুনতে কখন যে অঝোরে চোখের জল পড়ছে, টের পাইনি। হঠাৎ আমার স্বামীর ভর্ৎসনায় সম্বিত ফিরে পেয়েছিলাম।
“পুরান প্রেমিকের কথা মনে করে না কেঁদে তার কাছে চলে গেলেই তো পারো! বেশ বুকের ওপর লেপ্টে শুয়ে থাকতে পারবে সারাক্ষণ। ” তিনি ঠিক এভাবেই বলেছিলেন আমাকে। আমি ঠিক সেদিনই সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিলাম, আর নয়। এই মানুষটির সাথে আর কোনো ইস্যুতেই সংসার করা চলে না। আমার চোখের জলে সেদিন পুরানো প্রেমিকের স্মৃতি ছিলো না, ছিলো অকালপ্রয়াত গায়কটির জন্য কষ্ট, যাকে আমি কখনো দেখিনি। আমার সেই চোখের জলে ছিলো নয়নে নয়নে যে রয়েছে তাকে একটিবার দেখার জন্য রোদন। সে কে আমি জানি না। সে কি আমার সদ্য বয়ো:সন্ধি সময়ে হারিয়ে যাওয়া মা? নাকি ঈশ্বর নামে কোন অলীক শক্তি? নাকি সেই নটবর বেশী নীপমালা গলায় কোন আগন্তুকের জন্য?
যাই হোক, এই অন্তরের রোদনটুকু বুঝতে পারার সক্ষমতা তার মানে আমার স্বামীর ছিলো না। ব্যস, এইটুকুই যথেষ্ট কারণ মনে হয়েছিল আমার। বাকি সমস্ত ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের সাক্ষী সাবুদ দাখিল করার আর কোন প্রয়োজন আমি আছে বলে আমি মনে করিনি। কিন্তু বাঁধ সাধলো যখন আমি আইনি পদক্ষেপ নিতে মহিলা আইনজীবীর দ্বারস্থ হলাম, তখন। আইনজীবী নারী যথেষ্ট প্রগতিশীল এবং সত্যিকার অর্থেই আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তিনি সেপারেশনের কাজটি নিজে করতে চাইলেন না, কারণ তিনি ছিলেন আমার প্রতিবেশী। তিনি আমার প্রতিবেশী হয়ে সংসার ভাঙার পাপের দায় মাথায় নিতে চাননি। কিন্তু একজন উকিলের কাছে নিয়ে গেলেন।
উকিল ভদ্রলোকের চেম্বারে আমি একঘন্টা মানসিক রিমান্ড শেষে যখন বেরিয়ে এলাম তখন আমি বুঝতে পারলাম – জি বাংলা আর স্টার জলসার সিরিয়ালগুলো কতটা গাঁজা খাওয়া লোকেদের দিয়ে বানানো হয়। উকিলের কাছে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি সিরিয়ালের শীর্ষ অভিনেত্রী ছিলাম। মনে হয়েছিলো দুম করে উকিলের কাছে গিয়ে সেপারেশনের একটা নোটিশ চাইবো, আর তিনি আমাকে একটা কাগজে সই করিয়ে আমার স্বামীর কাছে পাঠিয়ে দেবেন, তারপর আমার স্বামীও রাগের মাথায় সই করে আমাদের একত্রে সংসারের কফিনে পেরেক ঠুকে এসে পড়বো।
ব্যাপারটা তেমন সহজ ছিলো না, প্রথমত, হিন্দু আইনে ডিভোর্স হয় না, হয় সেপারেশন। আর চাহিবা মাত্র সেই সেপারেশনও হয় না। তার অনেক আঁটঘাট, আইনি ফাঁক ফোকড়, খোরপোশের কানামাছি খেলার কৌশল। ঠিকঠাক আইনজীবীর হাতে না পড়লে তো আরও ভোগান্তি, আরও ঘুরাঘুরি। কোর্টের এনেক্স- ১, এনেক্স-২ ভবনের ভুলভুলাইয়াতে চক্কর কাটতে কাটতে শরীরে মেদ অর্ধেক কমে আসার সম্ভাবনা প্রবল। তো সেই আইনজীবী ভদ্রলোকের কাছে গিয়েছিলাম সেপারেশন নোটিশ পাঠানোর জন্য। তিনি জানতে চাইলেন আমার স্বামী সম্পর্কে আমার অভিযোগগুলো কী কী? প্রথমেই যে কথাটি তাঁকে আমি বলেছিলাম তা হলো- আমাদের কোথায় যেন তাল কেটে গিয়েছে। কোথাও যেনো সুর ঠিকমতো লাগছে না!
স্মার্ট, মাঝবয়সী উকিল ভদ্রলোক একটু থমকে তারপর বলেছিলেন – “আপনারা লেখক, কবিদের এই এক সমস্যা, সবকিছু গল্প উপন্যাসের মত করে ভাবেন”। পরে তাকে আমার স্বামীর টুকরো টুকরো কিছু সন্দেহপ্রবণতা আর মারমুখী ভঙ্গির বর্ণনা শুনে উকিল ভদ্রলোক আমায় বলেছিলেন – “শেনেন….! আমাদের ধর্মে আছে….আপনাদের ধর্মে আছে কিনা জানি না……। স্ত্রী যদি অবাধ্য হয়, তাকে প্রহার করার নিয়ম আছে ধর্মে। আপনি চাইলে মামলা করতে পারেন, সহিংসতা আইনে, নারী নির্যাতন আইনে….। তবে সমাজ কিন্তু আপনাকেই দুষবে, খারাপ বলবে, সুযোগ নিতে চাইবে,……।”
এক ঘন্টা যাবত তিনি আমার সামনে এই সমাজের চিত্র তুলে ধরেছিলেন, যা একেবারেই বাস্তব। তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসার পর আমার মনে হয়েছিলো সুর কেটে গেছে, লয় ঠিক নাই – এসব বিসমিল্লাহ খাঁ ব্র্যান্ডের কথাবার্তা বলে এখানে কোনো লাভ নেই। এখানে বলতে হবে – বর মারধর করে। মার খাওয়ার পর একটা মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে সোজা ফৌজদারি আইনে মামলা। যদিও আমাকে অতদূর যেতে হয়নি। অন্য একজন নারী উকিল আমার সুর, তাল, লয় কেটে যাওয়ার ছন্দপতন বুঝতে পেরেছিলেন। এবং আমার সংসার ভাঙার পাপের দায় স্বেচ্ছায় নিতে রাজী হয় গেলেন। এবং আমি এখন সেপারেশনের পথে।
সমাজ, ধর্ম, কিংবা সন্তানের দায় যে বীতশ্রদ্ধ সংসারে দাসখত দিয়ে পড়ে থাকার নামান্তর এ আমি বুঝে গেছি। আর এই পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলোও যে কেবল পুরুষবাদী। তাই আর হারানোর ভয় কী! যখন এই গোত্র আমার পিতার, যখন আমার সন্তান তার বংশের, যখন এই ঘর আমার স্বামীর যখন এই সমাজ, এই ধর্ম আমাকে দমিয়ে রাখার – তখন এই পৃথিবীতে হারানোর মত কি আছে নিজের? তাই এই মিথ্যে মায়ার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসি তবে। দূরে পড়ে থাক ঐ খোলস, কেউ দেখে জানুক আমিও মানুষ, কিন্তু খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার মত মানুষ।