সাবেরা আনোয়ার:
অনেক বছর পর বৈশাখ আর ঈদের জন্য এবার আমার সবচেয়ে বেশি প্রিপারেশন ছিলো। অনেক ইনভেস্টমেন্ট করেছিলাম। দেশী পোষাক নিয়ে আমরা যারা কাজ করি, তারা বছরের এই দুই সিজনে সর্বোচ্চ ব্যবসা নিশ্চিত করি। বলতে গেলে সারা বছরের ব্যবসা এই দুই সিজনে হয়ে থাকে। দীর্ঘ চার বছর পর আমি আবার অনেক ম্যাটেরিয়াল, ফ্রেব্রিক, এম্ব্রয়ডারির সুতা কিনলাম। নতুন ফ্যাক্টরি, অনেক কারিগর এ্যপয়েন্ট করলাম পুরো দমে কাজ শুরু করার জন্য। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! করোনা এসে সব কিছু উলট-পালট করে দিলো। এতো ইনভেস্টমেন্ট, এতো শ্রম, সব পানিতে। এখন চিন্তা কীভাবে এতোগুলো লোকের বেতন হবে, ফ্যাক্টরি, তারপর পশ এরিয়ার স্টোরের ভাড়া উঠবে! আর কতদিনই বা আমি এটা কনটিনিউ করতে পারবো এভাবে!
এই যে কথাগুলো বললাম, এটা শুধু আমার কথা না, আমার মতো অসংখ্য মানুষ যারা দেশীয় পোশাক, ফ্যাশন নিয়ে কাজ করেন, তাদের চিন্তা। কেউ কেউ আছেন সবকিছু ইনভেস্ট করেছেন এবার বৌশাখ আর ঈদের জন্য। ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে তারা করোনা সংকটের সময়ে কীভাবে সারভাইব করবে!
আমি ফ্যাশন এক্সিবিশন এরেঞ্জ করি বছরের বিভিন্ন সময়ে। তাই বিভিন্ন ভেন্যু আর হোটেল বুকিং করেছিলাম চড়া প্রাইসে এই সিজনের জন্য। আগে থেকেই পুরো বছরের প্ল্যান করতে হয় আমাদের। সেই ইনভেস্টমেন্টের কী হবে, এসব ভাবছি কদিন ধরে। এতো বছর অরগানাইজার হিসেবে কাজ করেছি প্রায় চারশো ফ্যাশন উদ্যোগক্তা এবং ছোট-মধ্যম ব্যবসায়ীদের সাথে৷ তাই অনেকে ফোনে, ইনবক্সে তাদের দুশ্চিন্তা শেয়ার করছেন আমার সাথে। তাদের চিন্তা আমাকে ভাবাচ্ছে। কিভাবে সার্ভাইব করবেন তা নিয়ে চিন্তায় আছেন মোটামুটি সবাই। অনেকের হয়ত খাওয়া পরা নিয়ে ভাবতে হচ্ছেনা। কিন্তু অপারেশনাল কস্ট নিয়ে ভেবে পাগল হচ্ছেন।
অনেকে আবার লোন করছেন, ইনভেস্টমেন্ট বাড়িয়েছেন এ সিজনের জন্য। তারা তো চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন। মূলও গেল আবার এক্সট্রাও যা করেছেন সবই গেল। জুন পর্যন্ত ব্যাংক লোন না দিতে পারলেও ডিফল্টার ডিক্লার না করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে ইন্টারেস্ট কিন্তু মাফ করা হয়নি।
এই দুর্যোগ অন্য যে কোনো সময়ের মতো না। কেউ জানি না এখান থেকে আমরা ঠিক কবে বের হতে পারবো! খুব কম করে হলেও নেক্সট চার মাস যাবে প্রাথমিক ধাক্কা সামলাতে। ধারণা করা হচ্ছে পুরো বছরই এর রেশ থাকবে। তাহলে এই মহাদুর্যোগে একজন ছোট ব্যবসায়ী কীভাবে টিকবেন রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া?
সবাই শুধু বড় ব্যবসায়ী আর স্টার্টআপদের কথা চিন্তা করছে, যারা বিশাল বড় বড় অংকের লোন নেন, আর ফেরত দেবার চিন্তা কম করেন। সরকার তাদের জন্য বিশাল অংকের প্রণোদনা দিচ্ছেন।
আর যারা ছোট ব্যবসায়ী তাদের কথা বলবার জন্য, তাদের স্বার্থ দেখার জন্য কেউই নাই। তাদের জন্য চড়া সুদে গালভরা নামে ব্যাংক লোনের ব্যবস্হা আছে। ব্যাংক লোন নিলে তারা কষ্ট করে হলেও তা ফেরতও দেন। কিন্তু এবার এরা কী করবেন? রাষ্ট্রের কি এই সেক্টরকে বাঁচিয়ে রাখা উচিত না? তা নাহলে কর্মসংস্হানের দায়িত্বও তাদের নেওয়া উচিত।
আমরা এক একজন এভারেজে কম করে হলেও দশজন লোকের কর্ম সংস্হান করি। তাহলে ধরে নিচ্ছি দশটা ফ্যামিলির দায়িত্ব আমাদের। প্রতি ফ্যামিলিতে যদি চারজন করে থাকে তবে চল্লিশজনের দায়িত্ব। আমাদের ব্যবসা বন্ধ হলে এরাও কিন্তু চাকুরী হারাবে। এদের জন্য হলেও আমাদের ভাবতে হচ্ছে।
আমার পরিচিত অনেক রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী ওপেক্স কমানোর জন্য লোক ছাঁটাই করছেন। রেস্টুরেন্ট ছেড়ে দিচ্ছেন। কারণ ডাইন ইনের মাধ্যমে তাদের মূল আয়টা হয়। এই ভাইরাসের কারণে এখন তা পুরো বন্ধ। ডেলিভারিও সীমিতসংখ্যক প্লেসে হচ্ছে যা খুবই নিতান্ত অপারেশনাল কস্টের তুলনায়।
দেশের অর্থনীতিতে আমাদের অবদান সামান্য মনে হলেও তা কিন্তু মোট জিডিপির ২০.৫%। ক্ষুদ্র-মধ্যম ব্যবসায়ীদের সংখ্যাটা নিতান্তই কম না, ৭৮ লাখ কাগজে কলমে। তারা এমপ্লয়মেন্ট জেনারেট করছেন ২.৫ কোটি মানুষের। দেশের প্রায় ৪০% মানুষের কর্মসংস্হান করে এই সেক্টর। এরা চাকুরী না খুঁজে ব্যবসা করছেন। অনেক মানুষের কর্মসংস্হান তৈরি করছেন। দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন।
সবচেয়ে বড় গেম চেঞ্জার হলেন অনলাইন ব্যবসায়ীরা। ঠিক কতজন অনলাইন ব্যবসায়ী আছেন, সঠিক সংখ্যাটা আমার জানা নাই। কিন্ত সেই সংখ্যা যে বিশাল তা যে কেউই বলতে পারবেন। বহু মানুষ ফিনানশিয়ালি ইন্ডিপেন্ডেন্ট হয়েছেন অনলাইনে ব্যবসার মাধ্যমে। এরা এখন পুরোই ব্যবসা হারিয়েছেন এরই মধ্যে। সাপ্লাই চেইন, ডেলিভারি সিস্টেম পুরোটাই বন্ধ এই প্যানডেমিকের কারণে। এদের মধ্যে নারী ব্যবসায়ীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বহুলাংশে এরা সিঙ্গেল প্যারেন্ট, যা কিনা মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। এই নারীরা এভাবেই দাঁড়িয়েছিলেন নিজের পায়ের ওপর, সমাজে একটা অবস্থান তৈরি করেছিলেন, সন্তান লালন-পালন করছিলেন। কিন্তু এখন কী হবে তাদের? কেউ কি চিন্তা করছেন কীভাবে এদের সাহায্য করা যায়? কীভাবে এরা টিকে থাকবেন এই দুর্যোগে?
যারাই ফোন করছেন, কথা বলছেন, তাদের উদ্বেগটা বুঝতে পারছি। চিন্তা করছি কী করা যায়। সাহস দিচ্ছি। কিন্তু নিজেই ভরসা কম পাচ্ছি।
জানি আবার সব ঠিক হবে। নতুন পৃথিবীতে নতুনভাবে আমরা আবার সবকিছু গুছিয়ে নিবো। কিন্তু ততদিনে যদি বিশাল ক্ষতি হয়ে যায় আমাদের? এখন শুধু সময়ের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আর যে পথও নেই।