প্রতিটা দিন যেখানে এই শহর গা সওয়া মৃত্যুর অনিশ্চয়তা আর হাস্যকর অসঙ্গতিতে পরিপূর্ণ, সেখানে করোনা বিষয়টা ব্যাপক বিনোদনই আমাদের জন্য। মরে যাওয়া মানে যেখানে অনিশ্চিত নিত্য মরার হাত থেকে বাঁচা, সেখানে আমরা অপেক্ষায় আছি এইরকম একটা তুমুল আলোড়িত মৃত্যুর জন্য। নাহলে আগাম সর্তকতার বাণীও এতো হাস্যকর হালছাড়া কেন জন এবং গণের মাঝে!
চুপ করে মজা নেয়াটাই এখন ঢাকাবাসীর নিত্য করণীয়। এই শহরে মৃত সন্তান কোলে মায়ের আহাজারিও আমাদের কাছে বেশ মজার সাবজেক্ট, বিজ্ঞাপন দিয়ে বেশ আয়োজন করে দেখার মতোই; কেউ পড়ে গেলে আগে গালি দিই, তারপর মজা নিই, আর নারী হলে তো কথাই নেই। সবাই মিলে আমরা তো পড়েই আছি একেবারে ভূপতিত। পড়ে থাকা আর মরে পড়ে থাকা তো সেই Comfortably dump হয়ে থাকাই তো।
ফুটপাত জুড়ে বসে থাকা সারি সারি টং দোকানে এক গামলা জলে শতবার ধোয়া কাপে মজা করে চা খাই, সীসা ভরা আকাশে বুক ভরে শ্বাস নিই, অপারেশন সেরে ডাক্তার বৃষ্টির পানিতে পা দিয়ে মরে গেলে আমরা ভাবি, জানে বাঁচলো, তার চেয়ে ডাক্তারটির হাতে কোনো একটা রোগী মরলে লোকজন তো পিটিয়েই মারতো; আমরা বাচ্চাকে দেখতে যাওয়া মাকে পিটিয়ে মেরে ফেলি, আর ব্যাপক আগ্রহে ভিডিও করি।
পূর্বাণী রায়
আমরা ৩০ বছরে যুবকের বিয়ে খাই, আর তাকে জেন্ডার সমতার গল্প শোনাই। ততদিনে শরীর মনে সে কেমন বিগড়ে যাওয়া পুরুষ তার বহিঃপ্রকাশ দেখে আন্দোলন করি, মজা নিই। একগাদা অপরিচিতের মাঝে ২৫ বছরের মেয়েকে ঠেলে দিয়ে তার কানে কানেও মাঝপথে বলে আসি,
‘মেয়ে তুমিও মানুষ বেশ, অধিকারটি বুঝে নিও শেষমেষ, যে সমতার গদ্যটা জন্ম থেকে হয়নি পড়া, সেখানে মাঝপথে কোনটা ধরা কোনটা ছাড়া? আছে অপেক্ষায় আসামী আর মানহীনার কাঠগড়া।’
জীবনধর্মী শিক্ষা তো স্কুল থেকেই সবার কাছে পৌঁছাতে হবে, সে ভাবনা না ভেবে কেবল অভিযোগের পাহাড়, আইন খুঁজতে গিয়ে বেলাইনে চলে যাবেন আপনা-আপনিই, এত্তো মজা চারদিকে।
রাস্তায় চলা বাসগুলি এক একটা রসের ভাণ্ড, রসিক সুজনসখীর মতো নিত্য টম এন্ড জেরি খেলে তারা, দিক হারিয়ে দু’পাঁচজন মেরে ফেললে বেশ একটা মজার আন্দোলন হয়, নিরাপদ কিছু বিনোদনও জোটে, তারপর আর নেই কোন আয়োজন। আবার যেই সেই, মহা আনন্দ পাই কোন গাড়ি রাস্তা ফেলে ফুটপাতে উঠে গেলে। আমাদের চারপাশে এত্তো মজার বিষয়, মৃ্ত্যুও এখানে নিদারুণ কৌতুক।
আমাদের ভোটের অধিকারের প্রয়োগে আর একটু চাপ দিতে পারলে কবে আমরা নুরা পাগলাকে ডেপুটি আর বাবুনাগরীকে চিফ বানিয়ে দিতাম, আগুনে পোড়া ভবনের সামনে সেলফি তুলে নিতাম বেশ ফটাফট।স্কুল কলেজ মানেই জেনা, ব্যস নারী মানেই সেল্ফ কোয়ারেন্টাইন। বিশ্ব দিতো বাহ্বা, এতো আগে বুঝলি কেমনে পাগলা।
তবে হ্যাঁ, একটা কম্পিটিশন নুরার লড়তেই হতো তেঁতুল হুজুরের সাথে, সেও এক ভীষণ মজার সাবজেক্ট।
অনেক প্রশ্ন করি আমরা, কিন্তু উত্তর খুঁজি না, কেবল মজা নিই, অনেকদিন ধরে মজা নেয়া ছাড়া আমরা আর তেমন কিছু পারি না।
ফণী সেভাবে না আসায় আমরা মর্মাহত হয়েছি, ইলিশ খিচুড়ি সামনে নিয়ে কত না অপেক্ষায় ছিলাম, নানা মজার কাহিনী দেখবো বলে, সব বরবাদ।
আমরা সবসময় অন্যের সমালোচনা করি আর “I am” নিয়ে আলোচনা করি। অথচ হওয়ার কথা ছিলো তো উল্টোটাই। আমাদের জীবনে আরেক মজার সাবজেক্ট আছে ধর্ম। ধর্ম কোন spritual connection নয়, নয় কোন self meditation ও, এটা নিদারুণ একটা দেখানোর বিষয়। হইচই করে চারদিকে বুঝিয়ে দিতে চাই আমার ধর্মবিশ্বাসে আনুগত্যের খবর। কী অদ্ভুত মজা!
ইসলাম সেরা ধর্ম বলে বৌদ্ধের কাতর মুখে তাকিয়ে মজা নিই, এটা অন্য ধর্মকে সইতে হবে, না হলে শান্তিতে মজা নেবো কেমনে! আর কেবল আশা করে চেয়ে থাকবো মোদি, ট্রাম্পের কাছে, তারা কোনো মজা নেবে না! আশার চেয়ে বড় কিছু নেই, এটা যেকোনো দেশের দুর্বলের চেয়ে বেশি আর কে বুঝে? সমতার আশা করে কেবল অসম গোষ্ঠিতেই।
এখন করোনা সংখ্যাগুরু, মানুষ সংখ্যালঘু। হায় এখানেও আশার চেয়ে বড় কিছু নেই।
পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে তিন বান্ধবীকে ঢুকতেই দিলো না বুদ্ধের শান্ত আশ্রমে, আর আমাকে বললো, যেতে পারেন। অথচ গৌতম কিনা জগতে সকল “প্রাণী” সুখী হোক এই বলেই গাছতলে আসন গেড়েছিলেন! সনাতন দেবতাও আছেন নিশ্চয়ই তিন মিটার দূরে দূরেই, মনে মনে বলেন, নারিকেল পরে দিয়েন আগে হাত ধুয়ে আসেন। মন্দিরে পূজোর সময় দেবতা ফেলে মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে করি বন্দনা, এবার তার দূর থেকে মজা দেখার পালা। দেবতাও মুখে ফল পাকুড় নিচ্ছেন সাবধানে, কে জানে কবে আবার বামুন হাঁচি দিয়ে রেখেছে।
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু! হ্যাঁ আমরা তো বিশ্বাসই করতে চেয়েছি মানবের সত্যতা মানবতার অস্তিত্ব ছাড়া আর সবকিছুতেই। আমরা বিশ্বস্ততার সাথে পেয়েছি মানবতাবিহীন এক বিশ্বস্ত বিশ্বাস করোনাকে। জীবনব্যাপী কেবল “I am”। নিজেকে কখনও প্রশ্ন করি না, Who am I? আমি কে? আমি কী? কতটা শান্তি ধারণ করি নিজের বুকের মাঝে নিজের জন্যই কেবল!
বিবেকানন্দের কথায় দৃশ্যমান সৃষ্টিকে অবজ্ঞা করে, অদৃশ্যমান স্রষ্টাকে নিয়ে মেতে থাকি।। অদ্ভুত এক বিস্ময়। বেশ তো এখন অদৃশ্যমান এসে মাতিয়ে রাখে, দৃশ্যমান যায় দূরে সরে। এতো মজা করে করে মাথাব্যথা করে ফেলি, প্যারাসিটামল খেতে গিয়ে সেখানেও মজার উপাদান ভুরি ভুরি। ঔষধে ভেজাল সেটা এই বিশ্বসংসারে কেবল আমরাই পারি।
চুন দিয়ে বাচ্চাদের দুধ বানাই আবার কেউ ধরলে তারে দিই বদলি করে, বেটা বদমাইশ দিল সব মজা মাটি করে! আমাদের তেমন দায় নেই। সব আছে সরকারের। শেখ হাসিনা ছাড়া সেখানে আর কে কে আছে নাম ধাম তেমন সঠিক জানি না। পরিষদ আসে যায়, কী বলে নিজেই কি শুনতে পায়! পাবলিকও বলে, আমার ঘন্টায় শোনে, আমার জগতে আমিই রাজা। শুনেছি সরকারি কর্মিরা সব মাছ কেমনে মারতে হয়, ধরতে হয় তা শিখতেই দেশ বিদেশে ব্যস্ত। বেসরকারিরা চাচার কাছে ধর্ণা দিয়ে পড়ে আছে নিজের জান বাঁচানোর জন্য। কাজ করবে কে? আরেকটা মারদাঙ্গা শব্দ আছে, ব্যবসা। মগজে গেলে করোনার মতো ভোল পাল্টে হয় ধান্ধা। ওটারই বেশ রমরমা, করোনার মতো নিজের কাছেই নিজে অচেনা। আছে বেশ মজার পরিবেশ চারদিকে।
কেবল বিসমিল্লাহ বলে বলেই উদ্ধত হাওয়া তারেক আছে বেশ পছন্দের তালিকায়, বিসমিল্লাহ্টা রাষ্ট্রের কোন কাজে লাগে হায়! ধার্মিক রাষ্ট্রও যদি বেহেস্তে চলে যায়, তবে আমাদের কী হবে উপায়! আমরা তো এই রাষ্ট্র নয়, সাত আসমানে নিতে চাই ঠাঁই। কী মজার ধাঁধা। জীবনব্যাপী সে নেতা তারেকও তো ব্যাপক ধর্মীয়, জীবনাচারে তার আদর্শ নায়ক, কেবল রোমিও? কী মজা!
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তো বেশ জিতলাম, এদিকে দিনলিপির ক্যালেন্ডার খ্রিষ্টান, (গ্লোবাল দুনিয়ায় এ ছাড়া উপায় আছে?) আবার ডরে ভয়ে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাটাও রাখলাম। যতক্ষণ ভাববেন ততক্ষণ মজা পাবেন। এই চিত্রটাই আমরা জনগণ, সরকার সবাই মিলে এঁকেছি।
আমরা আসলে গোলমাল করে ফেলা ছাড়া আর কী চাই নিজেরাও কি জানি?
কতো বাচ্চা ভাইরাসের আগেই হুজুরদের পাতে মরেছে, আমরা কি কেঁদেছি? একজন ভিখারী মায়ের কোলে একটা বাচ্চা ঘুমিয়ে থাকে, আমরা কি কখনও থেমে প্রশ্ন করেছি? আমরা কত অমানবিকতার জীবাণু নিত্য গিলে ফেলেছি; এতোটা অমানবিক হয়েছি কোন ভাইরাসে? সেই ভাইরাসের চরিত্র কি খুঁজি? তার ভ্যাকসিন আবিষ্কারে আছে কি কোনো তড়িঘড়ি?
হর্নের শব্দে দিকবিদিক বিদীর্ণ করে ছুটি, কান শোনার ক্ষমতা হারিয়েছে আগেই, তবুও হর্ন বাজাই দারুণ মজাতেই, তারপর ইশারাতে বলি সরে যেতে। হাজারও লক্ষ মজার মাঝে আমরা ব্যাপক নিমগ্ন, আর সন্তুষ্ট হয়ে আছি। নিজে মরা ছাড়া আর তেমন কোন মজার সাবজেক্টই নেই আমাদের কাছে!
আইসিইউতে কখনও ভর্তি হইনি, সেও নিশ্চয় এক দারুণ বিষয়, সেখানেও নিশ্চয় অপেক্ষায় আছে হরেক মজার বিস্ময়! কাকে আগে আইসিইতে দেয়া হবে তার তালিকা হবে, কাউকে ফেলে রাখা হবে। চারিদিকে যার হাত আছে, রেড সিগনালে ঠেলাঠেলি করে ঠিক আইসিইউতে পৌঁছে যাবে নিশ্চয়।
বেঁচে যাবো এ বড়ই সাধারণ ম্যাড়ম্যাড়ে বিষয়; এতোকিছুর মাঝেও আছি বেঁচে তা বড় নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা, লাগে না তেমন উত্তেজনা। মরবো বলে আমি মহানন্দে অপেক্ষায় আছি, আজকাল আমি মজা নিতেই কেবল ভালোবাসি।।