সাদিয়া শবনম হেমা:
একজন পুলিশ সদস্য আত্মহত্যা করেছেন। তার আগে লিখে গেছেন, বিয়ের সময় মেয়ের মা কেমন তা দেখে বিয়ে করতে, কারণ যে মা ভালো না, তার মেয়েও ভালো হবে না। সংসার জীবন দোযখের মতো হয়ে গেছে বলে উনি আর নিতে পারছিলেন না, নিজের অস্ত্র দিয়ে নিজেকে গুলি করে দিয়েছেন।
কেউ কেউ বলছেন, আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু কি করার ছিল না? কেউ কেউ এখনকার মেয়েদের আর মায়েদের ধুয়ে দিচ্ছেন, কেউ কেউ ছেলেদের আর তাদের মায়েদের ধুয়ে দিচ্ছেন, কেউ কেউ আত্মহত্যা যে করে সে কত কাপুরুষ সে বিষয়ে মত দিচ্ছেন।
একজনের কমেন্ট ভালো লেগেছে, আমিও এই চিন্তার সাথে একমত। ছেলেমেয়েদের নিজেদের পছন্দে কয়জন গার্জিয়ান বিয়ে করতে দেয়? এবং তাদের নিজেদের মতো করে সংসার কয়জন বাপ মা করতে দেয়?
ছেলেমেয়েদের বিয়ে বিষয়ে রীতিমতো আতংকিত করে ফেলে গার্জিয়ানরা, বুঝে বা না বুঝে। বিয়েটাকে এমনভাবে ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় যেন এটা ছাড়া জীবন জীবন না। একজন বিয়ে করতে পুরোপুরি প্রস্তুত কিনা, বিয়ে কাকে করবে, কীভাবে করবে, কখন করবে তা ঠিক করে দেয় পুরো গোষ্ঠি, সমাজ। আবার বিয়ে নিজের পছন্দে যদি কেউ করেও, সেই দম্পতি পরিবার আর সমাজের খাপে নিজেদের সেট করতে করতে, গার্জিয়ানদের সৃষ্ট বিভিন্ন ঝামেলা আর গিট্টু খুলতে খুলতেই শেষ করে দেয় জীবনের প্রথম মূল্যবান বছরগুলো। তারপর যখন একটু স্টেবল হয় তখন আবিস্কার করে তাদের মধ্যে কোন সত্যিকার আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হওয়ার অবকাশই হয় নাই। তাদের একসাথে থাকতে হবে তাই তারা একসাথে থেকে যায়।
আবার, আইনে এমনকি ধর্মেও, প্রয়োজনে ডিভোর্স এলাউড হলেও মানুষের চোখে তা বিরাট ক্রাইম। একটা ছেলে ডিভোর্স দিলে তাও হজম হয়, মেয়ে ডিভোর্স দিল মানে ভয়াবহ অবস্থা। ডিভোর্সি ছেলে মেয়ে আবার বিয়ে করতে গেলে তাকে এক কঠিন অবস্থা পাড়ি দিতে হয়। বাচ্চা থাকলে তো আরও পোয়াবারো। বাচ্চার সামনে বাপ মা প্রতিদিন ঝগড়া করুক, মারপিট করুক, নিজেদের রাগ কষ্ট সব বাচ্চার পিঠে বাড়ি দিয়ে ভাংগুক, তাও ওই বাচ্চার দোহাই দিয়েই মিলমিশ ছাড়াই অস্বাস্থ্যকর অসুখী এক দাম্পত্য জীবন পার করে দিতে বাধ্য সবাই। এই অসুখী কাপল তাদের মনের সমস্ত অসুখ বুঝে হোক না বুঝে হোক, পাস করে দিবে পরের জেনারেশনের দাম্পত্য জীবনে।
শুধু বিয়ে বা ডিভোর্স এর ক্ষেত্রেই না, ছেলেমেয়েদের জীবনের প্রতিটি পদে পদে, ডিসিশনে গার্জিয়ানরা নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের সমস্ত সম্ভাবনা, এবিলিটি, নিজের উপর আস্থা বিশ্বাস, মানসিক স্ট্যাবিলিটি, নিজে চিন্তা করার বা ডিসিশন নেয়ার সক্ষমতা সব কিছু নষ্ট করে দেন। এবং গার্জিয়ানরা ভাবেন তারা ভাল জন্যই করছেন, কারন তারা যা করেন তা সমাজের ঠিক করে দেয়া কিছু জিনিসের উপর ভর করে করেন, ছেলেমেয়েদের মন বা চাওয়ার উপর বেজ করে করেন না।
এই অবস্থায় কেউ কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে আত্মহত্যা করলে তাকে গালাগালি দেওয়ার কিছু নেই। সমস্যার মূলে গিয়ে সেটা আগে ঠিক করা প্রয়োজন। বোঝা উচিৎ একটা সময়ের পর প্রতিটা মানুষ আলাদা, তাই তাদেরকে তাদের মত করে থাকতে দিতে হবে এবং আমি যেটা যেভাবে বুঝি সেটাই ঠিক, এই চিন্তা থেকে বের হতে হবে। একটা বড় সংসারে সদস্য সবাই, কিন্তু একটা অনুসংসারে অন্য অনুসংসারের সদস্য অপ্রয়োজনীয়ভাবে বা অনাকাংখিতভাবে অনুপ্রবেশ করবে না, এমনটাই হওয়া উচিত।