শামীমা জামান:
ছোটবেলায় রাস্তায় মসজিদের কোন হুজুরকে দেখলে মনে হতো ফেরেশতা টাইপ কিছু। এনারা সকল পাপকর্ম থেকে নিজেদের মুক্ত রাখেন। শুদ্ধ জীবনের চর্চা করেন। আর এখন হুজুর (সবাই নয়) মানে ধর্ষক, হুজুর মানে কামুক। হুজুর মানে সমকামি। হুজুর মানে পেডোফেলিক। অনেক ধর্মভীরু পরিবারই মাদ্রাসায় দিতে চান বাচ্চাদের।
কিন্তু ঢাকা শহরের কয়টা মাদ্রাসা শিশুদের জন্য নিরাপদ? কদিন পর পরই এক একটা ধর্ষণের ঘটনা শোনা যায়।
যাই হোক আলাপ কিন্তু মাদ্রাসা নিয়ে নয়। এখনকার জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতাদের নিয়ে। এক সময়ে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে হানিফ সংকেত, কাজল, হারুন কিসিঞ্জার এনাদের বাজার ছিল। সেটা ছিল সুস্থ বিনোদন। মানুষ হুমড়ি খেয়ে সেই বিনোদন নিতো।
এখন তারা নেই, তাদের জায়গা দখল করে নিয়েছেন এই ওয়াজ করনেওয়ালারা। বক্তাদের যে টাকা দিয়ে আমন্ত্রণ করে নেয়া হয় সেই পরিমাণ টাকা এখন গায়কদেরও দিতে চান না আয়োজকেরা। দেবেনই বা কেন? গান তো হারাম। কিন্তু ওয়াজে বসে বয়ান শোনা তো পাহাড় পরিমাণ সওয়াব। কিন্তু কী ওয়াজ করছেন হালের ভাইরাল বক্তারা?
এক এক সময়ে এক এক হুজুরের উদ্ভব হয়, তেনারা এক একটা ডায়ালগ মারেন, আর জনতা লুফে নেয় সেই সব মহান বাণী। কিছুদিন আগে বিরানী না তেহারী নামের এক হুজুর অশ্লীল ইঙ্গিতে চা ঢেলে দেয়ার কথা বলে ব্যাপক হিট। ট্রল, মিম থেকে শুরু করে ফেসবুক এর কমেন্ট বক্সের জিফ এর মধ্যেও তাকে পাওয়া যায়। এখন চলছেন ত আদ্যাক্ষরের এক সাবেক শিবির কর্মী হুজুর। তিনি ট্রলে অন্যদেরকে ছাড়িয়ে গেছেন। ওয়াজে তিনি বলছেন বিচিত্র সব উদ্ভট বানোয়াট মিথ্যা কথা। চোখ কুতকুত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে তিনি বলছেন, ‘আমি তিন তিনবার অক্সফোর্ড এর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক মনোনীত হয়েছিলাম, কেউ সেকথা জানে না, আমার পরিবারও জানে না, আজকে আপনাদের বলে ফেললাম’।
সামনে বসে থাকা ধর্মভীরু শত শত মানুষ শুনে বলে উঠলো ‘আলহামদুলিল্লাহ’!’দুনিয়ার সবচেয়ে বড় পয়সাওয়ালা লোক আইফোনের মালিক! বিল্গ্রেড (পড়ুন বিল গেটস) এর সাথে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছে। বিল গ্রেডকে টিকটিকির মতো মনে হয়েছে’। ভাবুন তো একবার বিল গেটস নাকি আইফোনের মালিক! ভাগ্যিস স্টিভ জবস এটা শোনেননি। নাসায় নাকি তিনি কয়েকবার গিয়েছেন। তা নাসায় যাওয়া তো অসম্ভব কিছু না। কিন্তু সেখানকার বিজ্ঞানীরা নাকি তাকে বলেছেন, কিছুদিনের মধ্যে সূর্য পশ্চিম দিকে উঠবে। উনাকে হেলিকপ্টারে নিতে চাইলে উনি পছন্দ করেন না, কারণ উনি রকেটে চড়ে সবখানে গিয়েছেন! কোন যানে করে কোথায় যাওয়া সম্ভব সেইটুকু ধারণা অব্দি রাখেন না, কিন্তু নিজেকে বড় করতে মিথ্যার জুড়ি নেই।
পৃথিবীটা এখন অনেক ছোট। সকলের হাতের মুঠোয়ই সব তথ্য পাওয়া যায়। গুলবাজি করার এখন কোনো সুযোগ নেই। তবে এই লোকের কথা শুনে মনে হচ্ছে উনি ঠিক চাপাবাজির পর্যায়ে নেই। এক প্রকার ডিল্যুশন এর মধ্যে উনি আছেন। উনার চিকিৎসা প্রয়োজন। এখানে উনি ওনার স্বপ্ন কল্পনাকে বাস্তবে বলতে পছন্দ করছেন, এবং বলার সময় নিজে তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসও করছেন।
আরেক জনপ্রিয় সুদর্শন পরিপাটি হুজুর। যিনি বয়ানকে বেশ স্মার্টভাবে উপস্থাপন করতে চান। এতোটাই স্মার্টলি বলে চলেন যে মহানবীকে ‘সিক্স প্যাক’ বলতে দ্বিধাবোধ করেন না। বিবি খাদিজাকে ‘ইনটেক নয়’ বলতেও সংকোচ করেন না। এগুলো বলা যে ইসলামে বেআদবি এই সাঈদীপুত্রের বন্ধু তা ভুলে যান। আ আদ্যাক্ষরের এই হুজুর আবার ওয়াজের মধ্যে ‘চিজ বড়ি হ্যায় মাস্ত মাস্ত’ গান শুনিয়েও দর্শক মাতিয়ে ফেলেন। তখন অবশ্য গুনাহ হয় না। কারণ লোকজন ঘুমিয়ে পড়ে ওদের জাগাতেই এসব মাল-মশলার প্রয়োজন হয়।
কদিন আগে নাচাগানা আর বিড়ি ফুঁকিয়ে ওয়াজ করে এক ক্ষমতাশালী (উনি প্রধানমন্ত্রীকে নিজের শাশুড়ি বলে দাবি করেন) হুজুর ভাইরাল হয়েছিলেন। ইদানিং তার নতুন ওয়াজের ভিডিওতে তিনি মোবাইল ফোনের কারণে তরুণ সমাজের অধপতন নিয়ে বয়ান করেছেন। এটা কোন হুজুরের বয়ান, নাকি এক কামুক পশুর মাস্টারবেশন বোঝা গেলো না। হাত দিয়ে মুখ দিয়ে যে অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ পারফরম্যান্স তিনি দেখালেন, এসবে অন্যায় হয় না? ধর্ম অবমাননা হয় না? এদের ভুল ধরলে এদের মুরিদরাও ঝাঁপিয়ে পড়ে কমেন্ট বক্সে জঘন্য গালিগালাজ সমেত। মানুষ নাকি কেটে কেটে তাদের কথা ইউটিউবে দেখায়। সবারই এক অজুহাত।
মূলত এইসব ধর্ম ব্যবসায়ীতে ভরে গেছে দেশ। আর এদের অনুরাগী সরল ধর্মভীরু মানুষগুলো এরাই আমাদের অধিকাংশ জনগণ। ধর্মকে পুঁজি করে এই যে জমজমাট ব্যবসা এটা কি ধর্ম এলাও করে? উত্তর হলো, একদমই না। কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী জানা যায়, জাহান্নামে প্রথম যেসব ব্যক্তিকে নিক্ষেপ করা হবে সকলের বিচারেরও আগে, তারা মূর্তিপূজক নয়। তারা ইহুদি খ্রিস্টান নয়। মানুষ হত্যাকারী কিম্বা অন্য কোনো জঘন্য পাপীও নয়। তারা হলেন সেইসব মুসলমান, আলেম বক্তা, যারা দুনিয়ায় উপার্জনের জন্য বক্তৃতা দিতো। মানুষের বাহবা পাওয়ার জন্য বক্তৃতা করতো।
এবার বুঝে নিন এরা কারা! আর এই যে এতো সব মিথ্যা তারা বলেন, মিথ্যার ব্যাপারে কী বলা হয়েছে? বলা হয়েছে ‘মিথ্যা সকল পাপের মা’। সবচেয়ে আজব লাগে এদের কেউ রুখে দেয়ার নেই। কেউ তাদের চ্যালেঞ্জ করার নেই। সবাই ভয়ে সমীহ করে। অন্ধভাবে ভালবাসে। কত বোকা হলে একটা জাতি এইসব লোভী মিথ্যাবাদী ভণ্ড হুজুরদের পীর মানে!
কিন্তু এদের এদের রুখতে হবে, থামাতে হবে এক্ষুণি। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিশাল সর্বনাশের পথে এখন আমরা। এখনই সবাই সচেতন হোন। এদের ব্যবসা বন্ধ করুন। তারেক মনোয়ার এর মত ইসলাম দিয়ে দুনিয়া কামাই করা হুজুরদের ব্যাপারে কোরআন ও হাদীসে বহু সতর্কবাণী আছে। তার ভক্তের তো অভাব নেই। এই কমেন্ট বক্সেই আমাকে গালি দিতে সব চলে আসবে এখন।
আপনাদের বলি আপনারা উনাকে যদি সত্যিই ভালবাসেন তবে দেরী না করে উনাকে মানসিক চিকিৎসকদের কাছে নিয়ে যান। উনার সত্যিই চিকিৎসার প্রয়োজন।