লতিফা আকতার:
প্রবাসে থাকা মানুষগুলোকে আমার অনেক শক্তিশালী মনে হয়। অর্থনৈতিক কারণে নয়, মানসিক শক্তির কারণে।
আমার হোম সিকনেস ভয়াবহ। তাই দেশের বাইরে কেউ যাচ্ছে শুনলেই মনের মধ্যে একটা বিষণ্ণতা কাজ করে। সম্ভবত ২০১২ সালের দিকে, বন্ধু মঞ্জুর ফোন দিলো- বেলজিয়াম যাচ্ছে পড়তে।
আমার প্রথম প্রশ্ন ছিলো- কেন? তো, সে হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিলো। কিন্তু আমার জানি কেন বিষণ্ণ লাগলো। কত দূর যাবে ছেলেটা!!
যাই হোক, বিষয় সেটা নয়। কিছুদিন আগে প্রবাসী একজন বন্ধু আমাকে বললো- তুমি তো মানুষের জীবনের সমস্যা উপলব্ধি করো। সেটা লেখো। আমরা যাঁরা প্রবাসে থাকি তাঁদের নিয়ে একটা লেখা লেখো। একটি নারী বান্ধব দেশে পুরুষের জীবন কেমন হয় সে সমস্যা তুলে ধরো।
নারী বান্ধব দেশে আমি থাকিনি। খুব কাছ থেকে তাদের দেখিনি। তো লেখার চেষ্টা করলে, বা একটা লেখা নানান প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলবে বলে- আর লেখা হয়ে ওঠেনি। সাহসও করিনি।
প্রবাসে থাকা কাছের সাধারণ মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। প্রবাসী, কিন্তু বসবাসকারী দেশে কাগজহীন অবস্থা হতে শুরু করে দুর্দান্ত ক্যারিয়ার নিয়ে আছে, এমন অনেক কাছের মানুষ আছে। খুব পরিচিত। যাঁদের দেশে থাকতে বেশ ভালোভাবে চিনতাম।
কাগজপত্র না থাকা অবস্থায় বিয়ে করা বউকে কাগজে-কলমে অন্যের বউ হিসেবে বিদেশে পৌঁছানোর রিস্ক নিতে দেখেছি। কেউ সফলভাবে বউকে নিজের ঘরে তুলতে পেরেছে। কেউ হয়তো বউকে হারিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্তও হয়েছে।
আবার কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা গেছে- ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসা শুধুই মেকি হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে। পার্টনার হয়তো তাঁকে বিদেশে যাওয়ার এক টিকেট হিসেবে নিয়েছে। কিন্তু ব্যবহৃত ব্যক্তিটি বুঝতেই পারেনি। একসাথে সংসার শুরু করার পর বুঝতে পেরেছে। তাঁর প্রতি নয়, আকর্ষণ ছিলো বিদেশের ঝলমলে জীবনের প্রতি।
কেউ কেউ তো দুই তিন বার একই রকম ধাক্কা খেয়েছে। ব্যক্তি স্বাধীনতার দেশে *** একটি নম্বর কারো জন্য বিশাল সুবিধা আর কারো জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। মন নয়, একটা ফোন নম্বর কে অতি আপন করে ফেলে কেউ কেউ।
আপন-পর সব তালগোল পাকিয়ে যায়। জীবনের খাতাটা ভরে ওঠে হিজিবিজি দাগে। পার্টনারের স্বাধীনতা আসলে কতোদূর পর্যন্ত নেওয়া যায়! পার্টনারের কাছ থেকে সব রকমের সুবিধা নিয়ে তাঁকে মানসিক যন্ত্রণায় ফেলা, আসলে কি স্বাধীনতা? ভোগ, বিলাস, লিভ ইন রিলেশন, ব্যক্তি স্বাধীনতা সব এক জগাখিচুড়ি অবস্থার সৃষ্টি করে।
ভিন দেশে থাকা পরিবার পরিজনহীন মানুষটি যখন তাঁর সঙ্গী’র কাছ থেকে ধোঁকার শিকার হয়, তখন সে বিপর্যয় সামলে ওঠা আরও কঠিন হয়ে ওঠে। নিজেকে ভালো প্রমাণে সচেষ্ট উপমহাদেশের মানুষ, সঙ্গী’র চরিত্রে সব ধরনের কালিমা লেপনে পিছপা হয় না। উন্নত দেশে তাঁর আচরণ উন্নত হয় না। কিন্তু সমস্যা হয় যে, ভুক্তভোগী ব্যক্তির কষ্ট তাঁকে একাই সামলে উঠতে হয়।
বিদেশ বিভুঁয়ে একটি আন্তরিক কাঁধ খুঁজে পাওয়াও অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। যেখানে সে মাথা রেখে নিজেকে সামলে উঠবে। শুধু তাই নয়। প্রবাসী ব্যক্তিটির দেশে থাকা আত্মীয় স্বজনও রেহাই পায় না। অধিকাংশ সময়ই তাঁদের রাস্তার ফকির বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। অথচ এটা ভাবা হয় না – শিক্ষা জীবনের শুরু হতে বিদেশে পড়তে পাঠানো কারো পিছনে, একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের কতোটা এফোরট থাকে। এক ধাক্কায় সব মিথ্যে করে ফেলা হয়।
মাঝে মাঝে ভাবি- এই যে চাঁদ, জোছনা, বৃষ্টি আমাদের কাব্যিক করে তোলে, এ আসলে আমাদের মন পর্যন্ত কখনো পৌঁছায়ই না। এ এক মস্তিষ্কের ভ্রম। আমার কাছের মানুষের সম্মান দিতে শিখি না। রোমান্টিক কীভাবে হই!! বুঝলাম ব্যক্তিটি সম্মান পাওয়ার যোগ্যই না। তারপরও যাঁর সাথে বহু একান্ত সময় কাটানোর স্মৃতি, তাঁর মধ্যে কিছু তো সত্য থাকতে পারে! কিছু সত্য তো ছিলো! সে সত্যকে একেবারেই চুরমার না করলেই কি নয়!!
বিদেশ বিভুঁয়ে একাকি ব্যক্তি’র নিজেকে সামলে ওঠা বিশাল যন্ত্রণাদায়ক। কেননা সেখানকার বাঙালি কমিউনিটি তো আর চন্দ্র থেকে আসেনি। জাজমেন্টাল বাঙালি উন্নত দেশেও তার আপন মহিমায় সমুন্নত। একা হতে একা হয়ে যাওয়া মানুষটির হাহাকার, হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা তার আপন জন, কাছের মানুষদের নিকট সমান তীব্রতা নিয়েই পৌঁছায়। বাঙালি’র কষ্টের রঙ সব জায়গায় একই রকম।