এবার আপনারাই প্রমাণ করুন, দেশে সাম্প্রদায়িকতা নেই

ইমতিয়াজ মাহমুদ:

(১)
আপনি যদি এখন একজন হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, দেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি কী, তাইলে তিনি যেকোনো একটা মন্তব্য করার আগে তিন এগারো তেত্রিশ বার চিন্তা করবেন।

তিন এগারো তেত্রিশ মানে কী? যে একেকটা বিষয় তিনবার করে ভেবে তারপর তিনি তার মন্তব্য সাজাবেন। কীরকম? তিনি ভাববেন তাঁর একটা কথায় তাঁর নিজের উপর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কী হবে? সরকার কী মনে করবে? সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের নেতারা কী মনে করবে? আওয়ামী লীগ কী মনে করবে? বিএনপি কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে? হেফাজতের লোকজন আছে, চর মোনাই আছে। সরকারপন্থি টেলিভিশন চ্যানেলগুলি আছে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, ওদের একটা কথায় না আবার সারাদেশে হিন্দুদের উপর মারধোর শুরু হয়ে যায়।

ইমতিয়াজ মাহমুদ

এইসব চিন্তা করে সবদিক ভারসাম্য করে তারপর যদি ওরা একটু প্রতিবাদী ধরনের কথা বলতে পারেন। দায়িত্বটা আপনার। কেননা আপনি চান যে আমার দেশে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। আপনি চান যে মুসলমান নামাজ পড়ুক, ঈদ করুক, হিন্দু সান্ধ্য আহ্নিক করুক, পূজা করুক, খ্রিস্টানরা রবিবার রবিবার চার্চে জড়ো হোক, বৌদ্ধরা ওদের ধর্ম পালন করুক- সবাই সবার ধর্ম করুক।

আপনি এটাও চান যে সকল ধর্মের ধার্মিকরা যেমন ধর্ম পালন করবে, সেরকম আবার যারা ধর্ম মানতে চায় না ওরাও যেন স্বাধীনভাবে, মুক্তভাবে নিজের কথাটা বলতে পারে। আবার সকলে মিলে পয়লা বৈশাখে সব ভেদাভেদ ভুলে উৎসব করুক। এইরকম দেশ চান তো? তাইলে কথাটা আপনাকেই বলতে হবে। এইখানে আপনি মানে কে? মানে সংখ্যাগুরুর মধ্যে আপনারা যারা একটু লিবারেল ও উদার আছেন তারা।

এই জায়গাটায় আমি একটু হতাশ হই মাঝে মাঝে। এইবার যেমন প্রিয়া সাহা প্রসঙ্গে হয়েছি। কীরকম? আমার কয়েকজন উকিল বন্ধু, যারা বিশ্বাসী মুসলমান বটে, কিন্তু সেইসাথে আবার লিবারেলও। অন্যের স্বাধীনতা অধিকার এইসব সম্পর্কে সচেতন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিও আপনাদের প্রশ্নাতীত শ্রদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতা মেনে চলার নিষ্ঠা এইসবও আছে। আমার এই বন্ধুরা যখন প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে উত্তপ্ত আবেগময় পোস্ট দিয়েছেন ফেসবুকে, সেইটুকু আমি বুঝতে পারি। ভাই, একজন মানুষ ট্রাম্পের কাছে গিয়ে আমার দেশের বদনাম করছে, খারাপ লাগবে না? লাগবেই।

(২)

এইখানেই আমার একটু হতাশা হয়েছে। আমি মনে মনে ভাবি, আচ্ছা ভাইসাহেব তো রেগে মেগে এটা পোস্ট ঠুকেছেন প্রিয়া সাহার বিচার চাই, তিনি দেশদ্রোহী, তাকে আইনের আওতায় আনা হোক ইত্যাদি। ঠিক আছে। এটা বোধগম্য। কিন্তু ময়লা যে লেগে আছে সেটার কি করবেন? না, সেই প্রশ্নে উনাদের কথা হচ্ছে উনাদের দল ক্ষমতায় থাকার ফলে নাকি দেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে ইত্যাদি। ঠিক আছে উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেও তো নাসিরনগর ঘটেছে, রামু ঘটেছে, ২০১৪ নির্বাচনের পরের ঘটনা ঘটেছে। আর পূজার সময়টাতে মূর্তি ভাঙা সেটাও তো বন্ধ হয়নি। তাইলে?

শোনেন, সাম্প্রদায়িকতা এটা এমন জিনিস যেটা আপনি ভাঙা মূর্তির সংখ্যা বা পোড়া হিন্দুবাড়ির সংখ্যা দেখে বিচার করতে পারেন না। বা অন্য দেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি কতো ভয়াবহ সেটা দিয়েও জাস্টিফাই করতে পারবেন না। আপনার দেশে একটা বিশাল বিপুল সংখ্যা জনগোষ্ঠী আছে যারা সাম্প্রদায়িকতার বিষ ধারণ করে আর সুযোগ পেলেই ছোবল মারে। আপনারাই তো নির্বাচনের আগে আমাদেরকে বলেন যে বিকল্প নাই বিকল্প নাই- আপনাদেরকে সবাই মিলে ভোট না দিলে নাকি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ক্ষমতায় চলে আসবে। মানে কী? মানে হচ্ছে সাম্প্রদায়িক শক্তি আপনার চেয়ে সংখ্যায় বেশি না হলেও নিতান্ত কম নয়। তাই দাঁড়ায় না যুক্তিটা?

সেইটা নিয়ে কী করেছেন আপনারা? না, আমি বলছি না যে সাম্প্রদায়িকতা পোষণ করে যে জনগোষ্ঠী ওদেরকে মেরে ফেলতে হবে, বা পুরে রাখতে হবে বা দেশ থেকে বের করে দিতে হবে। তাইলে কী করবেন?

(৩)
আপনি তো আপনার নীতিতে অটল থাকবেন এবং সেই নীতিটা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাইবেন। আপনি সবাইকে বলবেন যে না, ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের বৈষম্য করা যাবে না, বিশ্বাসের কারণে কেউ কারো চেয়ে বড় হয় না বা ছোট হয় না ইত্যাদি। আপনি তো রাষ্ট্র নামক যন্ত্রটাকে ধর্ম থেকে বিযুক্ত করবেন। আপনি তো এই বার্তাটা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিবেন যে নিতান্ত ধর্মের কারণে কোন গোষ্ঠীকে বা ব্যক্তিকে হয়রানী করলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। না, এর পরেও কিছু মানুষ মন্দ থেকে যাবে। কিন্তু রাষ্ট্রের গোটা পরিবেশ যদি অসাম্প্রদায়িক হয় তখন ঐসব লোকজনকে তস্কর বা ডেলিঙ্কোয়েন্ট হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু ওদের সাথে যদি আপনি আপোষ করতে থাকেন তাইলে তো আর ওদেরকে আপনি নিন্দা করার নৈতিক শক্তি পাবেন না।

এইখানেই আমার উকিল বন্ধুরা এবং আরও যারা এইরকম আছেন আপনাদের ভূমিকার সুযোগ। আপনি প্রিয়া সাহাকে নিন্দা করেন, ঠিক আছে। সেইসাথে তো আপনাকে বলতে হবে যে সমস্যাটা আছে এবং এটা দূর করতে হবে। আপনারা যারা সরকারি দলের সমর্থক, আপনারা এইটা না বলে যদি উল্টা বলেন যে না আমার পেছনে ময়লা নাই তাইলে তো মুশকিল। আপনি অস্বীকার কোলে তো ময়লা নাই হয়ে যাবে না, কিন্তু তখন আর পরিষ্কারের প্রকল্পটা আসবে না।

এর আগে অন্য ইস্যুতেও এরকম হয়েছে। টিআইবি নামক একটা ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান বলেছে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে শীর্ষে চলে গেছে। আপনারা সবাই মিলে টিআইবিকে গালি দিলেন- ওরা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চায়, বিদেশিদের চক্রান্ত ইত্যাদি। ঠিক আছে ওরা বাজে লোক, দেশের বদনাম করেছে, আপনারা নিন্দা করলেন। কিন্তু দুর্নীতি তো কমলো না।

এখন আপনি যতই গলা ফাটান আর বলেন যে দেশে দুর্নীতি নাই, জিরো টলারেন্স বা মাইনাস টলারেন্স- আমি কী বলবো? দুর্নীতি চলে গেছে? যায়নি তো। ঐ যে আপনার উল্টা বক্তব্যের কারণে পরিষ্কার করার প্রকল্পটা নেওয়া হয়নি। ফল যা হওয়ার হয়েছে। ময়লা বেড়েছে, ময়লা পচেছে- বিবমিষা উদ্রেক করার মতো পরিস্থিতি হয়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হচ্ছে যে উনার সকল প্রচেষ্টা সকল অর্জন নাকি খেয়ে ফেলছে দুর্নীতিতে।

(৪)
কথা বলেন। স্পষ্ট করে বলেন- যে হ্যাঁ সাম্প্রদায়িকতা আছে, সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ হয়নি। সেইসাথে প্রত্যয় ঘোষণা করেন, যে না, আমরা এই দেশে আমার এই প্রিয় মাতৃভূমিতে সাম্প্রদায়িকতা রাখবো না। সেই প্রত্যয়ের সাথে ম্যাচ করে এরকম কর্মসূচি নেন, কিছু তো নিয়েছেন, আরও নেন, ফলাফল আসুক। তখন আপনাকে আর প্রিয়া সাহার নিন্দা করতে হবে না।

ব্রাউন নোজ (brown nose) ধরনের যারা আছে, ওরাও তখন আর আপনার পেছনে ছোক ছোক করবে না। কেন করবে? আপনি তো পরিষ্কার করেই ফেলেছেন।

শেয়ার করুন: